”ঘুম কেন জরুরী” লেখাটিতে ঘুমের মতো জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় নষ্ট করা আপাত-দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়ের কাজটা কি হতে পারে তা আমরা সাদা চোখে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা ঘুমানোর যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাই, তা ভালোমতো বুঝতে পারলে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এই প্রশ্নটার বাঁকা পথে আরো ভালো উত্তর পাওয়া যাবে, এরকম একটা সম্ভাবনার কথা উল্লেখ ছিলো গত লেখাটিতে। উত্তর-খোঁজার আগে ঘুম-গবেষণা আর ঘুমের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
ইউজিন আরিয়েনস্কি
ঘুম নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরুটা ছিলো বেশ উদ্ভট। উনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন ফরাসী গবেষক ঘুমের প্রক্রিয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। ঘুমের মধ্যে কি ঘটে তার সবচেয়ে সরল পর্যবেক্ষণ হতে পারে কোন ঘুমন্ত মানুষের পাশে সারারাত জেগে থেকে নিদ্রার মাঝে শরীরের নড়াচড়া লিপিবদ্ধ করা। কিন্তু এই গবেষকরা সরল পর্যবেক্ষণটি না করে বেশ মজার একটা কাজ করার করেন। তারা গবেষণার স্বেচ্ছাসেবকদের স্বপ্নের বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছিলেন। যেমন ঘুমের সময় স্বেচ্ছাসেবকদের নাকের কাছে সুগন্ধী ধরে আর পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিতেন তারা। তার কয়েক মিনিটপর স্বেচ্ছাসেবীদের জাগিয়ে জানার চেষ্টা করতেন তাদের স্বপ্নে কি ঘটেছে, গবেষকরা স্বপ্নকে প্রভাবিত করতে পারলেন কি না। বলা বাহুল্য, গবেষণার এই ধারা থেকে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় নি। ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত ঘুম সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা ছিলো অতীব সরল ও ভুলে ভরা। ধারণা করা হতো ঘুম একটা ধ্রুব, পরিবর্তনহীন অবস্থা যখন দেহ খুব একটা নাড়াচাড়া করে না। আরো ধারণা করা হতো ঘুমের সময় মস্তিষ্কের কার্যক্রম কমে যায় আর জেগে থাকার মাধ্যমে এ কার্যক্রম স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে।
১৯৫২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাগারে ইউজিন নামের একজন স্নাতক শিক্ষার্থী প্রাপ্তবয়স্কদের নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার সময় ইইজি সংকেত নথিবদ্ধ করছিলেন। এইসব নথি থেকে দেখা যায়, তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার সময় ইইজি কম ভোল্টেজের এলোমেলো চিহ্ন থেকে উচ্চ ভোল্টেজে সমলয়ের ধীর তরঙ্গের চিহ্ন দেখানো শুরু করে। ইইজি উপাত্তের দশা পরিবর্তনের এই পর্যায়ে ধারণা করা হতো ব্যাক্তি গভীর ঘুমে চলে গিয়েছেন – তার জেগে থাকার আগ পর্যন্ত এই দশা অপরিবর্তিত থাকবে। ইইজি পরিচালনার তখনকার রীতি অনুযায়ী এই নথিবদ্ধের কাজটি ৩০-৪৫ মিনিট পর্যন্ত করা হতো। তারপর ইইজি বন্ধ করে দেয়া হতো যাতে আর নষ্ট না হয়। এক রাত্রে ইউজিন তার আট বছর বয়সী ছেলেকে ল্যাবে নিয়ে আসেন এই পরীক্ষাটি করার জন্য। ছেলে ঘুমানোর ৪৫ মিনিট পরে ইউজিন কাগজে ইইজি-র দাগ দেখার সময় একটা আচমকা পরিবর্তন খেয়াল করলেন। ইইজি-র দাগ হঠাৎ নতুন একটি ছন্দে কাগজে দাগ দেয়া শুরু করলো। এই ছন্দ দেখতে জাগ্রত অবস্থার মতোই। কিন্তু ইউজিন তো তার ছেলেকে কোন নড়াচড়া ছাড়াই ঘুমাতে দেখছেন! ছেলে ঘুমাচ্ছে, কিন্তু তার মস্তিষ্কের ইইজি-পরিলেখ জাগ্রত অবস্থা নির্দেশ করছে, এটা খুবই বিস্ময়কর বিষয় ছিলো ইউজিনের জন্য। এখন আমরা জানি, ঘুমের এই দশা চোখের দ্রুত-নড়াচড়া (Rapid Eye Movement) বা REM-এর সাথে সম্পর্কিত। বয়স্করা তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার নব্বুই মিনিটের আগে এই দশা না আসলেও ছোটদের ক্ষেত্রে এটা দ্রুত আসে।
আরিয়েনস্কির এই গবেষণার হাত ধরেই ঘুম নিয়ে গবেষণার আধুনিক যুগ শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে ঘুমের একটা বিস্তারিত চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা ইইজি যন্ত্রকে সারা রাত চালু রেখে ঘুম চক্রের বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। ঘুম প্রক্রিয়ার এক একটি চক্রের দ্যৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় নব্বুই মিনিট হয়ে থাকে। তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যক্তি ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে উল্লিখিত ইইজি-র দাগ ধাপে ধাপে সমলয়ে ছন্দিত হতে থাকে। এই ধাপগুলো একত্রে নন-রেম (non-REM) ঘুম বলে। এদেরকে ঘুম ঘুম ভাব (ধাপ ১) থেকে শুরু করে গভীর ঘুম-এ (ধাপ ৪) ভাগ করা হয়। সাধারণত প্রতি রাতে আমরা চার থেকে পাঁচটি নন-রেম ঘুম চক্রের মধ্য দিয়ে যাই। তবে রাত গড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রতি ঘুম চক্রে নন-রেম ঘুমের পরিমান কমতে থাকে, সেখানে একটু একটু করে স্থান করে নেয় রেম (REM) ঘুম। ঘুম হতে জেগে থাকার আগের চক্রে এই রেম ঘুমের পরিমান অর্ধেকের মতো হতে পারে।
ঘুম-চক্র ও রেম-ঘুম
১৯৫২-র আগে ঘুমচক্র আবিষ্কার না হওয়াটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে বিজ্ঞানীরাও মাঝে মাঝে বোকার মতো ছোটখাটো কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলো থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে পারেন। ঘুমচক্র সনাক্ত করার জন্য ইইজি যন্ত্রই যে লাগবে এমন নয়। একজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে সারা রাত ধরে পর্যবেক্ষণ করলেও ঘুমচক্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধানটি হলো চোখের দ্রুত নড়াচড়া — যা বন্ধ চোখের পাতা দেখে বোঝা যায় সহজেই। আরো সতর্ক পর্যবেক্ষণে দ্রুত-অক্ষি-নড়াচড়া (রেম) ঘুমের সময় দেহে অন্যান্য পরিবর্তন ধরা সম্ভব। এদের মধ্যে আছে হৃদপিন্ডের স্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যাওয়া। এছাড়া যৌন-উদ্দীপনাও দেখা যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে লিঙ্গ উত্থান আর মেয়েদের ক্ষেত্রে স্তনের বোঁটা ও ভগাঙ্কুর শক্ত হয়ে যাওয়া, যোনীপথ সিক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। তবে আরো লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন দেখা যায় পেশী-টানের ক্ষেত্রে। একজন সাধারণ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি ঘুমের সময় সারারাত গড়ে চল্লিশবার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেন। এসময় তিনি এই নড়াচড়া সম্পর্কে মোটেই সচেতন থাকেন না। কিন্তু দ্রুত-অক্ষি-নড়াচড়া ঘুমের সময়ে দেহ একদম নিস্তেজ হয়ে যায়, কোন ঐচ্ছিক পেশিতে নড়াচড়া থাকে না। বিছানায় সটান চিত হয়ে শোয়া ছাড়া দ্রুত-অক্ষি-নড়াচড়া ঘুম বলতে গেলে অসম্ভব। পরবর্তী দূর-ভ্রমণের সময় তথ্যটি খেয়াল রাখবেন। বাসের আসনে হেলান দিয়ে ঘুমাতে পারলেও আর যাই হোক, রেম ঘুমে প্রবেশ করতে পারবেন না।
রেম ঘুমকে কখনো কখনো স্ববিরোধী ঘুম বলা হয়। কারণ রেম ঘুমের সময় ব্যাক্তি বলতে গেলে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে যান। কিন্তু ইইজি সংকেত জাগ্রত অবস্থার অনুরূপ থাকে। মস্তিষ্কের যে অংশ বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে, তা রেম ঘুমের সময় বিভিন্ন পেশীতে প্রয়োজনীয় সংকেত পাঠায়। তবে ব্রেনস্টেমের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সে সংকেত অবদমিত হয়। এর ফলে সুষুন্মাকান্ডের মধ্য দিয়ে নড়াচড়ার সংকেত অন্যান্য অঙ্গে যেতে পারে না। অবশ্য যেসব সংকেত করোটীয়-পথ হয়ে যায়, সেগুলো অবদমিত হয় না। তাই চোখের নড়াচড়া ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিড়ালের উপর করা এ বিষয়ক একটা মজার পরীক্ষার কথা জানা যাক। বিড়ালের মস্তিষ্কে যেসব স্নায়ু এই অবদমনের বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে সুক্ষ্ম শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে কেটে ফেলা হলো। তারপর বিড়ালরা রেম ঘুমের মধ্যে গেলে একটা এলাহী কারবার হয়। রেম ঘুমের মধ্যেই তারা চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই বিভিন্ন ধরনের নড়াচড়া ও চলাচল করে। তারা দৌঁড়ায়, থাবা দিয়ে ছোঁ মারে কোন অদৃশ্য কিছুকে, এমনকি কাল্পনিক শিকারকে খেতে থাকে। বেড়ালরা কখনোই আমাদেরকে বলবে না তারা আসলে স্বপ্ন দেখছে কি না। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এসব নড়াচড়ার কাজ তারা স্বপ্নের মধ্যেই করছিলো। অনেকটা এরকম ঘটনা দেখা যায় মানুষের ক্ষেত্রে। বয়স পঞ্চাশ পার হলে অনেকেরই রেম ঘুম সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়। এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যাক্তিরা রেম ঘুমের সময় বিভিন্ন ধরনের নড়াচড়া করেন; যেমন লাথি ও ঘুশি মারা, লাফালাফি এমনকি দৌড়ানো! এই সমস্যাটাকে অবশ্য ঘুমের মধ্য হাঁটা বা স্বপ্নচারীতার সাথে মেলানো যাবে না। ঘুমের মধ্যে হাঁটাকে স্বপ্নচারীতা বলা হলেও এটা আসলে নন-রেম ঘুমের মধ্যে হয়। সাধারণত রেম-ঘুম সংশ্লিষ্ট এসব আচরণিক সমস্যা কিছু ঔষুধের মাধ্যমে সারানো যায়। এসব ঔষুধ ঘুমের মধ্যে স্নায়বিক-অবদমনের ব্যাপারটি ফিরিয়ে আনে।
মানুষের জীবনে ঘুমচক্র ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। জন্মের সময় ঘুমচক্রে রেম-ঘুমের পরিমান ৫০ শতাংশ থাকলেও মধ্যবয়সে তা পঁচিশ শতাংশের মতো হয়ে যায়। আর বয়স্কদের ঘুমচক্রের ১৫ শতাংশ থাকে রেম ঘুম। বয়সের সাথে সাথে রেম-ঘুমের এই হ্রাস কুকুর, বিড়ালে ও ইঁদুরেও দেখা গেছে। প্লাটিপাসরা সারা জীবনে যতটুকু ঘুমিয়েছে, তার ৬০ শতাংশই হলো রেম-ঘুম। বিপরীতক্রমে বোতল-নাক ডলফিনরা মাত্র ২ শতাংশ সময় রেম-ঘুমে অতিবাহিত করে। মানুষের অবস্থান এই সীমার মাঝামাঝি। তবে রেম-ঘুমের মোট পরিমাণের সাথে স্তন্যপায়ী মস্তিষ্কের পরিমাণ কিংবা কাঠামোর ভিন্নতার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। নন-রেম-ঘুম মাছিদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তাই ধারণা করা হয়, এর উদ্ভব অন্তত পঞ্চাশ কোটি বছর আগে। অন্যদিকে রেম-ঘুম শুধুমাত্র উষ্ণরক্তের প্রাণীদের মাঝে দেখা যায়। প্লাটিপাস, একিডনার মতো আদিম স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিদের মধ্যে রেম-ঘুম দেখা গেলেও উভচর ও সরীসৃপদের ক্ষেত্রে রেম-ঘুম দেখা যায় না। তারমানে বিবর্তনীয় ইতিহাসে রেম-ঘুমের আবির্ভাব তুলনামূলক নতুন।
ঘুম-চক্র আর রেম-ঘুম সম্পর্কে না হয় জানা গেলো। কিন্তু ঘুম কেন দরকার এই প্রশ্নের কি হবে? পরবর্তী লেখায় থাকছে এ বিষয়ে আলোকপাত।
[ডেভিড লিনডেনের The Accidental Mind বইটির সপ্তম অধ্যায় Sleeping and Dreaming থেকে অনূদিত]
Leave a Reply