স্বপ্নের পেছনের বিজ্ঞান

“স্বপ্ন হল চোখের ভেতরে চোখ ...” সমুদ্র গুপ্ত

স্বপ্ন কি? মানুষ কেন স্বপ্ন দেখে? কেবল মানুষই কি স্বপ্ন দেখে? স্বপ্নের কি কোন অর্থ আছে?

এসব প্রশ্ন নতুন নয়। আদিমকালে মানুষ ভাবতো ঘুমের মধ্যে মানুষের আত্মা দেহ থেকে বের হয়ে আসে। তারপর ঘুরে বেড়ায় চারপাশের জগতে। তাই মানুষ স্বপ্ন দেখে। প্রাচীন গ্রীক-রোমানরা ভাবতো স্বপ্ন বিশ্লেষণ করলে হয়তো ভবিষ্যত সম্পর্কে জানা যাবে। শুধু গ্রীক-রোমানরাই নয়, প্রতিটি সভ্যতাই স্বপ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্য দেয়ার চেষ্টা করতো। অবশ্য স্বপ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই শতাব্দীতে সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল জাঙ প্রথম স্বপ্নের উপর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মান করেন। ফ্রয়েডের মতে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কিছু অবদমিত কামনা থাকে। স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের অবচেতন মন সেই অবদমিত কামনা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ফ্রয়েডেরই ছাত্র কার্ল জাঙ মনে করেন স্বপ্নের মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। অবশ্য তিনি স্বপ্নের অর্থ সম্পর্কে ভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন।ফ্রয়েডের পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে স্বপ্ন নিয়ে অন্যান্য তত্ত্বও গড়ে ওঠে।

ফ্রয়েড ও জাঙ

“এক্টিভেশন-সিন্থেসিস” একটি তত্ত্ব বলে যে স্বপ্নের আসলে কোন অর্থই নেই। ঘুমের সময় মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে আমাদের স্মৃতি থেকে বিভিন্ন চিন্তা এবং আবেগ উঠে আসে। এই চিন্তা এবং আবেগগুলো খাপছাড়া। অর্থাৎ এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। একমাত্র ঘুম থেকে উঠার পর আমরা এই খাপছাড়া দৃশ্য, চিন্তা এবং আবেগগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করি। তখন তৈরি হয় এক বা একাধিক গল্প।

মানুষ ছাড়াও অন্যান্য স্তন্যপায়ী যেমন বিড়ালেরাও যে স্বপ্ন দেখে, তারা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মতে, স্বপ্নের কোন অর্থ থাকুক বা না থাকুক, জীবনধারণের জন্য স্বপ্নের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। “থ্রেট স্টিমুলেশন”- তত্ত্ব অনুযায়ী জীবজগতে স্বপ্ন একটি প্রাচীন প্রতিরক্ষা পদ্ধতি। এই প্রতিরক্ষা পদ্ধতি উন্নত প্রাণীকে একটি বিবর্তনীয় সুবিধা দেয়। কারণ স্বপ্নের মাধ্যমে এমন ঘটনার স্মৃতি ও আবেগকে পুনরাবৃত্তিকরা যায় যা কিনা বাস্তবে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারতো। এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক এইসব ঝুঁকি আগে থেকে চিনে সরে যাওয়ার শিক্ষা পায়।

MIT-র গবেষণায় দেখা গেছে প্রাণীরাও স্বপ্ন দেখতে পারে।

সম্প্রতি জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র স্বপ্নের ক্রিয়াকৌশল সম্পর্কে আমাদের একটা নতুন ধারণা দেয়। এই গবেষণা অনুযয়ী, স্বপ্ন কোন এলোমেলো ঘটনাপুঞ্জ নয়। স্বপ্নের সাথে আমাদের আবেগীয় স্মৃতির গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ আছে। ঘুম থেকে উঠে মানুষ কিভাবে স্বপ্ন মনে করে তার উপর ভিত্তি করে এই গবেষণা চালানো হয়।

স্বপ্নের বিজ্ঞান

আমরা প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখার পরপরই যদি জেগে উঠি, তাহলে স্বপ্নটা আমরা মনে করতে পারি। স্বপ্ন দেখার পর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে আর সেটা মনে করতে পারি না।

অনেকগুলো নিউরন কোষের সমন্বয়ে তৈরি হয় মানুষের মস্তিষ্ক। নিউরন কোষগুলো সংকেত প্রেরণ করে বিদ্যুত-তরঙ্গের মাধ্যমে । জেগে থাকা, আধঘুম -আধজাগরণ, গভীর ঘুম, উত্তেজিত ইত্যাদি অবস্থায় মস্তিষ্কের বিদ্যুতিয় তরঙ্গের বিভিন্ন রকমফের দেখা যায়। মস্তিষ্ক সাধারণত চার ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি করে – ডেল্টা, থেটা, আলফা ও বেটা। উপরের গবেষণাটি চালানো হয় পয়ষট্টিজন স্বেচ্ছাসেবকের উপর। অনেক আগে থেকেই জানা ছিলো, মানুষ ঘুমের একটা বিশেষ পর্যায়ে স্বপ্ন দেখে। ঘুমের একটা পর্যায়ে দেখা যায় মানুষের চোখের পাতা নড়ছে। এই পর্যায়কে বলে Rapid Eye Movement বা রেম ঘুম। রেম ঘুমের পর কাউকে ঘুম থেকে তুললে সে বলতে পারে কি স্বপ্ন দেখেছিলো, কতবার দেখেছিলো ইত্যাদি। ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণায় অংশগ্রহণ করা স্বেচ্ছাসেবকদের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মাপা হয়। আর ঘুমের বিভিন্ন সময় স্বেচ্ছাসেবকদের জাগিয়ে তাদের স্বপ্নের বিভিন্ন তথ্য রেকর্ড করা হয়। তারা স্বপ্নে কি দেখেছিলো, কতবার দেখেছিলো, আদৌ কোন স্বপ্ন দেখেছিলো কি না ইত্যাদি তথ্য জোগাড় করা হয়।

কেন রেম ঘুমের পরেই মানুষ স্বপ্নের কথা মনে করতে পারে, এর উত্তর দেয় উপরের গবেষণাটি। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রেম ঘুমের পর যাদের মস্তিষ্কের “ফ্রন্টাল লোব” নামক অংশে স্বল্প কম্পাঙ্কের থেটা তরঙ্গ দেখা যায় – তারাই দেখা যায় স্বপ্ন বেশি মনে করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, যখন আমরা অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মরণ করি, তখনো মস্তিষ্কের এই অংশে স্বল্প কম্পাঙ্কের থেটা তরঙ্গ দেখা যায়। এরকম আরেকটি পরীক্ষাতে দেখা যায় উজ্বল, টাটকা এবং গভীর আবেগীয় স্বপ্নগুলো মস্তিষ্কের “অ্যামিগডালা” এবং “হিপ্পোক্যাম্পাস” নামের দুইটি জায়গার সাথে জড়িত। আমিগডালার কাজ হলো মানুষের আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ এবং তার স্মৃতি নিয়ে কাজ করা।

হিপ্পোক্যম্পাস বিভিন্ন স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে একত্রীকরণ করে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। দেখা যায়, রেম ঘুম কম হলে (অর্থাৎ স্বপ্ন কম দেখলে) মানুষের জীবনের জটিল আবেগগুলো বোঝার ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্ষমতাটা মানুষের সামাজিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। “ক্যারকট-উইলব্রান্ড সিন্ড্রোম” নামের একটি বিরল রোগে দেখা যায় মানুষ স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্কের যেই অংশ আমাদের দৃষ্টির অনুভূতির সাথে জড়িত, সেখানে ক্ষত সৃষ্টির কারণে এ রোগ হতে পারে।

উপরের পরীক্ষাগুলো স্বপ্ন এবং আবেগের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করে। তারমানে, আমাদের স্বপ্ন মস্তিষ্কের এমন সব জায়গায় তৈরি হয় (কিংবা ছড়িয়ে পড়ে) যেগুলো কিনা দৃষ্টি, আবেগ এবং দৃষ্টি-সংশ্লিষ্ট স্মৃতি নিয়ে কাজ করে। এই পরীক্ষাগুলো আমাদেরকে স্বপ্নের কারিগরী দিক এবং তাৎপর্য নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ গল্প বলে।

গল্প নয়, আবেগ

স্বপ্নের মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের আবেগগুলো প্রক্রিয়াজাত করে। আবেগের স্মৃতি তৈরি করে। আমরা স্বপ্নের মধ্যে অনেক কিছুই দেখি। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা কিংবা অভিজ্ঞতা যে বাস্তব হতে হবে তার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলোর সাথে যে আবেগ জড়িত সেগুলো পূর্ণমাত্রায় বাস্তব। স্বপ্নে দেখা গল্পগুলো চেষ্ট করে বাস্তব আবেগগুলো স্মৃতি তৈরি করে বেঁধে ফেলতে। এর ফলে আবেগগুলো আর সক্রিয় থাকে না। জীবন ধারণের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন – বিশেষ করে আমাদের নেতিবাচক আবেগের ক্ষেত্রে। নেতিবাচক আবেগগুলো স্বপ্নের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত না হলে তাহলে মানুষের রাগ ও দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। রেম-ঘুম কিছুদিন যদি না হয়, তাহলে মানসিক সমস্যা তৈরি হতে থাকে।

আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার সাথে স্মৃতি এবং আবেগ একটি ভঙুর সেতু দিয়ে যুক্ত। এই সেতুর নিয়ন্ত্রণের কাজ হলো স্বপ্নের।

তথ্যসূত্র The Science Behind Dreaming


আরাফাত রহমান Avatar

মন্তব্য

  1. bengalensis Avatar

    স্বপ্ন, কম্পিউটারের ডিস্ক ডিফ্রাগ্রেমেন্টেশনের মত। (আমার ধারনা)

    1. আরাফাত রহমান Avatar

      খুব সম্ভবত তাই। পাশাপাশি বিবর্তনীয় প্রতিরক্ষা তো আছেই। আবেগের বাষ্প বের করে দেয়ার নিরাপদ পথ হিসেবেও স্বপ্ন কাজ করে।

  2. nitol1991 Avatar
    nitol1991

    ভালো লাগল লেখাটা।

    1. আরাফাত রহমান Avatar

      অনেক ধন্যবাদ, নিটোল।

  3. sayanta Avatar
    sayanta

    অনেক জানার বাকি আছে , খুব ভাল লাগলো

    1. আরাফাত রহমান Avatar

      ধন্যবাদ পড়ার জন্য 🙂

  4. Marfuz Jahan Fahim Avatar
    Marfuz Jahan Fahim

    আমি একটা সমস্যায় পড়েছিলপড়েছিলাম ,এটা পড়ে আমি সেটা বুঝতে পেরেছি |

Leave a Reply