জীবজগতে মিথস্ক্রিয়া বা সম্পর্ক নির্মাণের এক অনন্য পদ্ধতি হল সিমবায়োসিস (অন্যোন্যজীবিতা/মিথজীবিতা)। এমনকি সিমবায়োসিসের মাধ্যমে জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখারও উদাহরণও অনেক। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি অদ্ভুত সিমবায়োসিস এর গল্প আজকে বলছি।
সিমবায়োসিস হল এমন একটা পদ্ধতি যেখানে দুইটা জীব বেঁচে থাকার জন্য একে অপরকে সাহায্য করে। মাঝেমধ্যে একটা জীব আরেকটা জীবের ভেতরে থেকে সিমবায়োসিস এ অংশগ্রহণ করে। কিন্তু লেবুর গাছের মিলিবাগ পোকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমনই অনন্য যে প্রায় অন্য কোন ক্ষেত্রেই এমন দেখা যায়না।
মাঝেমাঝে লেবু গাছে লক্ষ্য করলে দেখবেন ছোটছোট সাদা সাদা পোকায় ভরে গেছে। এগুলো হলো মিলিবাগ পোকা। এই মিলিবাগ পোকা লেবু গাছের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু এই রস থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বের করে আনার জন্য ব্যবস্থা পোকাটির শরীরে নাই। সেজন্য সে Tremblaya princeps নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়ার শরণাপন্ন হয়। কিন্তু মজার বিষয় হল এই ব্যাকটেরিয়াও নিজে সবটুকু কাজ করতে পারেনা, বরং এরও সাহায্য দরকার। তাহলে উপায় কি?
আসলে Tremblaya princeps ব্যাকটেরিয়া গাছের রস থেকে এমিনো এসিড তৈরির একটা অংশ করে, তারপর সেটা আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাকটেরিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়। ব্যাকটেরিয়াটির নাম, Moranella endobia। Moranella endobia ব্যাকটেরিয়া আবার Tremblaya princeps ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে থাকে। এই দুই ব্যাকটেরিয়ার কোনটাই নিজে নিজে লেবু গাছের রস থেকে নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এমিনো এসিড তৈরি করতে পারেনা, সেই জৈবরাসায়নিক পদ্ধতি তাদের নেই। একজনের নির্ভর করতে হয় আরেকজনের উপর। তাহলে ব্যাপারটা হল মিলিবাগ পোকা দুইটা ব্যাকটেরিয়ার উপর যেমন খাদ্যের জন্য নির্ভর করে, তেমনি Moranella কে বাসস্থান দেয়ার জন্য Tremblaya কে পালে নিজের ভেতর। মিলিবাগ পোকা ছাড়া Tremblaya বেঁচে থাকতে পারেনা।
ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য এখানে আরেকটা ত্রি-সিমবায়োসিস এর উদাহরণ টানছি। এই জিনিসটা ঘটে আমাদের অতি পরিচিত উঁই পোকার মধ্যে। মাঝেমধ্যে উঁই পোকার জ্বালাতনে বাসার আসবাবপত্র, কাগজ টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে যায়। গাছ বা কাগজে আছে সেলুলোজ নামে একধরনের উদ্ভিজ্জ শর্করা। কিন্তু উঁই পোকা এই সেলুলোজকে নিজে নিজেই ভাঙতে পারেনা। তবে উপায় কি? ব্যাপার সেই একই। উঁই পোকার পেটের ভিতরে আছে একধরনের প্রোটোজোয়া (এককোষী প্রাণী, ছবিটি দেখুন)। কাঠের টুকরো গুলিকে সেলুলোজে ভেঙে প্রোটোজোয়াকে দেয় উঁই পোকা। সেই সেলুলোজকে ছোট শর্করা- শুগারের পরিনত করে প্রোটোজোয়া। কিন্তু প্রোটোজোয়ার জন্য দরকার এমিনো এসিড। সেজন্য প্রোটোজোয়া দ্বারপ্রার্থী হয় একধরনের ব্যাকটেরিয়ার। যেটা সুগার নেয় প্রোটোজোয়ার কাছ থেকে। আবার এমিনো এসিডগুলি উঁইপোকার দেহেও যায়। বিনিময়ে উঁইপোকা নাইট্রোজেন এবং প্রোটোজায়ার মত বাসস্থান দেয় ব্যাকটেরিয়াকে। কি চমৎকার মিথষ্ক্রিয়া, তাইনা? অনেকটা একইরকম ব্যাপার ঘটে লেবুর মিলিবাগ পোকার ক্ষেত্রেও।
কিন্তু এখানেই কি গল্পের শেষ? না- Tremblaya ব্যাকটেরিয়া অন্য একটা দিক দিয়ে অনন্য। এর জেনোম হচ্ছে জীবজগতের সবচে ছোট্ট জেনোম, মাত্র ১২১ টা জিন আছে এতে। তুলনা করতে সুবিধার জন্য এখানে বলে রাখি, মানুষের জিন আছে প্রায় ২১,০০০, আরেকধরনের ব্যাকটেরিয়া ই. কলাই তে আছে প্রায় ৪২০০। কোন জীবই Tremblaya এর মত এত কম সংখ্যক জিন নিয়ে নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারেনা। Tremblaya বেঁচে আছে কারন এটা পোকার সঙ্গে সিমবায়োটিক সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং ফলে অপ্রয়োজনীয় জিনগুলি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। আবার আরেকটি ব্যাকটেরিয়া- Moranella সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় যাওয়ার কারনে আরও কিছু জিন সে বাদ দিতে পেরেছে জেনোম থেকে।
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা এই ত্রি-সিমবায়োটিক সম্পর্কের মধ্যে যে জিনিসটা খুঁজে পাই সেটা হল একটা কোষের অর্গানেল তৈরি হওয়ার মধ্যবর্তী অবস্থা। অর্গানেল হল কোষের ভিতরে বিভিন্ন গাঠনিকভাবে স্বতন্ত্র অঙ্গাণু, যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, প্লাস্টিড ইত্যাদি। এসব অঙ্গাণুর নিজস্ব ডিএনএ আছে, এরা নিজে নিজেই নির্দিষ্ট কাজ করে, কিন্তু কোষের বাইরে কোন জৈবিক অস্তিত্ব নাই। আমাদের দেহকোষে আছে মাইটোকন্ড্রিয়া, যা কোষকে শক্তি দেয়। এদের ডিএনএ টি প্রাক, অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার মত। সেজন্য ভাবা হয় বহুকোষী জীবের বিবর্তনের শুরু দিকে কোন কোষ একটি ব্যাকটেরিয়াকে নিজের ভেতর রেখে দেয়ায় সেটা পরে মাইটোকন্ড্রিয়া হয়ে গিয়েছে।
কি, মিল খুঁজে পাচ্ছেন এখনকার এই মিলিবাগ, Tremblaya এবং Moranella সিমবায়োটিক সম্পর্কের সঙ্গে?
সূত্রঃ
http://www.pnas.org/content/early/2013/06/12/1305813110.short
http://www.rikenresearch.riken.jp/eng/frontline/6132
Leave a Reply