১.
হিগস কণা নিয়ে সংবাদ মহলে যে উৎসাহ তা হয়তো চাঁদে মানুষের পদার্পণে যে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছিল তার সঙ্গে তুলনা করা যাতে পারে। অথচ ১৯৯৫ সনে টপ কোয়ার্ক বা ২০০০ সালে টাউ নিউট্রিনোর আবিষ্কার জনমাধ্যমে সামান্য কৌতূহলের তরঙ্গও সৃষ্টি করতে পারে নি। ঐ দুটি কণার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সমস্ত দৃশ্যমান পদার্থের মূল উপাদান ১/২ স্পিন সম্বলিত ১২টি ফের্মিয়ন মৌলিক কণার সন্ধান সম্পূর্ণ হয়। ততদিনে বিজ্ঞানীরা তিনটি মৌলিক শক্তির মধ্যস্থ কণা স্পিন ১ সম্বলিত বোজন কণিকাগুলিকেও সনাক্ত করতে পেরেছেন – ফোটন (তড়িৎ-চুম্বকীয়), ৮ ধরণের গ্লুয়ন (সবল), এবং W+, W- ও Z বোজন (দুর্বল)।
বাকি রইল হয়ত মহাকর্ষের মধ্যস্থাকারী কণা গ্র্যাভিটন ও হিগস কণা।
নিঃসন্দেহে হিগস ক্ষেত্র বা হিগস কণা আমাদের মহাবিশ্বের গঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। হিগস ক্ষেত্র যদি কণাসমূহকে ভর না দেয় তবে মহাবিশ্বে পরমাণু-অণু, গ্রহ, নক্ষত্র সৃষ্টি হবে না। কারণ ভর পাওয়া মাত্রই মহাকর্ষের আকর্ষণ শক্তি কণাসমূহের ওপর কাজ করবে এবং তাদের একত্রিত করবার চেষ্টা করবে। কিন্তু হিগস ক্ষেত্র বা কণার সঙ্গে মহাকর্ষের ঠিক কি সম্পর্ক সেটা এখনো বিজ্ঞানীরা জানেন না। হিগস ক্ষেত্র কিছু কিছু কণার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া করে সেই কণাকে ভর দেয়। এই মিথষ্ক্রিয়া দুর্বল। কিন্তু সব কণাই হিগস থেকে ভর পায় কিনা সেটা আমরা এখনও জানি না। যেমন ডার্ক ম্যাটার কেমন করে ভরের অধিকারী হতে পারে সেটা আমরা জানি না। এমন কি নিউট্রিনোও হিগস ক্ষেত্র থেকে ভর না পেতে পারে।
কিন্তু আমরা সঠিক ভাবে জানি না হিগস কণা তার নিজের ভর কোথা থেকে পায়। তার কিছুটা ভর আসতে পারে নিজের ক্ষেত্রে সাথে বিক্রিয়ার ফলে। বাকিটা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা দ্বিধান্বিত।
কিন্তু রহস্যের এখানেই শেষ নয়। হিগস থেকে কণা যদি জাড্য ভর (ইনারশিয়াল ভর) পায়, আর মহাকর্ষ শক্তি যদি ভরের ওপর ক্রিয়া করে তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষের সঙ্গে হিগসের কোন সম্পর্ক থাকবার কথা। কিন্তু এবিষয়ে বিজ্ঞানীরা কোন সুদৃঢ় তত্ত্ব দিতে পারেন নি। এখানে বলে রাখি, মহাকর্ষ বস্তুর সমগ্র শক্তির ওপর কাজ করে, শুধুমাত্র ভরের ওপর নয়। যেমন ফোটনের জাড্য ভর শূন্য হওয়া সত্ত্বেও ফোটনের ওপর মহাকর্ষের প্রভাব আছে, কারণ ফোটনের শক্তি শূন্য নয়। কিন্তু হিগস মিথষ্ক্রিয়ায় শুধুমাত্র “অন্তর্নিহিত” ভরের উৎপত্তি হয়, সমগ্র ভরের নয়। একটি প্রোটনের সমগ্র ভর শুধুমাত্র হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে আসে না, বরং তার আধিকাংশ ভর কোয়ার্কের সবল মধ্যস্থাকারী ভরহীন গ্লুয়োনের গতিশক্তি থেকে আসে। দুটি প্রটোনের মাঝে যে মহাকর্ষ শক্তি সেটা অন্তর্নিহিত ভর + অন্যান্য শক্তির ওপর নির্ভর, অথচ হিগস ক্ষেত্র দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় শুধুমাত্র অন্তর্নিহিত ভর সৃষ্টি করে।
হিগস কণাকে নোবেল বিজয়ী লিওন লেডারম্যান অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঈশ্বর কণা নাম দিয়েছিলেন (হয়তো তাঁর বইয়ের প্রকাশকের ইচ্ছা অনুযায়ী)। সাংবাদিক ও ও অন্যান্য সাধারণ জনগণের কাছে এই নামটি এমন একটি কিংবদন্তীর সৃষ্টি করেছে যা কিনা হিগস ক্ষেত্রের প্রকৃত ক্রিয়াকে যথাযথ ভাবে মূল্যায়ণ করে না। আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে হিগস কণার কোন ভূমিকা নেই, যদিও সৃষ্টির পরবর্তীকালে মহাবিশ্বের কি গঠন হবে সেটা হিগস ক্ষেত্র অনেকাংশেই ঠিক করে দিয়েছিল। তাই হিগস সব রহস্যের সমাধান নয়, বরং মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য একটি মাইলফলক মাত্র।
২.
বস্তুকে ভর দিতে পারে হিগস ক্ষেত্র, হিগস কণা নয়। হিগস ক্ষেত্র বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেটা সমগ্র মহাবিশ্ব ছড়িয়ে আছে। যদি হিগস ক্ষেত্রের মধ্যে যথেষ্ট শক্তির সঞ্চার করা যায় তবে হিগস কণা সৃষ্টি সম্ভব। কোন তবলার পৃষ্ঠদেশে চাঁটি মারলে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি হবে। এখানে তবলার ওপরিভাগ হচ্ছে হিগস ক্ষেত্র আর সৃষ্ট তরঙ্গ কম্পন হচ্ছে হিগস কণা। আর এল এইচ সি কৃত দুটি প্রটোনের সংঘাত হচ্ছে তবলার ওপরে আঘাতের শক্তি।
এল এইচ সি’র চক্রে একটা প্রটোন ও একটা প্রতি-প্রটোনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। আমরা এটাও জানি প্রটোনের মধ্যে কোয়ার্কগুলো সবল মিথষ্ক্রিয়ায় আকৃষ্ট থাকে। কিন্তু এই মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যস্থকারী কণা গ্লুয়োন হিগস ক্ষেত্রের সাথে বিক্রিয়া করে না। এই জন্য গ্লুয়োনরা ভরহীন। কিন্তু যখন গ্লুয়োন কণারা ভীষণ শক্তিতে একে অপরকে আঘাত করে তারা হিগস ক্ষেত্রে একটা টপ ও প্রতি-টপ কোয়ার্ক তৈরি করে। টপ ও প্রতি-টপ কোয়ার্ক একে অপরকে ধ্বংস করে হিগস কণা সৃষ্টি করে।
পূর্বে ফেসবুকে নোট হিসেবে প্রকাশিত
Leave a Reply