ইভোলিউশন এর “ন্যাচারাল সিলেকশন” এর কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি কিন্তু এর বিপরীত যে আরেকটি বিষয় আছে “আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন”, যা ইভোলিউশন এর আলোচনায় সাধারণত তেমন একটা আসেনা। কিন্তু জিনিসটার চর্চা কিন্তু আমরা সবসময়ই ধরেই করে আসছি, সকল উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল কে আমাদের মত করে গঠন করতে যাদের উপর আমরা নির্ভরশীল। আমরা যে আমাদের পছন্দসই বৈশিষ্ট্য বাছাই করে প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রজনন করি তাই হল আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন। একে সিলেক্টিভ ব্রিডিং ও বলা হয়। এখন এখানে কুকুর কোথা থেকে আসল তাই তো ? আজকে মানুষ-কুকুর এর বন্ধুত্বের মজার গল্পটাই সবাইকে বলবো…
মানুষের প্রথম আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন এর ফলাফল ই হচ্ছে এই কুকুর, মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড।
তা, কুকুর এর পূর্বপুরুষ কে ছিল জানেন ?
উত্তর টা হল – নেকড়ে !!
মরফোলজিকালি বা দেখতে সাদৃশ্য থাকলেও এরকম খতরনাক প্রানী থেকে মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু কুকুর কিভাবে আসলো প্রশ্ন জাগতেই পারে। হ্যা, ভয়ানক শিকারী নেকড়ে কে ফ্রেন্ডলি কুকুর এ রূপান্তরিত করেছে মানুষেরই আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন। কিন্তু মনে করবেন না এই পরিবর্তন এখনকার মত কোন ব্রিডিং প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে হয়েছে। মানুষ এবং কুকুরের বন্ধুত্ব এই আজকের না, হাজার হাজার বছর আগের। আর এই বেয়াদ্দপ নেকড়ে কে সাইজ করে কুকুর এ পরিণত করাই কিন্তু মানব জাতির জন্য প্রথম বারের মত ইভোলিউশন কে নিজের হাতে নেওয়া।
শুরুটা যেভাবে হল –
দশ হাজার বছর আগের কথা, যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা কোন আশ্রয় ছাড়া খোলা আসমানের নিচেই বসবাস করত… ভয়ে থাকত শিকারী পশুপাখিদের, কারন তাদের সাথেই নিজের শিকার করে বেচে থাকার প্রতিযোগিতা, এমন কি শিকার হতে পারে নিজেরাও। সেরকম নেকড়েরাও কিন্ত হিংস্র শিকারির লিস্টেই পড়ে। তারাও কিন্তু ভয় পেত মানুষ কে। ভয়ে নির্দৃষ্ট দূরত্ব বজায়ই রাখত। কিন্তু কিছু সাহসী ও চালাক নেকড়ে বুদ্ধি আটলো, নিজেরাশিকার এর ঝামেলায় যাবেনা, মানুষ যেহেতু খাদ্যের যোগানে শিকার করে-ই এবং সফল ও হয় তাই তারাই শিকার করুক, খাওয়া দাওয়াও করুক। তাদের খাবারের উচ্ছৃষ্ট জিনিসপত্র তারা খাবে। এতে খাবার এর যোগান ও হল, কষ্ট ও করা লাগলোনা। যেই বুদ্ধি সেই কাজ। এতে হল কি, সাহস করে মানুষের কাছে গিয়ে উচ্ছৃষ্ট অংশ খেতে খেতে মানুষের সাথে তাদের একটা সখ্যতা গরতে লাগলো। মানুষরা ও চালাক, তাদের উচ্ছৃষ্ট খাবার দিয়ে তাদের কে পালা শুরু করল এবং বিভিন্ন কাজ করানোও শুরু করল। নেকড়েদের দিয়ে পাহাড়া দেওয়াতো, শিকারে কাজে লাগাতো এমন কি তাদের সঙ্গীও মানুষ রাই ঠিক করা শুরু করল। এতে সেই সাহসি ও চালাক নেকড়েগুলো যারা মানুষের সংস্পর্শে আশার সাহস করে ছিলো তাদের নিয়ে নেকড়েদের একটি নতুন পপুলেশন সৃষ্টি হল, যারা কিনা মানুষের একান্তই অনুগত। মানুষ নিজেদের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাছাই করে নেকড়েদের বাচ্চা গুলোকে জীবিত রাখত। মালিকের অনুগত না এরকম বাচ্চা গুলোকে মেরে ফেলত। এভাবেই শুরু হয়ে গেল মানুষ দ্বারা নেকড়ে দের সিলেকশন এবং ডমেস্টিকেশন। নেকড়েদের এই ইভোলিউশন এর ক্ষেত্রে বলাই যায় “সারভাইভাল অফ দ্যা ফ্রেন্ডলিয়েস্ট”। তাছাড়া সেই হিংস্র নেকড়েগুলো থেকে আজকের এত কিউট ডগিগুলো কিভাবে পেলাম বলতে পারবেন ? এটাও সেই মানুষেরই বাছাইকরন এরই ফল… কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে কিউটনেস ও যে একটা গুরত্বপুর্ন বৈশিষ্ট্য ছিল… 😀
সময়ের পর সময়ে বিভিন্ন ভৌগলিক এলাকায়, বিভিন্ন পপুলেশন এ সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে নেকড়ে থেকে আজ কুকুরের এই ইভোলিউশন। আমরাই যুগে যুগে বাছাইকরণ এর মাধ্যমে নেকড়ে হতে আমাদের ফ্রেন্ডলি কুকুর কে পেয়েছি। তাছাড়া আজ যে হাজার হাজার জাতের কুকুর, এত বৈচিত্র্য, সবই যুগে যুগে আমাদের করা সিলেক্টিভ ক্রস ব্রিডিং এরই ফল। কারন আমরা জানি জিনোমিক লেভেল এ ছোট্ট ছোট্ট পরিবর্তন ও মরফোলজিকাল এবং আচরণ গত বিশাল পার্থক্য এনে দেয়। মানুষ এবং চিম্পাঞ্জির জিনোম তুলনাই এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহারণ। সামান্য পরিবর্তন পপুলেশনে অনেক কম সময়ের মধ্যেই বড় পার্থক্য এনে দিতে পারে। কুকুর আর নেকড়ের এই পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া ৩০০০০ বছর এর হলেও ভূতত্ত্বগত ভাবে কিন্তু এটা তেমন কোন সময়ই নয়।
প্রমাণ-
বিভিন্ন সময়ে করা সব আর্কিওলজিকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা ও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। কুকুরের ডমেস্টিকেশন এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় জার্মানিতে, যেখানে মাটি খুড়ে ১২০০০ বছর আগের কুকুর এবং মানুষের একসাথে দেওয়া কবর পাওয়া যায়। তাছাড়া এরপরেও আরও অনেক আর্কিওলজিকাল আবিষ্কার এই প্রমাণ করে যে কুকুর অনেক প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতার সংস্কৃতির একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
বিভিন্ন নেকড়ে এবং কুকুর প্রজাতির জেনেটিক এনালাইসিস ও একই কথা বলে। আলটাই পাহাড় থেকে পাওয়া ২৩০০০ বছর পুরোনো কুকুরের ফসিলের ডিএনএ এনালাইসিস করে দেখা যায় তারা আধুনিক কুকুর এর চেয়ে নেকড়ের সাথেই জেনেটিকালি বেশি সম্পর্কযুক্ত। তাছাড়া আধুনিক বিভিন্ন জাতের কুকুর এর জেনেটিক এনালাইসিস করে দেখা যায় তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় নেকড়ের ডমেস্টিকেশন এর ফলেই এসেছে।
কিছু কুকুর ভ্যারাইটি এবং জেনেটিকালি কাছাকাছি কিছু নেকড়ে এবং শিয়াল নিয়ে করা ফাইলোজেনেটিক ট্রি
এই তত্ব কে সমর্থন করার জন্য এক্সপেরিমেন্টাল প্রমান ও পাওয়া গেছে। রাশিয়ার কিছু বিজ্ঞানী বন্য শিয়াল দের উপর ডমেস্টিকেশন এর একটি পরীক্ষা করেন। তাঁরা শিয়ালের ৩৫ টি জেনারেশন এবং ৪০ বছর ধরে শিয়ালের ওপর সিলেক্টিভ ব্রিডিং চালান। তাদের সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার মাত্র একটাই বৈশিষ্ট্য ছিল, এবং তা হল মানুষের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণতা। প্রজনন এবং ডমেস্টিকেশন শেষে তাঁরা আসলেই মানুষের প্রতি অনুগত এবং বন্ধুত্বপ্রবন একটি পপুলেশন পেয়েছিলেন, যারা অনেকটাই কুকুরের মত। এমন কি তাদের বাহ্যিক এমন কিছু বেশিষ্টের পরিবর্তন হয়েছিল যেমন – সাদা কালো গাত্রাবরণ, ঝোলান কান, কুন্ডলী পাকানো লেজ এমন কি কুকুরের ঘেউ ঘেউ করা স্বভাব ও, যেসব তাদের সিলেকশন ক্রাইটেরিইয়ায়ই ছিলই না !!
ডমেস্টিকেশন এর উপর আরেকটি মজার তথ্য দেই। পৃথিবীতে কিন্তু মানুষ বাদেও আরেকটি প্রাণী আছে যারা অন্য প্রাণীকে লালন পালন করে । কে সেটা জানেন ? “পিঁপড়া”… কি অবাক হচ্ছেন তো… হ্যা, পিঁপড়ারা কিন্তু বেজায় স্মার্ট। অ্যাফিডস নামক একধরনের পোকা আছে যারা গাছপালা থেকে রস আহরন করে দুধের ন্যায় এক ধরনের পদার্থ নিঃসরণ করে, যা পিঁপড়া খায়। তাই পিঁপড়া অ্যাফিডস দের লালন পালন করে, যত্ন নেয় এমনকি তাদের যেকোন বিপদের হাত থেকে সুরক্ষাও দেয়। তারা আমাদের গরুর দোহন এর মত এন্টিনা দিয়ে অ্যাফিডস দের গায়ে আঘাত করে যাতে তারা ওই দুধের ন্যায় পদার্থ নিঃসরণ করে।
তাহলে এই হল আমাদের সাথে কুকুরের বন্ধুত্বের পুরানো ইতিহাস। কুকুররা কিন্তু আমাদের শুধু সবচেয়ে ভালো বন্ধুই না পশুদের মধ্যে সর্বপ্রথম বন্ধু ও…
Leave a Reply