আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হাজার রকমের মিথ (myth) এবং এগুলোর একটি বিশাল অংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত। এগুলোর কিছু কিছু এতোটাই প্রচালিত যে এমনকি বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতেও সেগুলো ছড়িয়ে আছে সমান ভাবে। সেই মিথগুলোর যুক্তিখন্ডন এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যই এই সিরিজটির অবতারণা করা হয়েছে। এখানে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মিথ বা অপব্যাখ্যার প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে।
৬. উল্কাপিন্ড পতনের সময় বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে যায়।
ভুল! উল্কাপিন্ডের তাপমাত্রার উপর বাতাসের সংঘর্ষের প্রভাব খুব সমান্যই। উল্কাপিন্ড যখন বাতাসের মধ্য দিয়ে যায় তখন তার গতিবেগ থাকে ঘন্টায় কয়েকহাজার কিলোমিটার। উল্কাপিন্ড যখন দ্রুতবেগে এগিয়ে যায় তখন তার সামনের বাতাসে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয় (ram pressure)। আর গ্যাসীয় বস্তুকে চাপদিয়ে সংকুচিত করার চেষ্টা করলে তার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এবং তাতে কেবল উল্কার পৃষ্ঠদেশ উত্তপ্ত হয়। তাছাড়া যে আলো দেখা যায় সেটা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে তৈরি হয় না। বরং বাতাসের অনুর সাথে সংঘর্ষে কলিশন এনার্জী তৈরি হয় যার ফলে উল্কার পৃষ্ঠের ইলেক্ট্রনগুলো উত্তেজিত হয়ে উচ্চশক্তিস্তরে গমনকরে এবং পরে ফোটন নিঃসরণের মাধ্যমে নিন্ম শক্তিস্তরে ফিরে আসে। একই ভাবে ধারনা করা হয় পৃথিবীকে আঘাত করার ফলে উল্কাপিন্ড উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু উল্কাপিন্ড যদি বায়ুমন্ডল পেরিয়ে ভূ-পৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তাহলে দেখা যায় সেগুলো হিমশীতল। এর কারন মাহাবিশ্বের ফাঁকা স্থানে তাপমাত্রা থাকে পরমশুণ্য তাপমাত্রার কাছাকাছি। ফলে এই উল্কাবস্তুগুলোরও তাপমাত্রা থাকে খুব কম। বাতাসের চাপের ফলে বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রার এদের বাইরের আস্তরণ পুড়ে যেতে পারে কিন্তু ভিতরটা তখনো যথেষ্ট ঠান্ডাই থাকে।
সূত্র: ১. http://en.wikipedia.org/wiki/Meteoroid
২. http://www.meteorites.com.au/odds&ends/myths.html
৭. মহাশুন্যে অভিকর্ষ অনুভুত হয় না
নভোচারীদের আমরা মহাশুন্যে ভেসে বেড়াতে দেখি। এতে ধারনা হয় যে মহাশুন্যে পৃথিবীর অভিকর্ষ অনুভুত হয় না। আসলে তা নয়। বরং নভোচারীরা যে উচ্চতায় প্রদক্ষিণ করেন সেখানেও তাঁদের ভূ-পৃষ্ঠের ওজনের প্রায় ৯০% ওজন ক্রিয়ারত থাকে। নভোচারীরা যখন ভূ-পৃষ্ঠ ছেড়ে উপরে উঠে যান তখন তাঁরা পৃথিবীকে দ্রুত গতিতে প্রদক্ষিন করতে থাকেন। এই প্রদক্ষিণরত অবস্থাকে আসলে মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর সাথে তুলনা করা যায়। মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তু ওজন অনুভব করে না। নভোচারী যখন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন তখন কিন্তু তিনি আসলে মুক্তভাবে পড়ছেন। কিন্তু উচ্চগতির কারনে এবং অভিকর্ষের সাথে লম্ববরাবর একটা গতি থাকার কারনে তিনি যখন কিছুটা পড়তে থাকেন একই সময়ে সম্মুখগতি ততটাই তাঁকে পৃথিবী থেকে দুরে সরিয়ে রাখেন, একারনেই তিনি মহাকাশে ভেসে বেড়ান।পাশের ছবিটি দেখলে এই বিষয়ে ধারনা পরিষ্কার হবে। নভোযানের ভিতরে যেসব নভোচারী থাকেন তাঁরাও একই অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
সূত্র: ১. http://amazing-space.stsci.edu/resources/myths/
২. http://www.thecollapsedwavefunction.com/2013/03/science-myths-and-misconceptions-part.html
৮. মাথায় আপেল পড়ার ঘটনা থেকে নিউটন মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেন
নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার ঘটনা থেকে তিনি মহাকর্ষসূত্র আবিষ্কার করেন নি। এবং তাঁর সকল নোটপত্র ঘেঁটেও কখনো কোনো আপেলের বর্ণনা পাওয়া যায় নি। বরং তিনি দীর্ঘদিন থেকে মহাকর্ষ নিয়ে ভেবেছেন, ভেবেছেন কেন কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে সেটা নিচের দিকেই নামে, উপরের দিকে উঠে যায় না। কোনো বস্তুকে শুন্যে ছেড়ে দিলে সেটা যে মাটিতে এসে পড়ে সেটা প্রত্যেক মানুষই পর্যবেক্ষণ করেন। সৃ্ষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ দেখে আসছে কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে সেটা নিচে পড়ে যায়। নিউটনের মাথায় যদি আপেল পড়েও থাকে তাহলেও সেটা নিশ্চয়ই তাঁর জন্য নতুন ঘটনা ছিলো না। এর আগেও তিনি বিভিন্ন বস্তুকে নিচে পড়তে দেখেছেন। নিউটন এতটা নির্বুদ্ধি ছিলেন না যে একদিন হঠাৎ একটি আপেল পড়ায় তাঁর মনের হলো আপেল নিচে নামল কেন? আপেল উপরে উঠে গেল না কেন? প্রকৃত যে ঘটনাটি ঘটেছিলো বলে সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য তা হচ্ছে তিনি কোনো এক আলোচনায় মহাকর্ষসূত্রটি বোঝাছিলেন। সেই আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি আপেল গাছ থেকে আপেল পড়ার উদাহরন টেনে আনেন। তিনি ব্যখ্যা করেন এভাবে “আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম কেন আপেল গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়ে ………..”। এই শেষোক্ত ঘটনাটির বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর এক বন্ধুর লেখা নোট থেকে।
সূত্র: http://thesoftanonymous.com/2013/06/06/newtons-apple-fact-or-fiction/
৯. চীনের প্রাচীর একমাত্র মানবসৃষ্ট বস্তু যেটা চাঁদ থেকেও দেখা যায়
মানবসৃষ্ট কোনো বস্তুই চাঁদ থেকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। দৈর্ঘ্য যা-ই হোক না কেন একটা নির্দিষ্ট পরিমান প্রস্থ না থাকলে সেই জিনিসকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যাবে না। যেমন: চুল। আমরা যদি একটি লম্বা চুল নিয়ে সেটাকে দূর থেকে দেখার চেষ্টা করি তাহলে চুলের দৈর্ঘ্য যথেষ্ট বেশী থাকা সত্ত্বেও সেটা সরু হওয়ায় আমরা দেখতে পাব না। হিসেব করে দেখা যায় চাঁদ থেকে যদি পৃথিবীর কোনো বস্তুকে দৃষ্টিগোচরে আনতে হয় তাহলে তার মাত্রা হতে হবে অন্তত ৭০ মাইল বা ১১০ কিলোমিটার। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের যেকোনো একটিতে যদি এর চেয়ে পরিমান কম হয় তাহলে সেই বস্তুটিকে চাঁদ থেকে সনাক্ত করা যাবে না। চীনের প্রাচীর যদিও দৈর্ঘ্যে যথেষ্ট লাম্বা কিন্তু এটি প্রস্থে মাত্র ৩০ ফুট। সেই হিসেবে চীনের প্রাচীরের চেয়ে আরো অনেক বেশী যোগ্যতা সম্পন্ন মানবসৃষ্ট বস্তু আছে যেগুলো ৩০ ফুটের চেয়ে অনেক অনেক বেশী চওড়া। ৭০ মাইল চওড়া হতে হলে ১২০০০ টিরও বেশী চীনের প্রাচীরকে পাশাপাশি যুক্ত করতে হবে।
সূত্র: http://www.scientificamerican.com/article.cfm?id=is-chinas-great-wall-visible-from-space
১০. বাদুড়ের চোখ আছে কিন্তু চোখে দেখে না
বাদুড়ের চোখ আছে এবং সে চোখে দেখতে পায়। তবে বেশ কিছু প্রজাতির দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ।এছাড়া কিছু কিছু প্রজাতি অতিবেগুনী রশ্মিও সনাক্ত করতে পারে। এরা কাছাকাছি দুরত্বে অপেক্ষাকৃতি সঠিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য শব্দযোগাযোগ (echolocation) ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু দুরবর্তী বস্তু সম্বন্ধে নির্দেশনা পাওয়ার জন্য চোখই ব্যবহার করে। তাছাড়া কিছু কিছু প্রজাতি শব্দযোগাযোগ ব্যবহার করে না এবং কিছু কিছু প্রজাতি অন্ধকারেও বেশ ভালো দেখতে পায়।
Leave a Reply