আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হাজার রকমের মিথ (myth) এবং এগুলোর একটি বিশাল অংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত। এগুলোর কিছু কিছু এতোটাই প্রচালিত যে এমনকি বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতেও সেগুলো ছড়িয়ে আছে সমান ভাবে। সেই মিথগুলোর যুক্তিখন্ডন এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যই এই সিরিজটির অবতারণা করা হয়েছে। এখানে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মিথ বা অপব্যাখ্যার প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে।
১১. মার্কনি রেডিও উদ্ভাবন করেছেন / জগদীশ বসু রেডিও উদ্ভাবন করেছেন
মার্কনি রেডিও উদ্ভাবন করেনি এবং ইতিহাসে তাঁকে রেডিওর উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াও হয় নি। প্রকৃতপক্ষে রেডিও কোনো ব্যক্তি এককভাবে উদ্ভাবন করেন নি। মার্কনির নাম এমন কি রেডিও উদ্ভাবকদের তালিকাতেও নেই। রেডিও আবিষ্কার নিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসুকে জড়িয়ে বাঙ্গালির হা-পিত্যেসও যুক্তিযুক্ত নয়। রেডিও উদ্ভাবনের পিছনে একডজনেরও বেশী গবেষকের অবদান রয়েছে। এই গবেষকদের তালিকায় জগদীশ বসুর নামও ইতিহাসে লেখা আছে। তবে তিনি কখনো তাঁর কাজের প্যাটেন্ট করতে উৎসাহী ছিলেন না। কাজেই মার্কনি জগদীশ বসুর রেডিওর উদ্ভাবণ নিজের নামে চালিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন কথাটা আসলে মোটেও ঠিক নয়। বরং যদি কেউ সত্যিই বঞ্চিত হয়ে থাকেন তিনি হচ্ছেন অলিভার লজ। রেডিওর উদ্ভাবকদের তালিকায় শেষের দিকেই তাঁর নাম। তিনি রেডিওকে যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর উদ্ভাবন তিনি কাজে লাগিয়ে যেতে পারেন নি। মার্কনি মূলত রেডিওর বাণিজ্যীকিকরণ করেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের হাতে রেডিও পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি প্রথমবারের মতো রেডিওতে সম্প্রচার শুরু করেছিলেন। রেডিও উদ্ভাবনের পিছনে অবদান রাখা বিজ্ঞানীদের তালিকা পাবেন এই উইকিপিডিয়া আর্টিকেলে ।
সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Guglielmo_Marconi
১২. জিহ্বার একেক অংশ একেক ধরনের স্বাদের অনুভূতি তৈরি করে
একসময় এই ধরনের তত্ত্ব দেওয়া হযেছিলো যে, জিহ্বার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের taste bud বা স্বাদ গ্রন্থি থাকে। যেমন: জিহ্বার অগ্রভাগে মিষ্টি, শেষভাগে টক এবং দুই পাশে যথাক্রমে নোনতা ও তিক্ততা স্বাদের গ্রন্থি থাকে (চিত্র অনুযায়ী)। প্রকৃত সত্যি হচ্ছে, জিহ্বার প্রতিটি অংশেই সবধরনের স্বাদগ্রন্থি মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। এবং মানুষ জিহ্বার সব অংশেই সবরকম স্বাদ নিতে পারে। তবে স্বাদগ্রন্থির ঘনত্ব জিহ্বার কোনো অংশের চেয়ে কোনো অংশে কম বেশী হতে পারে এবং একই স্বাদগ্রন্থি ও জিহ্বার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিমানে থাকতে পারে এবং সেই কারনে স্বাদেরও তারতম্য ঘটতে পারে কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে স্বাদগ্রন্থির পার্থক্য তৈরি হতে পারে। এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিলো ১৯০১ সালে যখন একটি জার্মান গবেষণাপত্রকে ইংরেজিতে ভুলভাবে অনুদিত করা হয়। মূল আর্টিকেলটি সহজবোধ্য ছিলো না এবং বিভিন্ন তথ্যও অস্পষ্ট ছিলো। মূল ছবিতে জিহ্বার যেই ম্যাপ দেখানো হয়েছিলো তাতে স্বাদের পার্থক্য বোঝানো হয় নি বরং স্বাদ সৃষ্টির জন্য ন্যুনতম পরিমানের ম্যাপ দেখানো হয়েছিলো।
সূত্র: ১. https://en.wikipedia.org/wiki/Tongue_map
২. http://www.nytimes.com/2008/11/11/health/11real.html?_r=1
১৩. না খেয়ে থাকলে আমাদের ওজন কমে
কথাটা আংশিক সত্য কিংবা স্বল্প মেয়াদের জন্য সত্য। দীর্ঘ মেয়াদে এটা ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী হতে পারে। আমরা যদি না খেয়ে থাকি কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণ করি তাহলে শরীর ক্যালরি যোগানোর জন্য শুধু চর্বিই ক্ষয় করে না বরং মাংসপেশী তথা প্রোটিনেরও ক্ষয় হতে থাকে। আর আমাদের ক্যালরির চাহিদা আসে মূলত শরীরের বিভিন্ন মেটাবলিক কর্মকান্ড থেকে। শরীর গঠিত হয় প্রোটিন দিয়ে। যদি প্রোটিন কমে যায় তাহলে মেটাবলিক কর্মকান্ড জনিত ক্যালরির চাহিদাও কমে যায়। ফলে আমরা এসময় ক্যালরি যদি তুলনামূলকভাবে কমও গ্রহণ করি সেটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশী হতে পারে। যা পরে চর্বি হিসেবে শরীরে জমে যেতে পারে। সঠিকভাবে ওজন কমানোর জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে খেতে হবে। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত ও সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার কমিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
সূত্র: http://www.netdoctor.co.uk/womenshealth/features/dietmyths.htm
১৪. আইনস্টাইন স্কুল জীবনে গণিতে ফেল করতেন
আইন্সটাইন স্কুল জীবনে কখনোই গণিতে ফেল করেন নি। তিনি গণিতে বরাবরই ভালো ছিলেন এবং সবসময়ই ভালো ফলাফল করেছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি স্কুলের শিক্ষাক্রমের গন্ডি পেরিয়ে নিজে নিজেই বীজগণিত এবং জ্যামিতি চর্চা করতে শুরু করেন। সেই বয়সেই তিনি জ্যামিতির অনেক তত্ত্ব নিজে নিজেই প্রমাণ করেন। এই সময় পীথাগোরাসের উপপাদ্যের প্রমাণের একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেন। ১৫ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ক্যলকুলাসের দুটি মূল ধরা ডিফারেন্সিয়াল এবং ইন্টিগ্রাল আয়ত্ব করে ফেলেন। একসময় তিনি গণিতবিদ হিসেবে পরিচিতিও লাভ করেন। আইনস্টাইনের ফেল হওয়ার মিথ কিভাবে ছড়িয়েছে সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি। “রিপ্লি’স বিলিভ ইট অর নট”ও আইনস্টাইনের ফেলের তথ্য দিয়েছিলো। সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য মতামত অনুযায়ী, আইনস্টাইনের স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ গ্রেডিংএর পদ্ধতি ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। আগে যেখানে ১ থেকে ৬ পর্যন্ত গ্রেড ছিলো এবং ১ দিয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড বোঝানো হতো সেখানে উল্টে দিয়ে ৬ কে সর্বোচ্চ গ্রেডে পরিণত করা হয়। তাঁর শেষ পরীক্ষার নম্বরপত্র দেখে কেউ হয়তোবা বিভ্রান্ত হয়েছিলো।
সূত্র: ১. http://www.todayifoundout.com/index.php/2011/12/albert-einstein-did-not-fail-at-mathematics-in-school/
২. http://physics.about.com/b/2007/09/19/physics-myth-month-einstein-failed-mathematics.htm
১৫. একস্থানে দুইবার বর্জ্রপাত হয় না
একস্থানে দুইবার বর্জ্রপাত হয় না বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বর্জ্রপাতের পুর্বে মেঘে মেঘে ঘষা লেগে মেঘ এবং মাটির মধ্যে বিশাল ভোল্টেজের পার্থক্য তৈরি হয়। ফলে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহের প্রবণতা তৈরি হয় কিন্তু বাতাস বিদ্যুৎ কুপরিবাহী হওয়ায় বিদ্যুৎ পরিবহন সহজ হয় না। ভোল্টেজ একটা নির্দিষ্ট পরিমানের চেয়ে বেশি হলে বাতাসে ব্রেকডাউন ঘটে যার ফলে বাতসের পরমানুর শেষ কক্ষপথ থেকে ইলেক্ট্রন সরে গিয়ে পরিবাহিতা তৈরি হয়। এই ব্রেকডাইনের কারনে বিদ্যূৎ পরিবহন শুরু হয় এবং এসময় যদি আশেপাশে কোনো উঁচু, ভেজা বা ধাতব বস্তু থাকে তাহলে বিদ্যুৎ সেই দিক দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার চেষ্টা করে। এই কারনে বর্জ্র বিদ্যূৎ সাধারণত উঁচু যায়গা যেমন গাছের মাথা, টাওয়ার প্রভৃতিতে আঘাত হানে বেশী। একই স্থানে দুইবার বর্জ্রপাত না হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। প্রতিবছর আমেরিকার এ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং প্রায় শতাধিকবার বর্জ্রাহত হয়। এবং কোনো স্থানে যদি একটি মাত্র উঁচু বস্তু থেকে থাকে বর্জ্রপাত সর্বদাই ওই বস্তুর উপর ঘটার সম্ভবনা বেশী থাকবে।
সূত্র: ১.http://stormhighway.com/lightning_never_strikes_the_same_place_twice_myth.php
২. http://www.accuweather.com/en/weather-blogs/weathermatrix/myth-lightning-never-strikes-twice/19890
Leave a Reply