মানবদেহ; পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল, সবচেয়ে রহস্যময় এক জৈবিক সংগঠন। মাথার ত্বক থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত, প্রতিটি কোষে লুকিয়ে আছে অসংখ্য রহস্য। আছে নানাবিধ প্রাণের মনোরম জীবনযাপন। আমরা প্রতিনিয়ত বহন করছি কোটি কোটি “অতিথি”–এরা খায়, ঘুমায়, প্রজনন করে। এরা কখনো আমাদের বন্ধু, কখনো আবার শত্রুও বটে!
এই “অতিথি” আসলে কারা? এরা হলো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, আর্কিয়া এবং প্রোটোজোয়া। আমাদের শরীরেই গড়ে উঠেছে এদের বিশাল জনপদ যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন “মাইক্রোবায়োম”। এই অণুজীবদের চোখে দেখা যায় না, তবুও তারা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
চলুন আজ আমরা ডুব দেই সেই অদৃশ্য জগতে, শুনবো এক রহস্যময় বসতির গল্প!

মুখ ও ত্বকে ক্ষুদ্র প্রাণের সমারোহ
সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নায় নিজেকে দেখছেন, দাঁত মাজছেন, মুখ ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন কাজে। কিন্তু জানেন কি, আপনার চোখের পাপড়ির গোড়ায় কিংবা ত্বকের লোমকূপে ঘুমিয়ে ছিলো এক অদ্ভুত প্রাণীও? নাম তার ডেমোডেক্স মাইট (Demodex mite)।
এরা দেখতে পোকামাকড়ের মতো, তবে এত ছোট যে সাধারণ মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা অসম্ভব। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মুখে অন্তত ১০০টি করে মাইট বাস করে (প্রায়)!
তবে ভয় পাবেন না, তারা আমাদের ক্ষতি করে না। বরং তারা ত্বকের মৃত কোষ খেয়ে সেখানকার পরিবেশ পরিষ্কার রাখছে। অবশ্য কখনো কখনো সংক্রমণের কারণও হয়ে উঠছে তারা।
এছাড়াও, আমাদের মুখে বাস করে হাজারো রকম ব্যাকটেরিয়া। Streptococcus, Actinomyces, Lactobacillus প্রভৃতি জীবাণু দাঁতের গঠন ও ক্ষয়, মুখের দুর্গন্ধ এবং হজমের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। মুখের অভ্যন্তরেও এসব প্রাণীর জন্য রয়েছে এক অনন্য পরিবেশ, এক জৈবিক শহর!

অন্ত্রের রাজত্ব গাট মাইক্রোবায়োম
এখন আসা যাক আমাদের শরীরের সবচেয়ে জনবহুল জায়গায়, অন্ত্র বা গাট (Gut)। এই অন্ত্রেই বাস করে আমাদের শরীরের মোট অণুজীবদের প্রায় ৮০%।
প্রতি মিলিলিটার অন্ত্রতলে থাকে প্রায় ১০০ কোটি ব্যাকটেরিয়া। এরা শুধু হজমেই সাহায্য করে না, এরা ভিটামিন তৈরি করে, হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি আমাদের মস্তিষ্কে খবরও পাঠায়, মানে “মুড” বা মনোভাবও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এরা!
তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ কাজের জন্য পরিচিত। যেমন:
- Bifidobacterium: শিশুর অন্ত্রে বাসা বাঁধে, রোগ প্রতিরোধে পালন করে সহায়ক ভূমিকা।
- Lactobacillus: দুধ হজম করে, অংশ নেয় দুধজাত খাবার প্রক্রিয়ায়।
- Escherichia coli: এরা সবসময় ক্ষতিকর নয়, বরং কিছু প্রজাতি অন্ত্রের জন্য উপকারী।
তবে, আধুনিক গবেষণায় এটা স্পষ্ট, এই অণুজীবরা না থাকলে আমরা হজম করতে পারতাম না, এমনকি আমাদের ইমিউন সিস্টেম বিকল হয়ে যেত।

দেহত্বকে এক জীবন্ত জৈব সমাজ
আপনার শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ কী? ত্বক, তাই না? এই ত্বক জীবাণুদের কাছে স্বর্গতুল্য।
ত্বকের বিভিন্ন অংশে বাস করে বিভিন্ন ধরণের অণুজীব। মুখে এক ধরণের, কনুইয়ে আরেক ধরণের, আবার পায়ের আঙুলের ফাঁকে বিরাজমান আলাদা আলাদা জগৎ।
এই ত্বকীয় অণুজীবেরা আমাদের শরীরের “প্রতিরক্ষা সেনা” হিসেবে কাজ করে। তারা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং আমাদের ত্বককে রক্ষা করে জটিল-কঠিন সংক্রমণ থেকে।
এসব ত্বকে পাওয়া যায়-
- Staphylococcus epidermidis: নিরীহ, কিন্তু ত্বকের পাহারাদার।
- Cutibacterium acnes: কখনো কখনো ব্রণের কারণ, তবে সবসময় ক্ষতিকর নয়।
- Malassezia: একধরনের ছত্রাক, যা চুলের খুশকি সৃষ্টি করতে পারে।
ত্বকের উপরিভাগে এসব অণুজীব একত্রে এক ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছে। এই ভারসাম্য নষ্ট হলেই দেখা দেয় চর্মরোগ।

রক্ত ও দেহের গভীরে অণুজীবের রাজত্ব
বহুদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, রক্ত একেবারে জীবাণুমুক্ত। কিন্তু আধুনিক গবেষণা দেখিয়েছে, কিছু ব্যাকটেরিয়া রক্তে ক্ষণিকের জন্য থাকতে পারে, বিশেষত রোগ বা অস্ত্রোপচারের পর। যদিও রক্তে জীবাণু প্রবেশ করা মানেই তা ভালো কিছু নয়, কারণ তা সেপ্টিসেমিয়া বা রক্তের সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
তবে এক চমকপ্রদ তথ্য হলো, গর্ভধারণকালে গর্ভফুল (placenta)-এও পাওয়া গেছে অণুজীব! তারা ঠিক কী কাজ করে তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, গর্ভস্থ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনে ভূমিকা রাখে এরা।

ভাইরাসের জগতে জিনের খেলা
আমরা অনেকসময় নতুনভাবে আগত ভাইরাসকেই কেবল রোগের কারণ হিসেবে দেখি। যেমন: ফ্লু, কোভিড-১৯ বা ডেঙ্গু। কিন্তু জানেন কি, আমাদের শরীরেই আছে “এন্ডোজেনাস ভাইরাল এলিমেন্ট”, অর্থাৎ জিনে মিশে থাকা পুরোনো ভাইরাস?
এরা হাজার হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের শরীরে ঢুকেছিল, এবং এখন জিনোমের অংশ হয়ে গেছে।
একদিকে যেমন কিছু ভাইরাস রোগ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে কিছু ভাইরাস আমাদের জিনগত বিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। মজার বিষয় হলো আমাদের DNA-র প্রায় ৮% এসেছে এই ভাইরাস থেকে!

উদ্ভিদের দেহেও বাস করে অণুজীব!
শুধু মানুষের শরীর নয়, উদ্ভিদের ভেতরেও থাকে এই অণুজীবেরা। এদের বলা হয় Endophytes। পাট, ধান, গম, তুলা, এসব গাছের ভেতরে বাস করে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক যারা গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, কাজ করে কীটনাশক হিসেবে কিংবা তৈরি করে হরমোন।
সম্প্রতি ঢাবির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় এমন একটি ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করা হয়েছে (Staphylococcus hominis) যা পাটগাছের শরীরে বাস করে এবং “হোমিকরসিন (Homicorcin)” নামক নতুন এক অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন করে। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের চিকিৎসা জগতে আশার আলো হতে পারে।

অণুজীববিহীন মানুষ, সম্ভব?
যদি অণুজীব না থাকত, তাহলে কী হতো?
উত্তর সহজ, মানবদেহ চলতোই না। আমরা খাবার হজম করতে পারতাম না, ভিটামিন তৈরি হতো না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ত, এমনকি শিশু জন্মানোও ব্যাহত হতো।
এই মাইক্রোবায়োম আসলে আমাদের সহ-উৎপাদনকারী। তারা আমাদের দেহে জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশ করে, মায়ের জরায়ু থেকে, স্তনের দুধ থেকে, পরিবেশ থেকে। আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে তারা থাকে, আমৃত্যু পর্যন্ত।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অণুজীবের ব্যবহার
বর্তমানে অণুজীব ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে-
- প্রোবায়োটিক: Gut-এর জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া
- বায়োঅ্যান্টিবায়োটিক: অণুজীব-নির্ভর ওষুধ
- ব্যাকটেরিওফাজ থেরাপি: ব্যাকটেরিয়া খাদক ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ রোধ
- ফেকাল মাইক্রোবায়োম ট্রান্সপ্লান্টেশন: একজনের অন্ত্র থেকে অন্যের অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া প্রতিস্থাপন করা।
এগুলো সবই এক নতুন চিকিৎসা ধারার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে মানবদেহের বাইরে নয়, বরং শরীরের ভেতরের “সহবাসীদের” মাধ্যমে নিরাময় খোঁজা হবে।

পরিশেষে
মানবদেহ শুধু একক প্রাণ নয়, এ এক সমষ্টিগত জীবজগৎ। একে বলা যায় “সুপারঅর্গানিজম”, যেখানে অণুজীবেরা একটি সমবায়িক জীবনে আবদ্ধ। তারা কখনো বন্ধু, আবার কখনো শত্রু। এই সহাবস্থান, এই লুকিয়ে থাকা প্রাণেরা মানবদেহকে করে তুলেছে আরও জটিল, আরও বিস্ময়কর।
আমাদের উচিত এই অদৃশ্য প্রাণীদের গুরুত্ব বুঝে চলাফেরা করা, নিজের শরীরকে ভালোবাসা এবং এর উপকারী সহপ্রাণদেরও যত্ন নেওয়া।
তথ্যসূত্র:
- Sender, R., Fuchs, S., & Milo, R. (2016). Revised Estimates for the Number of Human and Bacteria Cells in the Body. PLoS Biology, 14(8), e1002533.
- BBC Earth Lab – Microbes Inside Us (YouTube Documentary)
- Dominguez-Bello, M. G., et al. (2010). Delivery mode shapes the acquisition and structure of the initial microbiota across multiple body habitats in newborns. PNAS, 107(26), 11971-11975.
- Scientific American – “Meet Your Microbes”
- Nature Reviews Microbiology – Various papers on human microbiome and gut-brain axis.
Leave a Reply