ক্যাঁচক্যাঁচ

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

ভূমিকাঃ

বিজ্ঞানবিষয়ক এই ব্লগটি আমার খুবই প্রিয় একটি ব্লগ। আমি প্রায়শই এই ব্লগে আসি, একটি কিংবা দু’টি লেখা পড়ি। তৃতীয়টি পড়ার সময় আবিষ্কার করি আমারও তো এরকম কিছু একটা লেখা দরকার। এই ছেলেপেলেগুলো কি সুন্দর দিনের পর দিন “আহা…বেশ!বেশ!” টাইপ লেখা লিখে যাচ্ছে, আর আমি কি খালি দু’চোখ গোলগোল করে পড়তেই থাকব? লিখব কখন? এই না চিন্তা করে আমি যখন মহা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে “দাঁড়া …দেখাচ্ছি মজা” ভাব নিয়ে লিখতে বসি সমস্যার সূত্রপাত ঠিক তখনটাই। দুই ছত্র লিখি তো তিন ছত্র কাটি (মনে মনে মাথায় যেটা অগ্রীম লিখেছি সেটা সহ)।তাই আজ অবধি আমি একটি লেখাও দিতে পারি নাই।

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? এই রোগে আমি যে গত এক বছর ধরে ভুগছি, তার সাক্ষী আমি নিজে, আর ভুগছি যে অন্তত তার সাক্ষী আরও বহুজন।নাম জিজ্ঞাসা করবেন না এখন দয়া করে।

 

সমস্যাঃ

সে যাই হোক মোদ্দা কথা হচ্ছে আমাদের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। আমি বোঝার সুবিধার জন্য সমস্যাগুলোকে দুই ধাপে ভাগ করেছি।

ধাপ ১ – আমি কেন লিখতে পারছি না?

এটি নিয়ে আমি আসলেই অনেক চিন্তা করেছি, মাথার কয়েক গাছি চুল ছিঁড়েছি, এবং বহুত সাধনার পর তিনটি কারণ বের করতে সমর্থও হয়েছি। কারণ তিনটি হচ্ছেঃ

 

১। আমি অলস

২। আমি খুবই অলস

৩। আমি ইহজগত এবং পরজগতের(থাকলে) শ্রেষ্ঠ অলস

 

এর বাইরে আর কোন কারণ নেই, কোন কারণ থাকতে পারে না। কেউ আর কোন কারণ বললে এই আমি কানে তুলোর বস্তা গুঁজলুম, বলে দিলুম।

 

ধাপ ২ – আমি কেন এই ব্লগে লিখতে পারছি না?

এটি নিয়ে অবশ্য আমাকে খুব বেশী চিন্তা করতে হয়নি। এর সম্ভাব্য একটিই কারণ আর তা হচ্ছে

“ আমি লিখলেই কি এরা বুঝবে? এত কঠিন কঠিন বিষয় বোঝা কি এতই সহজ? হাহ!”

 

আমি অকপটে কিছু সত্যি কথা বললাম। যারা আমাকে মনে মনে বা মুখে মুখে ধোলাই দেবার জন্য তৈরি হয়ে গেছেন, তাদেরকে বলছি, ভাই আর পাঁচটা মিনিট ধৈর্য ধরুন, আমি সমাধানটা বলে যাই, তারপর যা ইচ্ছে হয় করুন।

 

আর আপনি যদি ইতোমধ্যে সমাধানগুলো জেনে থাকেন তাহলে আমাকে জানান, আমি উপকৃত হব, দেশবাসীকে জানান, দেশবাসী উপকৃত হবে, পুরো বিশ্বকে জানান, পুরো বিশ্ব আপনাকে চিনবে। আর না জেনে থাকলে, চুপচাপ পড়ে যান, কথা পরে।

 

সমাধানঃ

প্রথম ধাপের তিনটি সমস্যা আসলেই গুরুতর। এই সমস্যাগুলো থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তাহলে পরের ধাপের সমস্যাটা (যদি ভুগে থাকেন)নস্যিও না।

আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে আপনি যে প্রথম ধাপের সমস্যায় আক্রান্ত একজন ব্যক্তি সেটি বুঝতে পারা। আর কিচ্ছু না! কারণ আমরা প্রথম তিনটি সমস্যাকে সাধারণত এইভাবে দেখি না, বরঞ্চ দেখি এই ভাবেঃ

 

১।আমি বহুত ঝামেলায় থাকি

(ডাহা মিথ্যা কথা! আপনার ফেবু ইস্টেটাসের জ্বালায় আমি অস্থির)

২।আমার কোন সময় নাই (আবার মিথ্যা কথা বলে!)

৩।তুমি আমার জায়গায় আসলে বুঝতা…

(এতো দেখা যায় মহা জ্বালাতন! মাথায় আবেগিক বন্দুক ধরলে তো কথা কওয়া মুশকিল)

 

তাই আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে, উপরোক্ত এই তিনটি ঝামেলাকে আরও উপরোক্ত তিনটি পয়েন্ট দ্বারা প্রতিস্থাপন করা। আমি এই কাজটি করে ফেলেছি… হে … হে

এইবার আপনার পালা!

দ্বিতীয় ধাপের সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমি আমার একটি ক্ষুদ্র ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে বলে আমার ধারণা।

 

তখন আমার মাস্টার্স থিসিস জমা দেয়ার আর ৬-৭ মাস বাকি। চার সেমিস্টারের মধ্যে তিন সেমিস্টার শেষ, এই শেষ সেমিস্টারে শুধু থিসিস। এই সময় ক্লাসের সমস্ত ছাত্রছাত্রী মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ, যারা থিসিসটা জমা দিয়েই খালাস হয়ে যাবে, তারপর চাকরিবাকরি করবে। এদেরকে দেখলেই চেনা যায়, এরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পার্কে, নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়, ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলোতে ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া’ টাইপ ভাব করে ঢু মারে, থিসিসটাই শুধু করতে চায় না। কারণ ৬-৭ মাসে প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা করে কাজ করলে মোটামুটি মানের একটা মাস্টার্স থিসিস নামিয়ে ফেলা যায়। আর থিসিসটা শেষ করলেই তো ছাত্রজীবন শেষ। তাই যাদের বাপ-মার পয়সা আসে, তারা সেমিস্টার ব্রেক নেয় বা আজাইরা চাকরী করে। আর দ্বিতীয় ভাগ, যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএইচডি করবে। এদের চোখমুখ শুকনা শুকনা থাকে। কি করা যায়, কীভাবে করা যায়, কেন করা দরকার হাতং বিতিং বহু চিন্তায় জীবন অস্থির এদের। সবকিছুতেই রহস্যের গন্ধ পায়, মনে করে এইটা নিয়ে কেউ কাজ করে নাই, ওইটা নিয়ে কেউ কাজ করে নাই… আর সেই কয়দিন একটু তারা ফুরফুরা থাকে। কিন্তু একটু গুগলিং করলেই যখন দেখা যায় এই বিষয়ের উপর গবেষণাপত্রর অবস্থা ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ ধরনের, তখন তাদের অবস্থা ফুটা বেলুনকেও হার মানায়।

 

আমি গিয়ে হাতং বিতং গ্রুপেই পরলাম। কোনদিন আকাশে উড়ি তো পরের দিন ফুটা বেলুন।

 

এমতাবস্থায় একদিন প্রফেসরকে গিয়ে বললাম (যার সাথে থিসিস করছি) যে, আমি হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা অর্থাৎ পিএইচডি করেঙ্গা। সব শুনে প্রফেসর হ্যান-ত্যান করার আগে সাধারণত কি কি পেপার তৈরি করতে হয় তার এক বিশাল ফিরিস্তি দিলেন। শুনে তো আমার মাথায় স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সব খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়তে লাগল। পরাই স্বাভাবিক! কেন? ডক্টরেট করতে সবার আগে যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হল একটি প্রস্তাবনা পত্র (Proposal Letter)। এইটা কি? খায় না মাথায় দেয়?এইটা এমন কিছু না আবার সব কিছু। এতে যা যা থাকতে হবে তা হলঃ

১। এমন একটি প্রস্তাবনা যা আপনার আগে কেউ করেনি(করলেও বিশ্ববাসী জানে না)

২। কেন এ বিষয়ের উপর কাজ করা প্রয়োজন(‘মুরগী আগে না ডিম আগে’ টাইপ হলে হবে না)

৩। আপনি এ কাজের জন্য যে যোগ্য তার প্রমাণ দিন (আবার জিগায় টাইপ হুঙ্কার দেয়া যাবে না কিন্তু)

৪।………………

৫।………………

এইরকম বহুত হাতং বিতং।

তো যাই হোক আমি বহু খাটাখাটনি করে প্রস্তাবনা পত্র তৈরি করে একটি শুভদিন দেখে (ইউরোপে শুভদিন বলতে রৌদ্রজ্জ্বল দিন বোঝায়) দুরুদুরু চিত্তে অধ্যাপকের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। অধ্যাপক কাগজ রেখে দিয়ে ৭ দিন পরে আবার আসতে বললেন।

আমি আবারো এক সপ্তাহ পরে গেলাম এবং লক্ষ্য করলাম বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাঙালীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন ভিতরে ভিতরে কু কু করতে লাগল।

 

গিয়ে দেখি অধ্যাপক এক গাল হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। লক্ষণ খারাপ। খুবই খারাপ।

আমার দুই বছরের অভিজ্ঞতা বলে, এরা কোন একটা খারাপ খবর দেয়ার আগে ঠোঁটের দুই কোণা পিছনে নিয়ে যাবে, সমানে ‘ভেরী গুড!ভেরী গুড!’ বলে মাথা নাড়তে থাকবে এবং ‘কিন্তু!কিন্তু!’ ও করতে থাকবে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ফলতে লাগল। অধ্যাপক বিড়বিড় করতে লাগলেন,

‘ইহা খুব ভালো……খুব ভালো……কিন্তু একটা সমস্যা আছে…’

‘ইহা খুব ভালো……খুব ভালো……কিন্তু একটা সমস্যা আছে…’

 

সেতো আমি আগেই বুঝছি। এখন ঝেড়ে কাশলে ভালো হয়।

তো উনি ঝেড়ে কেশে যা বললেন, তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এই যে, আমার প্রস্তাবনা পত্র সবাই বুঝবে কিন্তু যাদের আসলেই বুঝা দরকার আর বাকীরা না বুঝলেও আমার তাতে কিচ্ছু না, সেই অর্থনীতি বিভাগই বুঝবে না। তাদের কাছে নাকি আমার এই প্রস্তাবনা পত্র আর চাইনীজ ভাষার কবিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কারণ তারা এত হাই থটের কথাবার্তা বুঝবে না। তাদের জন্য প্রস্তাবনা পত্র এমন হলে ভালো হয় যাতে পুরা ব্যাপারটা পানির মত সহজ মনে হয় আবার এও যেন হয় এই পানি মার্কা জিনিসের পিছনেও টাকা ঢালা যায়। তাই একে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে নতুন করে লিখতে হবে। এমনভাবে লিখতে হবে যাতে এরাও বুঝে, ওরাও বুঝে, ময়নার মাও বুঝে, কুদ্দুসের বাপও বুঝে।

অভিজ্ঞতা আর লম্বা করা যাবে না। এখানেই সমাপ্তি।

 

আসল কথায় আসি। আসল কথা হচ্ছে, আমার প্রস্তাবনা যদি এখন ময়নার মাকেও বুঝাতে পারি, কুদ্দুসের বাপকেও বুঝাতে পারি তাহলে যারা এই “আহা…বেশ!বেশ!” টাইপ লেখা লিখছে তাদেরকে বুঝাতে পারব না কেন?

স্বীকার করছি আমি, ব্যাপারটা সহজ না। অনেক সময় লাগবে, কষ্ট হবে, নাকের পানি চোখে ঢুকে যাবে,  চোখের পানি দিশেহারা হবে, কিন্তু অসম্ভব তো না, নাকি?

 

উপসংহার

এখন আপনারা অনেকে হয়ত বলতে পারেন, আপনি তো খালি ক্যাঁচক্যাঁচই করে গেলেন, আসল কাজ তো কিছুই করলেন না। তাদের উদ্দেশ্যে বলি,

১। উপরের আলোচনাটি আমার নিজস্ব মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ। এই সমস্যাটিতে যেহেতু আমি ভুগেছি, ভুগছি এবং ভবিষ্যতে যে ভুগব না তার কোন নিশ্চয়তা নেই, তাই এই বিষয়ে আলোকপাত করা দরকার। আর এতো নিখাদ মনোবিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞান ও যে বিজ্ঞানের একটি শাখা সে বিষয়ে আপনাদের কোন দ্বিমত আছে?

২। আমি শীঘ্রই আপনাদের জন্য নতুন নতুন লেখা নিয়ে হাজির হতে চাই। তার জন্য আমার প্রস্তুতি দরকার। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। কঠিন প্রস্তুতি নিচ্ছি।

 

আজকের মত বিদায়।

লেখাটি 289-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. শর্মিষ্ঠাদির লেখার হাত দারুণ … ভাষাটা ঝরঝরে, বেশ মজা লাগে পড়তে। আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারি, যত কঠিন বিষয় নিয়েই লেখুন না কেন, এরকম ঝরঝরে ভাষা হলে পাঠক বিষয়ে ডুব দেবেই দেবে … চালিয়ে যান দিদি …:)

  2. sharmistha Avatar
    sharmistha

    আরাফাত,

    তোমার প্রশংসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে মজা করে বিজ্ঞান লিখতে যাওয়া আসলেই বেশ কষ্টসাধ্য, তবে এও সঠিক এ ছাড়া উপায় ও নাই। দেখি কদ্দুর কি করতে পারি, চাপা তো পিটাই গেলাম ভালই…

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 910 other subscribers