এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও শীতসকালে নিশ্চিন্তে খেজুরের রস খাওয়া যেত। এখন আর খাই না, ভয় করে — এখানে নিপাহ ভাইরাস নেই তো? গত কয়েকবছর ধরে প্রতি শীতেই খবরে দেখি নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণে মারা যাচ্ছে কেউ না কেউ। বাদুড়দের প্রিয় খাবার খেজুরের রস। বাদুড়েরা নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক আধার। খেজুরের রসে নিপাহ ভাইরাস সরবরাহ করে বাদুড়ই। বাদুড়েরা নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক আধার। এই ভাইরাসটি বাদুরের কোন ক্ষতি না করলেও মানুষ সহ গৃহপালিত পশুদের আক্রান্ত করে। এই ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুর হার অনেক বেশি, শতকরা ৪০ থেকে ৭৫ ভাগ। একটি ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে কিছুদিন আগে দেখলাম সর্বসাধারণকে খেজুরের রস খেতে নিষেধ করা হচ্ছে! চিন্তা করে দেখুন এই মাঘ মাসের সকাল বেলা কি খেজুরের রস নিষেধ করার মতো বেরসিক কারবার ভালো লাগে?
জীবনের একক হলো কোষ। আর এই কোষ কখন কি করবে ইত্যাদি যাবতীয় নির্দেশনা লেখা থাকে এর ডিএনএ-তে। ভাইরাসকে আমরা জীবিত বলি না। কারণ ভাইরাসের কোষ নেই — রয়েছে কেবল বংশগতিয় উপাদান। এই বংশগতিয় উপাদান হতে পারে ডিএনএ অথবা আরএনএ। ভাইরাসেরা সাধারণত নিষ্ক্রিয় থাকে – কেবলমাত্র অন্যকোন জীবিত কোষের মধ্যেই তারা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। প্রতিটি ভাইরাসের থাকে নিজস্ব গোপন মিশন, তা হলো পরজীবীর মতো অন্য কোষকে ব্যাবহার করে নিজেদের সংখ্যা বাড়ানো। এই মিশন সফল হলে কোন কোন ক্ষেত্রে কোষ নষ্ট হয়ে যায়, কখনো কখনো নষ্ট না করেই চারপাশের অন্যান্য কোষকে আক্রমণ করে। আমাদের এক শিক্ষক বলতেন, মানুষের চারপাশে বিভিন্ন ভাইরাস মেঘের মতো করে ছড়িয়ে থাকে। তারপরেও সব ভাইরাস আমাদের আক্রমণ করে না। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস বিভিন্ন ধরনের পোষক কোষকে আক্রমণ করে। একেকটা ভাইরাসের পোষক কোষ ভিন্ন। যে ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে, তা আমাদের আক্রমণ করবে না। একমাত্র রক্তের মাধ্যমেই জলাতঙ্কের ভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে। খাবারের সাথে এই ভাইরাস খেলে মানুষের কিছু হবে না (যদি না পেটে আলসার থাকে)।
ভাইরাসের জগতটা বড় অদ্ভুত কান্ডকারখানায় ভরপুর। ভাইরাস যেসব প্রাণীদের যে নির্দিষ্ট ধরনের কোষকে আক্রমণ করতে পারে তাদের বলে পোষক। এইচআইভি ভাইরাসের পোষক কেবল মানুষ। টিটু ব্যাক্টেরিয়াফায কেবল সুনির্দিষ্ট ধরনের ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করবে। আবার কারো কারো পোষক অনেক রকমের হতে পারে। কয়েকবছর আগে বিশ্বব্যাপী সোয়াইন ফ্লুর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো মনে আছে?সোয়াইন ফ্লু আসলে একধরনের ইনফ্লুয়েন্জা ভাইরাস। আমাদের মাঝে মাঝে ফ্লু জনিত ঠান্ডা লাগে। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসটি একই সাথে শূকর, পরিযায়ী পাখি আর মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। জলাতঙ্কের র্যাবিস ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে কুকুর থেকে মানুষকে। কিন্তু মানুষ থেকে অন্য কোন প্রাণীকে এই ভাইরাসটা আক্রমণ করতে পারে না।
উপরে এতো কথা বলার কারণ কিন্তু একটাই – ভাইরাস কেবল পোষকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সে সব ধরনের পোষককেই ব্যবহার করার চেষ্টা করে। ফলাফল নানা রকমের রোগ। যেমন নিপাহ ভাইরাসের ক্ষেত্রে এনসেফালাইটিস। বাদুড় নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার। বাদুড় যে স্তন্যপায়ি পোষকে সেটা তো পরিস্কার। অন্যান্য পোষকেরা হলো গবাদিপশু এবং অবশ্যই মানুষ। দেখা গেছে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে মানুষ সহ অন্যান্য গবাদিপশু মারা গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাদুড়েরা কিন্তু এই ভাইরাসে মারা যায় না! তাদের এনসেফালাইটিসও হয় না। কিন্তু, এরকমটাতো হওয়া উচিত না। বাদুর, গবাদিপশু, মানুষ সবাই স্তন্যপায়ী। সবার দেহের শারীরবৃত্তীয় রসায়ন খুবই কাছাকাছি। মানুষ বা গবাদিপশুর মতো বাদুড়ের দেহেও নিপাহ ভাইরাস বেঁচে থাকছে, সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। এই প্রশ্নটা বেশ কয়েকবছর ধরে অনুজীববিজ্ঞানীদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো। সম্প্রতি এর একটি উত্তর মিলেছে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হলো সে উত্তর সম্পর্কে আগ্রহী পাঠককূলকে আলোকিত করা। তার আগে বাদুড় সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া মন্দ হবে না, কি বলেন?
পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যতগুলো প্রজাতী আছে, তার চারভাগের এক ভাগই হলো বাদুড় জাতীয়। বাদুড়ই হলো একমাত্র স্তন্যপায়ী যারা উড়তে পারে। এরা একসাথে থাকতে পছন্দ করে। বাদুড়রা বেশিরভাগই পোকামাকড় খেয়ে বাঁচে। একটি বাদুড় দৈনিক দুই থেকে ছয় হাজার পোকামাকড় খায়। এবং এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মশা। উড়াউড়ির কাজে অনেক শক্তি প্রয়োজন হয়। তাই বাদুড়ের শারীরবৃত্তীয় রসায়ন খুব দ্রুত কাজ করে। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই আম কিংবা কলা হজম করে ফেলে এরা। যদিও বাদুড়ের মুখ দেখতে খানিকটা ইঁদুর প্রজাতির মতো, কিন্তু বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইঁদুরের চাইতে এরা বরং মানুষের কাছাকাছি। মানুষ রাডার আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই বাদুড় প্রতিধ্বনী ব্যাবহার করে চলাচল করে। বাদুড় ২০ থেকে ৩০ বছর বাঁচে। লক্ষ্য করুন এই জীবনদৈর্ঘ্য বেড়াল-কুকুরের চাইতেও বেশি। নিপাহ ভাইরাস ছাড়াও ভয়াবহ সার্স ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাসের পোষক বাদুরেরা। কিন্তু নিপাহ ভাইরাসের মতোও এ ভাইরাসগুলো কোন রোগ তৈরি করে না বাদুরের দেহে। বাদুড়ের দেহে এমন কী আছে যা তাদেরকে আলাদা করেছে অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের থেকে?
কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা দুই প্রজাতীর বাদুরের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন। বলে রাখা ভালো, জিনোম মানে হলো কোন জীবের দেহে থাকা সম্পূর্ণ ডিএনএ। আর সিকোয়েন্সিঙ হলো ডিএনএ-র অনুক্রমটা জানার প্রক্রিয়। বাদুড়ের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা উপরের রহস্যের মনোরম সমাধান পেয়েছেন।
উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর শক্তি। কোষের মাঝে প্রচুর শক্তি উৎপাদনের সময় বিভিন্ন সক্রিয় রাসায়নিক অণু (ফ্রি ড়্যাডিকেল) তৈরি হয়। এই সক্রিয় রাসায়নিক অণুগুলো খুবই ক্ষতিকর – বিশেষ করে ডিএনএর জন্যে। সব উন্নত জীবকোষে এইসব সক্রিয় রাসায়নিক অণু নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার ব্যাবস্থা আছে। বাদুড়ের দেহেও কিছু প্রোটিন এই নিষ্ক্রিয়করণ কাজটি করে থাকে। পাশাপাশি, বাদুড়ের এই প্রোটিনগুলোর আরেকটি বিশেষত্ব আছে। তা হলো এরা ক্ষতিগ্রস্থ ডিএনএ মেরমত করতে পারে। যার কারণে বাদুরেরা অনেক বছর সুস্থভাবে বাঁচে।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। সকল উন্নত প্রাণীরই অনাক্রম্যতা বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে। যখন মানুষ সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ীরা ভাইরাসের সংক্রমণে মারা যাওয়ার সময় দেখা যায় সাইটোকাইন ঝড় নামক প্রতিক্রিয়ার উপস্থিতি। এই সাইটোকাইন ঝড় আসলে স্তন্যপায়ীদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থারই একটি অংশ। কিন্তু ভাইরাস ধ্বংশ করতে গিয়ে এরা হিতে বিপরীত করে ফেলে। বাদুড়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় ওদের জিনোমে কিছু কিছু জিন অনুপস্থিত। এই জিনগুলো সাধারণত সাইটোকাইন ঝড় চালু করে দেয়ার কাজ করে। ভাইরাসের সংক্রমণে যেহেতু বাদুড়েরা সাইটোকাইন ঝড়ের মুখোমুখি হয় না, ওদের অনাক্রম্যতা হিতে-বিপরীতও করে ফেলে না।
মানুষের নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোন চিকিৎসা নেই। তবে বিজ্ঞানীরা বাদুড়কে পর্যবেক্ষণ করে নতুন আশার আলো দেখতে পেরেছেন। যদি মানুষের সাইটোকাইন ঝড়ের জন্য দায়ী জিনগুলোকে অকার্যকর করে দেয়া যায়, তাহলে বাদুড়ের মতোই মানুষও বেঁচে যাবে মৃত্যু থেকে। আগামীর গবেষণাই কেবল এই সম্ভাবনাকে যাচাই করতে পারে।
Ref: http://blogs.discovermagazine.com/80beats/?p=41984#.UP2Lkfl93eT
Leave a Reply