২০১২ সালের ২১শে ডিসেম্বর। পৃথিবী চলছে তার চিরচেনা গতিতে। সূর্য উঠেছে, পাখিরা ডাকছে, রাস্তায় গাড়ি চলছে, মানুষ প্রতিদিনের কাজকর্মে ব্যস্ত। কোনো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। তবু কোথায় যেন একটা চাপা উত্তেজনা, এক অজানা ভয়। কেউ প্রকাশ্যে বলছে না, তবে অনেকেই মনে মনে ভাবছে—”আজই কি পৃথিবীর শেষ দিন?”
মায়ান ক্যালেন্ডারের শেষ দিন বলে কয়েক বছর ধরেই নানা গুজব ছড়িয়েছে—ধ্বংস হবে পৃথিবী, নাকি আসবে এলিয়েন? কেউ বলছে বিশাল গ্রহ ধাক্কা দেবে পৃথিবীতে, কেউ আবার নিশ্চিন্তে চা খেয়ে বলছে—”সবই বাজে কথা।”
ঢাকার মোহাম্মদপুর নিবাসী ছেলে তুহিন, এক সাধারণ কলেজপড়ুয়া ছেলে। নিয়মিত কলেজে যাওয়া আসা করে। পৃথিবীর সব বিষয়েই তার কৌতূহল। তাই এই বিষয়টা নিয়েও সে একটু ঘাটাঘাটি করেছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাসার ছাদে উঠে বসে আছে সে। চারদিকে ঝিম ধরা নীরবতা। আকাশ পরিষ্কার। তার মনে প্রশ্ন— “যদি সত্যিই আজ পৃথিবী শেষ হয়ে যায়? যদি আর সকালে উঠে মা’র ডাক না শুনি, যদি আর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হয়, যদি সব মুছে যায় এক ঝটকায়?”
সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। হঠাৎ একটা উল্কা আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথায় চলে যায়। সে ফিসফিস করে বলে— “হয়তো কিছুই হবে না, কিন্তু ভয়টা আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে—জীবন নিয়ে, সময় নিয়ে, প্রিয় মানুষদের নিয়ে।” রাত বাড়ে। ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ১২টার দিকে। তুহিন নিচে নামে। মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। টেবিলের ওপর রাখা গরম দুধ। সে দুধ খায়, চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘড়ির কাটা ১২টা ছুঁয়েছে। পৃথিবী ঠিক আগের মতোই আছে। ধ্বংস হয়নি এখনো।
এরকম বেশ কিছু ঘটনা আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন। তবে পৃথিবীর শেষ কীভাবে হবে সেটা কী ধারণা করেছেন কখনো? যদি না করে থাকেন তবে জেনে নিতে পারেন পৃথিবীর শেষ দিনের গল্পগুলো। এই প্রবন্ধে আমরা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কিছু বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করবো। তাহলে দেরী না করে শুরু করা যাক।
সূর্যের লাল দানব রূপ ধারণ (Red Giant Phase):
কখনো কী ভেবেছেন আমাদের সৌরজগতের শক্তির উৎস সূর্যটি একদিন নিভে যাবে? না ভয় পাবার কোন কারণ নেই, এখনো প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর বাকি আছে। সূর্য আমাদের আলো, তাপ এবং শক্তির যোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তবে অন্যান্য নক্ষত্রের মতোই সূর্যেরও একদিন মৃত্যু হবে। সূর্য তার আয়ু শেষ হলে ফুলে ফেঁপে লাল দানব হয়ে উঠবে এবং পৃথিবীকে গ্রাস বা ভস্ম করে দিতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে একসময় আবার ছোট হয়ে যাবে।
পুরো বিষয়টা একটু জটিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সূর্য একটি মধ্যম ভরের G-শ্রেণির প্রধান অনুক্রমের (Main Sequence) নক্ষত্র। সূর্য প্রতিদিন যে আলো ও তাপ আমাদের দেয়, তা মূলত এর কেন্দ্রে চলতে থাকা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার ফল। এখানে হাইড্রোজেন পারমাণু একীভূত হয়ে হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয় এবং সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে। এই শক্তিই আলো, তাপ ও সৌরবায়ুর মাধ্যমে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ে সূর্য তার সবচেয়ে স্থিতিশীল ও দীর্ঘস্থায়ী সময় কাটায়। এই বর্তমান পর্যায়টি সূর্যের পুরো জীবনের প্রায় ৯০% সময়জুড়ে বিস্তৃত। সূর্য মোট প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর ধরে প্রধান অনুক্রম পর্যায়ে থাকবে, অর্থাৎ এখনো প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর সময় বাকি আছে। এই সময়ে সূর্যের আকার ও তাপমাত্রা মোটামুটি স্থির থাকবে। তবে ধীরে ধীরে এর কেন্দ্রে হিলিয়াম জমা হতে থাকবে এবং তাপমাত্রা বাড়বে, ফলে সূর্য ধীরে ধীরে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে—প্রতিবিলিয়ন বছরে প্রায় ১০% বেশি উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পাবে।একসময় সূর্যের কেন্দ্রে থাকা হাইড্রোজেন প্রায় শেষ হয়ে যাবে। তখন কেন্দ্র সঙ্কুচিত হবে এবং তাপমাত্রা আরও বাড়বে, কিন্তু বাইরের স্তরগুলো প্রসারিত হয়ে বহু গুণ বড় হয়ে যাবে। তখন সূর্য রূপান্তরিত হবে একটি লাল দানবে (Red Giant)। এই অবস্থায় সূর্যের ব্যাস বর্তমানের তুলনায় প্রায় ২০০ গুণ বড় হয়ে যেতে পারে, যা মঙ্গল বা এমনকি পৃথিবীর কক্ষপথ ছুঁয়ে ফেলতে পারে।
এই পর্যায়ে, সূর্য হিলিয়াম ফিউশন শুরু করবে, যা কার্বন ও অক্সিজেন উৎপন্ন করবে। তবে সূর্যের ভর যথেষ্ট নয়—যেমন উচ্চ ভরের তারকারা করে—সুতরাং এটি কখনোই লোহা উৎপাদন পর্যন্ত যেতে পারবে না এবং সুপারনোভাও ঘটাবে না। লাল দানব হিসেবে কিছু মিলিয়ন বছর থাকার পর, সূর্য তার বাইরের স্তরগুলো মহাকাশে ছুড়ে ফেলবে। এতে তৈরি হবে প্ল্যানেটারি নীহারিকা। এই নীহারিকা কয়েক হাজার বছর স্থায়ী হয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। অন্যদিকে সূর্যের কেন্দ্রটি থেকে যাবে একটি ছোট সাদা বামন (White Dwarf) রূপে। এটি হবে পৃথিবীর সমান আয়তনের এক ঘন বস্তু, যার ভর হবে সূর্যের প্রায় অর্ধেকের সমান। সাদা বামন নতুন কোনো ফিউশন ঘটাতে পারবে না, তবে এটি প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকবে এবং ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে ঠাণ্ডা হতে থাকবে এবং ভবিষ্যতে লক্ষ-কোটি বছর পর একসময় এই সাদা বামন নিজ তাপ হারিয়ে কালো বামন (Black Dwarf) হয়ে যাবে। এটি হবে এক নিষ্ক্রিয়, অদৃশ্য পদার্থ যার মধ্যে কোনো আলো বা তাপ থাকবে না—মহাজাগতিক স্তরে বলা চলে এটি ‘মৃত’।
এভাবেই এখন থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর স্বাভাবিকভাবেই ঘটতে পারে পৃথিবীর সমাপ্তি।তবে ততদিনে মানুষ কিংবা পৃথিবীর প্রাণীকুল টিকে থাকার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।
সুপারনোভা থেকে গামা রশ্মি বিস্ফোরণ (Gamma-ray Burst):
সুপারনোভা হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিস্ময়কর জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনাগুলোর একটি, যেখানে একটি বিশাল ভরের তারা তার জীবনের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে হঠাৎ করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী হয় যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তা সূর্যের সমগ্র জীবদ্দশায় উৎপাদিত শক্তির চেয়েও বেশি শক্তি নির্গত করতে পারে। সুপারনোভা সাধারণত তখনই ঘটে, যখন একটি তারা তার কেন্দ্রের জ্বালানি—মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম—শেষ করে ফেলে এবং নিউক্লিয়ার ফিউশন বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার কেন্দ্র, শক্তির ভার আর সইতে না পেরে হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, এবং এই সঙ্কোচনের ফলে শক্তি নির্গত হয়ে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। সুপারনোভার ফলে তৈরি হয় ব্ল্যাক হোল, নিউট্রন তারা কিংবা সাদা বামন। এগুলো সৃষ্টি হওয়া মূলত নক্ষত্রের ভরের ওপর নির্ভর করে। এই বিস্ফোরণের সময় মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের মৌলিক উপাদান যেমন লোহা, কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি—যেগুলো পরবর্তীতে নতুন নক্ষত্র, গ্রহ ও এমনকি প্রাণের উপাদান তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
কিছু সুপারনোভা বিস্ফোরণে সাধারণত গামা রশ্মির ব্যাপক নিঃসরণ ঘটে। গামা রে বিস্ফোরণ হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণগুলোর একটি, যা কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এতে এত শক্তি নির্গত হয় যে, তা আমাদের সূর্য সারাজীবনে যত শক্তি ছড়ায় তার চেয়েও বেশি। আমাদের একমাত্র নক্ষত্র সূর্যের সুপারনোভা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে গামা রে বিস্ফোরণ যদি পৃথিবীর খুব কাছাকাছি ঘটে এবং এর জেট পৃথিবীমুখী হয়, তবে তা আমাদের বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এমনকি ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে, পৃথিবীতে অতীতে কয়েকটি গণবিলুপ্তির কারণ হতে পারে এমন কোনো গামা রশ্মির বিস্ফোরণ।
প্রতিপদার্থ বা উচ্চ শক্তির পদার্থের সংঘর্ষঃ
আন্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ সম্পর্কে আপনারা নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন। প্রতিপদার্থের কণাগুলো সাধারণ পদার্থের কণার বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়। যেমন, ইলেকট্রনের বিপরীতে থাকে পজিট্রন, যার চার্জ ধনাত্মক। যখন প্রতিপদার্থ কোনো সাধারণ পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন তারা একে অপরকে নিঃশেষ করে দিয়ে সম্পূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়—এই ঘটনাকে বলে অ্যানিহিলেশন। এই অ্যানিহিলেশন প্রক্রিয়ায় যে শক্তি নির্গত হয় তা অত্যন্ত বিশাল। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র ১ গ্রাম প্রতিপদার্থ ও ১ গ্রাম সাধারণ পদার্থ একত্রে মিশে গেলে তা থেকে প্রায় ৮৯ কিলোটন টিএনটি (TNT) বিস্ফোরকের সমান শক্তি উৎপন্ন হয়, যা হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী। এখন যদি কল্পনা করা হয় যে, বিপুল পরিমাণ প্রতিপদার্থ কোনোভাবে পৃথিবীতে আনা বা উৎপাদন করা সম্ভব হয় এবং সেটি পৃথিবীতে থাকা পদার্থের বড় অংশের সাথে সংঘর্ষে আসে, তবে তা ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে, যদি কয়েক হাজার টন প্রতিপদার্থ পৃথিবীর ভূত্বকে বা কেন্দ্রীয় অঞ্চলে একযোগে অ্যানিহিলেশনে নিযুক্ত হয়, তবে তা বিশাল তাপ ও চাপের সৃষ্টি করবে, যার ফলে মহাপ্রলয়ের মতো পরিস্থিতি ঘটতে পারে। এই ধরণের বিস্ফোরণে ভূত্বকের বড় অংশ উড়ে যেতে পারে, সুনামি, ভূমিকম্প ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে পারে, এমনকি পৃথিবীর কক্ষপথেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আরও ভয়াবহভাবে, যদি এই অ্যানিহিলেশন গভীর ভূগর্ভে হয়, তবে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে ম্যাগমা স্তরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং তা বিশাল আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। এতে পৃথিবীর পরিবেশ একেবারে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
তবে বাস্তবতা হলো, এত বিপুল পরিমাণ আন্টিম্যাটার সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা পরিচালনা করা বর্তমান প্রযুক্তির জন্য একেবারেই অসম্ভব। গবেষণা কেন্দ্রগুলো যেমন CERN-এ বছরে যে অল্প পরিমাণ আন্টিম্যাটার তৈরি হয়, তা দিয়ে একটি সাধারণ বাতিও কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত জ্বালানো সম্ভব হয়ে উঠে না। এছাড়াও প্রতিপদার্থ তৈরি করতে প্রচুর শক্তি লাগে এবং তা সংরক্ষণ করতে হয় চুম্বকক্ষেত্রে ভাসমান অবস্থায়—কারণ তা যেকোনো পদার্থের সংস্পর্শেই তাৎক্ষণিকভাবে অ্যানিহিলেট হয়ে যায়। তবুও, বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিকভাবে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন থাকেন এবং এটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনির এক রোমাঞ্চকর উপাদান হয়ে উঠেছে। যদি ভবিষ্যতে কোনো উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বিপুল পরিমাণ প্রতিপদার্থ উৎপাদন সম্ভব হয় এবং তা যদি ভুল জায়গায় ব্যবহৃত হয় কিংবা দুর্ঘটনাক্রমে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা সত্যিই এক অভাবনীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সেজন্য বিজ্ঞানীরা এই শক্তির প্রতি অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টিতে গবেষণা করে থাকেন।
দুইটি ছায়াপথের মধ্যে সংঘর্ষঃ
পৃথিবীসহ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ’গুলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি’র অন্তর্ভুক্ত। আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সি হচ্ছে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। ভবিষ্যতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ও এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে—এবং বিজ্ঞানীদের মতে এটি একেবারে নিশ্চিত। এই সংঘর্ষ হবে এখন থেকে প্রায় ৪-৫ বিলিয়ন বছর পরে, এবং এটি একটি ধীর কিন্তু বিশাল স্কেলের মহাজাগতিক ঘটনা। মূলত এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটি (M31) প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১১০ কিমি গতিতে মিল্কিওয়ের দিকে এগিয়ে আসছে। এই গতি হিসাব করা হয়েছে হয়েছে ডপলার ইফেক্ট এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপের পরিমাপ দিয়ে। বিজ্ঞানীদের মতে, মহাকর্ষ বলের কারণে এন্ড্রোমিডা ও মিল্কিওয়ে একে অপরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ অনিবার্য।
গ্যালাক্সি দুইটির সংঘর্ষে কী ঘটবে? দুইটি গ্যালাক্সি একত্রিত হয়ে সম্ভবত একটি নতুন বিশাল এলিপটিক্যাল গ্যালাক্সি তৈরি করবে, যাকে অনেক বিজ্ঞানী “মিল্কড্রোমিডা” বা “মিল্কোমিডা” নামেও ডাকেন। অনেকে মনে করতে পারেন, সংঘর্ষের ফলে দুটি গ্যালাক্সির সব গ্রহ নক্ষ ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রগুলোর মধ্যে দূরত্ব এত বেশি যে সরাসরি এদের সংঘর্ষ খুবই অস্বাভাবিক। তবে মহাকর্ষ এর কারণে নক্ষত্র ও গ্রহগুলোর কক্ষপথ পরিবর্তিত হতে পারে। এতে করে আমাদের সূর্যও হয়তো নতুন কক্ষপথে সরে যাবে, এবং আকাশে রাতের দৃশ্য নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে, তবে সরাসরি ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা কম। পৃথিবীর কক্ষপথও পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই ঘটনা ঘটতে যত সময় লাগবে, সেই সময়ের মধ্যে সূর্য নিজেই একটি রেড জায়ান্ট হয়ে উঠবে (প্রায় ৫ বিলিয়ন বছরের মধ্যে), যা ততদিনে পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে।
ছায়াপথ দু’টির সংঘর্ষে পৃথিবীর বিনাশ না ঘটলেও, ভবিষ্যতে এমন কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে যাতে পৃথিবী হয়তো আসলেই ধ্বংস হতে পারে। হ্যাঁ, ভবিষ্যতে কিছু ভ্রাম্যমাণ কৃষ্ণগহ্বর কিংবা নিঃসঙ্গ গ্রহ চলে আসতে পারে আমাদের সৌরজগতে, যা বিভিন্ন বিপদ ডেকে আনতে পারে। নিঃসঙ্গ গ্রহ হলো এমন এক ধরণের গ্রহ যা কোনো নক্ষত্রের কক্ষপথে আবদ্ধ থাকে না; বরং একাকী ভেসে বেড়ায় মহাশূন্যে। যদি এমন একটি গ্রহ পৃথিবীর আশেপাশে চলে আসে, তাহলে এর বিশাল মহাকর্ষীয় শক্তি সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। পৃথিবী তার সূর্যকে কেন্দ্র করে চলমান স্থিতিশীল কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়তে পারে। সূর্যের থেকে অনেক দূরে সরে গেলে পৃথিবী তীব্র ঠান্ডায় জমে যেতে পারে, অথবা খুব কাছে চলে গেলে সূর্যের উত্তাপে পুড়ে বাসযোগ্যতা হারাতে পারে। একইভাবে, ভ্রাম্যমাণ কৃষ্ণগহ্বর আরও ভয়ঙ্কর হুমকি তৈরি করতে পারে। একটি কৃষ্ণগহ্বর তার অত্যন্ত শক্তিশালী মহাকর্ষ দিয়ে দূর থেকে আস্ত গ্রহের কক্ষপথে টান সৃষ্টি করতে পারে। যদি এটি পৃথিবীর আশেপাশে চলে আসে, তবে পৃথিবী হয়তো তার কক্ষপথ থেকে সরে গিয়ে মহাকাশে হারিয়ে যেতে পারে, অথবা কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে টেনে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমনকি এর প্রভাব সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের গতিবিধিতেও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যদিও এই ঘটনাগুলো ঘটে অত্যন্ত বিরল, তবুও মহাকাশের অজস্র রহস্যের মধ্যে এই ধরনের বিপদগুলো সম্ভাবনার বাইরে নয়।
বিগ রিপঃ
বিগ রিপ (Big Rip) হলো একটি তাত্ত্বিক মহাজাগতিক ঘটনা, যেখানে বলা হয়েছে ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের প্রসারণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে যে শেষ পর্যন্ত সবকিছু—গ্যালাক্সি, তারা, গ্রহ, এমনকি পরমাণুও—ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই ধারণার ভিত্তি হলো মহাবিশ্বে বিদ্যমান ডার্ক এনার্জি, যা মহাবিশ্বের প্রসারণকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা জানি, বিগ ব্যাং-এর পর মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, তবে বিগ রিপ তত্ত্ব বলে যে এই প্রসারণ শুধু বাড়বে না, বরং এক সময় তা দ্রুত ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠবে। এই ত্বরণ এক সময় এমন স্তরে পৌঁছাবে, যখন ডার্ক এনার্জি মহাকর্ষীয় আকর্ষণকে অতিক্রম করে গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের গঠন ধ্বংস করে দেবে। এই ঘটনাক্রমে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য।
প্রথমে গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে এত দ্রুত দূরে সরে যাবে যে আকাশে অন্য কোনো গ্যালাক্সি আর দৃশ্যমান থাকবে না। এরপর সূর্য ও পৃথিবীর মতো নক্ষত্র ও গ্রহদের মধ্যকার গঠন ভেঙে যাবে। পৃথিবী তখন হয়তো সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাকাশে ছিটকে পড়বে বা একা ঘুরপাক খেতে থাকবে। কিন্তু এই ধ্বংস এখানেই থেমে থাকবে না। ডার্ক এনার্জির দমনহীন টান পৃথিবীর গঠনকেও ছিন্নভিন্ন করবে—মহাসাগর, পর্বত, ভূত্বক—সবকিছু আলাদা হয়ে যাবে। শেষ ধাপে, যখন বিগ রিপ ঘনিয়ে আসবে, তখন পরমাণু ও সাব-অ্যাটমিক কণাগুলোও আলাদা হয়ে যাবে। অর্থাৎ, পদার্থের মৌলিক গঠনও টিকে থাকবে না। এই ঘটনা ঘটতে পারে আগামী কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যে, যদি ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি সত্যিই তেমন হয় যেমনটা বিগ রিপ তত্ত্বে বলা হয়েছে।
যদিও এটি একটি তাত্ত্বিক মডেল, এবং এর অনেক অংশ এখনো গবেষণার অধীন, তবুও এর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে তবে বিগ রিপ একদিন ঘটতেই পারে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মহাজাগতিক ঘটনা, যেমন সুপারনোভা বিস্ফোরণ ও কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বিশ্লেষণ করে এই তত্ত্ব যাচাই করার চেষ্টা করছেন। এই তত্ত্ব যদি সত্য হয়, তবে পৃথিবীর ধ্বংস হবে মহাবিশ্বেরই অংশ হিসেবে—একটি মহাজাগতিক সমাপ্তি, যেখানে কোনো কিছুই টিকে থাকবে না।
এতক্ষণ যেসব ঘটনার উল্লেখ করা হলো সেগুলো ঘটার জন্য প্রচুর সময় লাগবে। কয়েক কোটি থেকে কয়েকশ কোটি বছর। তবে পৃথিবীতে থাকা মানবজাতি কিংবা প্রাণীকুলের বিনাশ ঘটতে পারে খুব দ্রুতই। হয়তো কোনো গ্রহাণুর আঘাত কিংবা পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর প্রাণীকুল। সে নিয়ে বিস্তারিত আরেকদিন বলবো। তবে ধ্বংস সবসময় সমাপ্তি ডেকে আনে না; বরং কিছু ধ্বংস সৃষ্টি করে নতুনের। মানবজাতির ধ্বংস হলেও ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কোনো প্রজাতির উদ্ভব হবে, যারা পৃথিবীর কল্যাণে কাজ করবে। ততদিন অপেক্ষায় থাকা যাক।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply