অ্যান্টনি ফন লিউয়েনহুক, প্রকৃতিবিজ্ঞানের ছাত্র আর সেই সাথে বস্ত্র ব্যবসায়ী। কাপড় পরীক্ষার সূত্রেই অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাথে পরিচয় ২১ বছর বয়সী তরুণের। আর সেই পরিচয় ভালবাসায় পরিণত হতে সময় নিয়েছে খুব কমই । একটা সময় এই অনুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরিই তাঁর নেশা হয়ে পড়ল। তাঁর তৈরি এই অনুবীক্ষণ যন্ত্রগুলো আগের যে কোন যন্ত্রের চেয়ে ২০০ থেকে ৫০০ গুণ বেশি বড় করে দেখাতে পারত যে কোন কিছুকেই।
একদিন হঠাৎ খেয়ালের বশে পুকুর থেকে পানি নিয়ে সেটিকে তাঁর অনুবীক্ষণ যন্ত্র দেখতে শুরু করলেন ।১৬৭৪ এ তিনি দেখতে পেলেন প্রোটোজোয়া আর ১৬৭৭ সালে আবিষ্কার করলেন ব্যাকটেরিয়া আর এই সবই তিনি আবিষ্কার করেছেন তার মুখের লালা, বৃষ্টির পানি, দাঁত থেকে নেওয়া নমুনা আর তাঁর নিজের মলে ।প্রোটোজোয়া আর ব্যাক্টেরিয়ার নাম স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জানা ছিলনা। তিনি এদের নাম দিলেন ‘অ্যানিম্যাল্কিউলস’ বা ছোট্ট প্রাণী। রবার্ট হুকের লেখা বই “মাইক্রোগ্রাফিয়া” থেকে তিনি কোষ সম্পর্কে কিছু ধারণা আগেই পেয়েছিলেন আর তা সম্বল করেই তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণে দেখতে পাওয়া খুঁদে প্রাণের ছবি আর বর্ণনা লিখে পাঠান রয়েল সোসাইটি-তে। প্রথমে যদিও রয়েল সোসাইটি স্বীকৃতি দিতে নারাজ ছিল যে আসলেই এক নতুন সম্ভাবনার ভান্ডারের সন্ধান পাঠিয়েছেন লিউয়েনহুক,পরবর্তিতে আরো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁরা তা মেনে নেন। লিউয়েনহুক হয়তো নিজেই জানতেন না কোন নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি মানব জ্ঞানের জগতকে আর কত নতুন আশা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে । তবে জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা জানিয়ে গেছেন রয়েল সোসাইটিতে লেখা তাঁর কিছু চিঠিতে। এমনই একটি চিঠির কিছু কথা ছিল এমন- “আমার সকল কাজ আমি আজ যে প্রশংসা উপভোগ করছি সেই প্রশংসার টান থেকে নয় বরং জ্ঞানার্জনের প্রতি প্রচন্ড মোহ থেকেই করেছি ,যে মোহ আমার সময়ের অনেক মানুষের চেয়ে আমার ভেতর আছে অনেক বেশি পরিমাণে। তাই যখনই কোন উল্লেখযোগ্য কিছু আমার নজরে এসেছে আমি তা লিপিবদ্ধ করে রাখা আমার কর্তব্য বলে মনে করেছি যেন আমার পরে পৃথিবিতে আসা প্রতিভাধরেরা এইসবে অবহিত থাকতে পারে।”
সময়কাল ১৭৯৬। লিউয়েনহুকের আবিষ্কারের পর আরো শ’খানেক বছরেরও বেশি বুড়িয়ে গেছে পৃথিবী। সে তখনো ধুঁকছে জীবননাশী সব মহামারিতে। দাঁত কেলানো হাসিতে তাকে বধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত সব ভাইরাস আর ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত ব্যাধি। গুটিবসন্ত এদেরই একজন। মানব জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া এই ভাইরাসঘটিত রোগ পুরো মানব জাতিকে ভয়ে তটস্থ করে রেখেছিল দীর্ঘ সময়জুড়ে। একবার এর বিষাক্ত ছোঁয়া বেশিরভাগ হতভাগাকেই মৃত্যুর শীতল হাতে সোপর্দ না করে রেহাই দিতনা আর আক্রান্ত ও মৃতের তালিকায় শিশুরাই থাকত সবার সামনের সারিতে । সেই সময়েই মানুষের জন্যে সবচেয়ে বড় উপহারটি নিয়ে হাজির হলেন ইংরেজ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার। গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করে তিনি পৃথিবীতে বইয়ে দিলেন স্বস্তির বাতাস ।আর সেই টিকাদানের প্রেক্ষিতেই বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দিয়েছে যে পৃথিবীতে গুটিবসন্ত বলতে আর কোন রোগ নেই ! বলা হয়ে থাকে জেনারের এই আবিষ্কার অন্য যে কোন আবিষ্কারের তুলনায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।
সময়কাল ১৮৫০। ইউরোপ এবং আমেরিকার হাসপাতালে সন্তান জন্মদানকারি মায়েরা কিছুদিনের মধ্যেই আক্রান্ত হচ্ছেন চাইল্ডবেড ফিভার-এ। প্রয়োজনীর ডাক্তারি সেবা পাওয়ার পরও মাতৃ-মৃত্যুহার ঠেকানো যাচ্ছেনা কোনভাবেই। ২৫-৩০ শতাংশ মা আক্রান্ত হচ্ছেন সন্তান জন্মদান পরবর্তি সময়ের জ্বরে আর মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন অচিরেই। ভিয়েনার এমনই একটি হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডের সহকারি হিসেবে চাকুরি করতেন হাঙ্গেরিয়ান ডাক্তার ইগনাজ সেমেলওয়েইজ। তিনি লক্ষ্য করলেন,যে প্রসব-ঘরে মেডিকেল ছাত্রদের উপস্থিতি বেশি থাকত সেখানে মাতৃ-মৃত্যুহার যে ঘরে ধাত্রীদের দিয়ে প্রসব করানো হত তার তুলনায় তিন গুনেরও বেশি। সত্যি বলতে কি , হবু মায়েরা প্রসব-ঘরে মেডিকেল ছাত্রদের উপস্থিতিতে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ত সে সময় ।মেডিকেল ছাত্ররা লাশ কাটাছেঁড়া করে এসেই প্রসব ঘরে হাজির হতেন যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা না মেনেই। সেমেলওয়েইজ ধারণা করলেন এরাই হয়তো কোন জীবাণু বয়ে নিয়ে আসছেন যা ইনফেকশান এর কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে আর মাতৃ-মৃত্যু হার ঠেকানোকে অসম্ভব করে তুলছে। তিনি তাই প্রস্তাব দিলেন ডাক্তার এবং মেডিকেল ছাত্ররা হবু মাতাকে পরীক্ষার আগে যেন ক্লোরিনযুক্ত পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এর পর তাঁর ওয়ার্ডে মাতৃ-মৃত্যু হার কমে ১ শতাংশেরও নিচে নেমে এল! আর তাঁর অনুমানও ঠিক বলে প্রমাণিত হল যখন প্রমাণিত হল যে ইনফেকশান ঘটাচ্ছে Streptococcus pyogens নামের ব্যাক্টেরিয়া। সেই সাথে জীবাণু-ই যে রোগ ঘটানোর জন্যে দায়ী সেটাও আলোচনায় আসতে থাকল যদিও তখন পর্যন্ত তা শুধুই কিছু দূরদর্শী মানুষের চিন্তাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে আর সেমেলওয়েজ সেই অগ্রদূতদেরই একজন।
সময়কাল ১৮৬১। বিতর্ক জমে উঠেছে অনুজীবের অস্তিত্ব কিভাবে ঘটে সেটা নিয়ে। কেউ বলছেন জড় বস্তু থেকে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নতুন প্রাণের উদ্ভব ঘটে আর অনুজীবের ক্ষেত্রেও সেটাই সত্যি। আবার আরেক দল বলছেন জীবন থেকেই নতুন জীবন তৈরি হয়; জড় বস্তু থেকে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নয়। প্রথম দল তাঁদের উপস্থাপনার পক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করল পঁচা মাংস থেকে মাছি, ঘামে ভেজা ধান থেকে ইঁদুর,ভেজা মাটি থেকে সাপ আর ব্যাঙ এর উদ্ভব দিয়ে। তাঁদের চিন্তাকে অসার প্রমাণ করতে কাজ করে গেছেন ফ্রান্সেস্কো রেডি, ল্যাজারো স্প্যালাঞ্জানি আর রুডলফ ভিরচৌ এর মত বিজ্ঞানীরা। আর ভুলে ভরা এই তত্ত্বে মরণ কামড় বসালেন ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। হাঁসের ঘাড়ের মত বাঁকানো নলযুক্ত ফ্লাস্কে মাংসের ঝোল নিয়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করে তিনি দেখিয়ে দিলেন যে কখনোই জড় বস্তু থেকে জীবের উদ্ভব সম্ভব নয় আর তাঁর এই পরীক্ষাই কালের কৃষ্ণ-গহবরে ছুড়ে ফেলল ‘স্বতঃস্ফুর্ত জন্ম’ মতবাদকে ।
লুই পাস্তুর ছিলেন একজন রসায়নবিদ আর কাজের অংশ হিসেবেই গাঁজন নিয়ে পরীক্ষায় তিনি দেখতে পান যে অনুজীব-ই গাঁজনের জন্যে দায়ী। এছাড়াও পাস্তুর জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি ‘পাস্তুরিকরণ’ বা ‘পাস্তুরাইজেশান’ আবিষ্কার করেন। মানবজাতির প্রতি তার অনন্য অবদানের আরেকটি হচ্ছে র্যাবিস ভ্যাক্সিন বা জলাতংকের টিকা। এছাড়াও মুরগীর কলেরা আর অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কার করেন তিনি। অণুজীববিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অবদানের কারণে পাস্তুরকে অনুজীব বিজ্ঞানের অন্যতম জনক বলা হয়ে থাকে। (অসমাপ্ত)
Leave a Reply