মাকড়শার জালের নির্দিষ্ট কারুকাজ। বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা। মৌচাকে মৌমাছির শৃঙ্খলিত জীবনযাপন। অবাক হয়ে যাই। এই জীবগুলো খুব পারদর্শী নিজেদের কাজে। কিন্তু, ওরা কি বুদ্ধিমান? বাবুই পাখি বছরের পর বছর ধরে একই ভাবে তার বাসাটা বানায়। বাবুই কি রাজী হবে চড়ুইয়ের মতো ভেন্টিলেটরের বাসা বানিয়ে থাকতে? অথবা মাকড়শা পারবে ভিন্ন কোন প্যাটার্নে জাল বুনতে? মৌমাছিরা কি কোনদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মিছিল-মিটিঙ করবে?

এখানে চলে আসে রিফ্লেক্সের প্রশ্ন। মাকড়শাকে শিখতে হয় না জাল বোনা – সে জন্মের সাথে সাথে এই গুণটি নিয়ে আসে। একই কথা বাবুইয়ের শৈল্পিক বাসার ক্ষেত্রেও। জন্মের সাথে সাথে নির্দিষ্ট হয়ে যায় একটি মৌমাছি কি করবে – সে কি শ্রমিক হবে, না কি পুরুষ, না রাণী মৌমাছি হবে। এগুলো জন্মগত রিফ্লেক্স। রিফ্লেক্সের কথা আসলেই মনে পড়ে যায় রাশিয়ান বিজ্ঞানী পাভলভের কথা। পাভলভ মনোবিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছিলেন গবেষণাগারের সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার গন্ডীতে। পাভলভ দেখিয়েছিলেন রিফ্লেক্স অর্জন করা যায়। পরীক্ষাটা খুব সাধারণ। একটা কুকুরকে প্রতিদিন খাবার খাওয়ানোর আগে একটা ঘন্টা বাজানো হতো। এক সময় দেখাগেলো, ঘন্টা বাজানোর পর খাবার না দিলেও কুকুরের মুখ দিয়ে লালা ঝরে। কুকুর কিভাবে বুঝলো যে ঘন্টার আওয়াজের পরপরেই তাকে খাবার দেয়া হবে? এটাই হলো অর্জিত রিফ্লেক্স। পাভলভের মনোজগতে উকি দেয়ার একটা মনোরম বর্ণনা পাওয়া যায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের “শোন বলি মনের কথা” বইটিতে।
মাকড়শার জাল যতই সুন্দর হোক, আমরা কিন্তু বলি না মাকড়শাটা বেশ শিল্পমনা, শিক্ষিত। কিংবা বাবুইপাখিকে আমরা সৃজনশীল বলি না। তারমানে বুদ্ধিমত্তার সাথে শেখার একটা সম্পর্ক আছে। ব্যাঘ্রশাবককে বাঘিনী শিখিয়ে দেয় শিকারের রীতিনীতি। চিড়িয়াখানায় বড়ো হওয়া বাঘ কিন্তু শিকার করতে পারে না। ‘আমাদের চিড়িয়াখানা’ বইটিতে ভেরা চ্যাপেলিনাকে দেখা যায় কিনুলি নামের এক সিংহশাবক পুষতে। ভেরা চ্যাপেলিনার পরিবারের সাথে থেকে থেকে বড় হয়ে সে বেশ ‘সামাজিক’ সিংহে পরিণত হয়েছিলো। কিনুলির ‘বন্য’ না হয়ে ‘সামাজিক’ হওয়াটা ‘শিক্ষা’-র নিদর্শন। বাঘ-সিংহ যেমন শিকার শেখে, তেমনি সার্কাসের নানা খেলাও শেখে। সার্কাসে সে খেলতে বাধ্য হয় ট্রেইনারের চাবুকের ভয়ে। কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধি থাকলে কি বাঘমামা ট্রেইনারকে এক থাবায় মেরে ফেলতো না? তারমানে স্তন্যপায়ী বাঘ-সিংহের ‘যথেষ্ট’ বুদ্ধি নেই। বাঘ-সিংহের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে বেশি হলে আমরা বনে বনে ঘুরতাম। তারা হয়তো আমাদের ধরে ধরে খেলা শিখাতো আমোদিত হওয়ার জন্য! তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা অন্তত সরিসৃপের চাইতে বেশি। কুমিরকে কেউ দেখেছে সার্কাসে নর্তন-কুর্দন করতে? সরিসৃপের মস্তিষ্কের সাথে স্তন্যপায়ী মস্তিষ্কের একটা গুণগত ও পরিমাণগত পার্থক্য আছে। যে কারণে সরিসৃপ ‘পোষ’ মানে না। সে কথা অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে।
প্রাণীদের ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচরণকে আমরা বুদ্ধিদীপ্ত বলতে পারি? দেখলাম বাগানে ধোঁয়া উড়ছে, বুঝলাম মালী বোধহয় ঝরা পাতাগুলো পুড়াচ্ছে। যেখানে ধোঁয়া, সেখানে আগুন। এই ভাবনাটা বুদ্ধিদীপ্ত অবশ্যই। কার্যকারণ খোঁজার ক্ষমতা যে শুধু মানুষের আছে তা নয়। জিম করবেটের শিকার কাহিনীগুলোতে জঙ্গলের জীবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। বনের হরিণও পাখি বা বাঁদরের হুটোপুটি শুনে বুঝতে পারে কোন বিপদ উপস্থিত আছে কি না। ঠিক কোন কোন প্রাণীদের এই ‘কার্যের পেছনে কারণ’ খোজার ক্ষমতা আছে? প্রাণীদের বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক আসলে কতটুকু? একজন জীববিজ্ঞানী ‘বুদ্ধিমত্তা’-কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? প্রাণী কতোবেশি সংখ্যক ‘কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স’ তৈরি করতে পারবে তাই কি বুদ্ধিমত্তার নির্দেশক? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর সহজে দেয়া যায় না। কিন্তু খুব সহজ করে কিছু ধারণা হয়তো পাওয়া সম্ভব।
জীববিজ্ঞানের উপর সাম্প্রতিক একটা বই [১] ঘেঁটে নিচের পয়েন্টগুলো পাওয়া গেলো:
১. বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের পূর্বশর্ত হলো প্রাণীর বেশ কিছু সক্রিয় ইন্দ্রিয়ের। ইন্দ্রিয়ের কাজ হলো পরিবেশের বিভিন্ন তথ্য ‘ইনপুট’ হিসেবে নেয়া। এই ইন্দ্রিয়গুলোকে যথেষ্ট সংবেদনশীল হতে হবে। শক্তিশালী, সুক্ষ্ম ইন্দ্রিয় প্রাণীকে তার চারপাশ পরিবেশের বিভিন্ন তথ্য – রূপ-রস-গন্ধ, অবস্থার পরিবর্তনের খবর জানায়। যত সংবেদনশীলভাবে প্রাণী এই তথ্যগুলো জানতে পারবে, পরিবেশে ভেদে সঠিক আচরণ কিংবা উপযুক্ত কর্মপন্থা ঠিক করার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
২. ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে আসা সংবেদে প্রাণী কতভাবে সাড়া দিতে পারে? যত বেশি ভাবে সাড়া দিতে পারে, ততই তার কর্ম-ক্ষমতা বেড়ে যাবে। এই সাড়া দেয়া মানে হলো তর্জন-গর্জন, ওড়াউড়ি, নানাবিধ পেশি নড়নচড়ন ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোকে আমরা আউটপুট চ্যানেল বলতে পারি।
৩. ইনপুট ও আউটপুট রাস্তার সংখ্যা বাড়া মানে দুইমুখী তথ্যের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া। তথ্যের সমাহার নিয়ে শুধু পড়ে থাকলেই চলবে না, দরকার হবে এ তথ্য বিশ্লেষণ, যাচাই-বাছাই, সনাক্তকরার কাজ। এজন্য দরকার হবে তুলনামুলক বড় ও ক্ষমতাশীল মস্তিষ্ক।
৪. বড় মস্তিষ্ক হলেই শুধু হবে না। এসব ‘ইনপুট’ আর ‘আউটপুট’ রাস্তা যত বাড়বে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে বিভিন্ন রাস্তার মধ্যে আন্তঃ ও অন্তঃ সংযোগ, রাস্তার মোড়ের সংখ্যা। এই ইনপুট ও আউপুট চ্যানেলের আন্তঃ, অন্তঃ সংযোগের সংখ্যা বুদ্ধিমানপ্রাণীদের ক্ষেত্রে বেশি হবে।
বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের একটা দিক হলো, প্রাণীর চারপাশ পরিবেশ থেকে অপ্রতুল তথ্য ইনপুট পেলেও সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাণীদের আরো দুইটি বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন হবে। স্মৃতি ও শিক্ষা। বুদ্ধিমান প্রাণীদের অতীত স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাবস্থা রাখতে হবে। অতীতে যেসব ঘটনা ঘটেছিলো – বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের সাপেক্ষে ঝালাই করা দরকার। অতীতের ঐসব ঘটনা সংশ্লিষ্ট আচরণে ক্ষতি নাকি লাভ হয়েছে এটা মিলিয়ে নিতে পারবে বুদ্ধিমান পাণী। বুদ্ধিমান প্রাণীদের শেখার ক্ষমতা থাকতে হবে এটা আগেই একবার বলেছি। শেখা মানে একটা নতুন পরিবেশে কি করা উচিত, কি কি করা উচিত না তা আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ঠিক করা। বড়ো প্রাণীদের আচরণ দেখে দেখে শেখা, তাদের আচরণ নকল করতে শেখা। এজন্য বুদ্ধিমান প্রাণীরা শৈশবের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে মাতা-পিতার সাথে থাকে।
মস্তিষ্ক বেশি বলেই যে কোন প্রাণী বুদ্ধিমান হবে তা কিন্তু নয়। প্রাথমিকভাবে সব প্রাণীই চায় বাঁচতে আর বংশবৃদ্ধি করতে। এই দুটি কাজ করতে সবক্ষেত্রে বুদ্ধিমান না হলেও চলে। মস্তিষ্কের মূল কাজ হলো প্রাণীর দেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ঘটনা নিয়ন্ত্রণ। পরিবেশের সংবেদনে সাড়া দেয়া। যায় যে একটা বড় প্রাণীর দেহ পরিচালনা করতে তুলনামূলক বড় মস্তিষ্ক লাগে। নীলতিমির মস্তিষ্ক মানুষের চাইতে বড়, তাই বলে তারা মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নয়। অবশ্য অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় নীলতিমি বেশ বুদ্ধিমান, তারা নিজেদের মাঝে যোগাযোগের জন্য আলাদা ‘গান’ ব্যাবহার করে।
কিন্তু বুদ্ধিমান প্রাণী তার মাথার ভেতরে চারপাশ পরিবেশের একটা মডেল তৈরি করে। এজন্য বিভিন্ন ইনপুট, স্মৃতি ও শিক্ষা ব্যবহার করে সে। বুদ্ধিমান প্রাণী পরিবেশ থেকে পাওয়া ইন্দ্রিয়বাহিত সংবেদে সরাসরি প্রতিক্রিয়া করে না। তার আচরণগত প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে ইনপুটকে মাথার মধ্যকার মডেল অনুযায়ী সিমুলেশনের উপর। এই সিমুলেশনের মাধ্যমেই সে ঠিক করে নেয় তার উপযুক্ত আচরণ কি হবে। অতীত অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে সে এই মস্তিষ্কপ্রসূত মডেলে প্রয়োজনীয় সম্পাদনাও করতে হয়।
নিসন্দেহে বুদ্ধিদীপ্ত আচরণকে বুঝতে যাওয়া খুব চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। সেটা একটু দুরুহ তো বটেই। বুদ্ধিদীপ্ততা প্রকৃতির অত্যন্ত জটিল পরিকল্পনার ফসল। সব চমকপ্রদ ও সুক্ষ্ম বিষয়গুলোর পেছনের নীতি জটিল হয়। সেই জটিল রহস্য ভেদ করাতেই তো মানুষের আনন্দ। সে আনন্দের পথই তো বিজ্ঞানচর্চা।
তথ্যসূত্র:
১. About Life, Concepts in Modern Biology by Agutter and Wheatley
Leave a Reply to selfish geneCancel reply