crop female future teller with tarot cards on table

ভুল সবই ভুল: বৈজ্ঞানিক অপব্যাখ্যা এবং সেগুলোর খন্ডন-৪

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হাজার রকমের মিথ (myth) এবং এগুলোর একটি বিশাল অংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত। এগুলোর কিছু কিছু এতোটাই প্রচালিত যে এমনকি বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতেও সেগুলো ছড়িয়ে আছে সমান ভাবে। সেই মিথগুলোর যুক্তিখন্ডন এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যই এই সিরিজটির অবতারণা করা হয়েছে। এখানে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মিথ বা অপব্যাখ্যার প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে।

(তৃতীয় পর্বের লিংক )

১৬. হিগস বোসন আবিষ্কারের পিছনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় নি

bose


“হিগস বোসন” শব্দটির বোসন অংশটুকু বাঙ্গালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে নামকরন করা হয়েছে। কিন্তু এই নামকরণের সাথে ‘হিগস’ কণাটির আসলে কোনো সম্পর্কই নেই। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কিছু সাবএটমিক পার্টিকেলের বৈশিষ্ট্যসূচক পরিসংখ্যান তত্ত্বের প্রবক্তা যা পরে বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে কিছু কনিকা আবিষ্কৃত হয় যেগুলো তাঁর প্রণীত তত্ত্ব মেনে চলে। তাঁর প্রতি সম্মান রেখে এই কণিকাগুলোকে বোসন নাম দেওয়া হয়। কিন্তু এই নামকরনের মানে এই নয় যে এখন নতুন কোনো কণিকা আবিষ্কৃত হলে তাতে তাঁর অবদান থাকবে। জোতির্বিদ সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর তারকার চন্দ্রশেখর সীমার প্রবক্তা। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে নাসার একটি টেলিস্কোপের নাম দেওয়া হয় ‘চন্দ্রশেখর টেলিস্কোপ’। এখন সেই টেলিস্কোপের মাধ্যমে যদি সাড়াজাগানো কোনো মহাজাগতিক ঘটনা আবিষ্কার করা হয় তাতে চন্দ্র শেখরের নিশ্চয়ই কোনো অবদান থাকবে না। হিগস বোসনের ব্যাপারটিও তেমনই।

সূত্র:
১. মুক্তমনা: সার্ণ থেকে হিগস্ বোসন

১৭. কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন

stew/hc303


প্রথমত: আমেরিকার সভ্যতার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন অর্থাৎ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ আমেরিকায় বসবাস করে আসছে। সেই হিসেবে কলম্বাস এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরাই প্রথম আমেরিকাগামী কথাটার কোনো ভিত্তি থাকে না। তবে আমরা যদি এই প্রেক্ষিত বাদ দিই, অর্থাৎ ইউরোপ থেকে আমেরিকাগামী প্রথম ব্যক্তিকে আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দিই তারপরও বলতে হয় কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন নি। অর্থাৎ কলম্বাস আমেরিকায় গমনকারী প্রথম ইউরোপীয় ব্যক্তি নন। আমেরিকাগামী প্রথম ইউরোপীয় ব্যক্তির নাম লীফ এরিকসন (Leif Ericson)। তিনি কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে ১১ শতকে আমেরিকায় গমন করেন। তিনি উত্তর আমেরিকার বর্তমান কানাডার একটি দ্বীপ নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন।

সূত্র:
১. উইকিপিডিয়া: Leif Ericson
২. উইকিপিডিয়া: Christopher Columbus

১৮. গোল্ডফিসের স্মৃতি মাত্র দুই/তিন সেকেন্ড

article-1106884-02F6FE27000005DC-634_468x365


এটা এতোই প্রচলিত একটি মিথ যে ২০০৩ সালে Gold Fish Memory নামের একটা মুভি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে মাছ হিসেবে গোল্ড ফিশের স্মৃতি যথেষ্টই উন্নত। গবেষনায় দেখা গেছে গোল্ড ফিশ মাসাধিক তো বটেই এমনকি কিছু কিছু জিনিস একবছর পরেও মনে রাখতে পারে। শুধু তাই নয় গোল্ড ফিশকে ট্রেনিং দিয়ে বিশেষ বিশেষ কাজও করানো যায়। এদের বিশেষ বিশেষ রংএর প্রতি বিশেষ বিশেষ প্রতিক্রিয়া প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। এরা আলাদা আলাদা সঙ্গীতও সনাক্ত করতে পারে। যারা একুরিয়ামে গোল্ড ফিশ পোষেন, গোল্ডফিশ তাদের সেই মালিকদের চিনতে পারে এবং যে তাকে প্রতিদিন খাবার দেয় তাকে দেখলেই গোল্ড ফিশকে খাবার গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। গবেষকরা গোল্ড ফিশের স্মৃতি পরীক্ষার জন্য তাদেরকে বিশেষ বিশেষ লিভার চাপার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁরা গোল্ড ফিশের একুয়ারিয়ামে কয়েকটি লিভার সেট করেন এবং এমন ব্যবস্থা করেন যে দিনের একটি বিশেষ সময়ে একটি বিশেষ লিভার চাপ দিলে খাবার বের হবে। দেখা গেলো যে কোন সময়ে কোন লিভার চাপ দিলে খাবার বের হবে গোল্ডফিশ সেটা মনে রাখতে পারে এবং সেই অনুযায়ী লিভার চেপে খাবার সংগ্রহ করতে পারে।

সূত্র:
১. todayifoundout
২. ডেইলি মেইল

১৯. সাধারণ তাপমাত্রাতেও কাচ প্রবাহিত হয়

images


বলা হয়ে থাকে কাচ super cooled liquid হওয়ার কারনে সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রাতেও খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয় এবং আমরা যদি জানালার কাচ পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব কয়েক বছরের মধ্যে গ্লাসের স্বাভাবিক প্রবাহের কারনে এবং পৃথিবীর মাধ্যার্কর্ষণজনিত কারনে নিচের অংশ মোটা হয়ে গেছে এবং উপরের অংশ অপেক্ষাকৃত চিকন হয়ে গেছে। এটা আসলে একটা ভুল তত্ত্ব। সম্প্রতি গবেষকরা এই তত্ত্বের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে কোনো যুক্তি যুক্ততা পান নি। তাছাড়া যদি এমনটাই হতো তাহলে মিসরীয় সভ্যতা কিংবা প্রাচীন সভ্যতাগুলো হতে প্রাপ্ত কাচের পুরাকীর্তিগুলো গোলগাল হয়ে তলানীতে পড়ে থাকত। শুধু তাই না প্রাচীন টেলিস্কোপগুলোর কাচের আকার খুব সামান্য বদলে গিয়ে থাকলেও সেগুলোর দৃশ্যগুলো এখন দোমড়ানো মনে হতো কিন্তু সেই টেলিস্কোপের দৃশ্য এখনো যথেষ্ট সুস্পষ্ট। প্রকৃত পক্ষে কাচের প্রবাহিত হওয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমানের উপরে তার তাপমাত্রা তুলতে হয় যাকে বলা হয় glass transition temperature. এই তাপমাত্রা কক্ষতাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশী এবং এই কারনে কক্ষতাপমাত্রায় কাচ কখনোই প্রবাহিত হয় না। বরং যেসব জানালার কাচ নিচের দিকটা সামান্য মোটা পাওয়া গেছে সেগুলো প্রস্তুতির সময় সুষম ভাবে তৈরি করা যায় নি এবং স্থিতিশীল করার জন্য সেগুলোকে মোটাদিক নিচের দিকে দিয়েই জানালায় লাগানো হয়েছিলো এবং সবপ্রাচীন জানালার কাচ আসলে নিচের দিকে মোটাও নয়।

সূত্র:
১. glassnotes
২. www.cmog.org

২০. মানুষের উৎপত্তি হয়েছে বানর থেকে

index


মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে হয়নি বরং বলা যেতে পারে বানর এবং মানুষের পূর্বপুরুষ অভিন্ন। মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে হয়েছে এই কথা প্রচলিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের মাধ্যমে। কিন্তু বিবর্তন বিশেষজ্ঞরা কিংবা ডারউইন নিজেও কখনো বলেন নি মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে হয়েছে। বানর এবং মানুষ প্রায় ৯৫% কমন জিন বহন করে এবং প্রায় কোটিখানেক বছর আগে এরা একই পূর্বপুরুষ হতে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। আধুনিক হোমিনিড গোত্রীয় প্রাণীগুলো প্রায় ৭০ লাখ বছর আগে থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এই সময়ের মধ্যে মানুষের কাছাকাছি (Homo গণভুক্ত) অনেকগুলো প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য Homo habilis, Homo erectus, এবং Homo neanderthalensis প্রভৃতি। এদের মধ্যে শেষোক্ত প্রজাতি ছিলো বর্তমান Homo sapiens এর খুব কাছাকাছি। তবে একমাত্র মানুষ ছাড়া হোমো গণভুক্ত বাকী সবগুলো প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে।

সূত্র:
১. The_Myth_Of_Evolution
২. skeptic.com: top-10-evolution-myths

লেখাটি 625-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
    সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

    ‘হিগস বোসন আবিষ্কারের পিছনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় নি’ এটা এই সময়ের আলোচিত ভুল ধারণাগুলোর একটি। পিটার হিগস আর এংলার্ট নোবেল পাওয়া এটি আরও মাত্রা পেয়েছে।

    ‘মানুষের উৎপত্তি হয়েছে বানর থেকে’ এটা অনেক আগে থেকেই আছে।

    তবে কলম্বাসের ব্যাপারটি আমাকে অবাক করেছে। এতদিন তো তাই জানতাম। আশ্চর্য!

    1. এরিকসন এবং কলম্বাসের জীবনীর লিংকে চোখ বুলিয়ে নিতে ভুলবেন না!

  2. সিরিজটা চলতে থাকুক। দারুন হচ্ছে।

    1. ধন্যবাদ।

  3. সিরিজের প্রতিটি ভুল ধারণাকে বিস্তারিত করে পূর্ণাঙ্গ বই বের করা সম্ভব — প্রতিটি বিষয়ই আলাদা আলোচনার দাবী রাখে।

    1. আরাফাতের সাথে একমত। সব একত্রিত আকারে বই হতেই পারে। 🙂

Leave a Reply to bengalensisCancel reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers