নিউরন, আলো এবং অপ্টোজেনেটিক্স

আমাদের মগজটা অসাধারন একটা বস্তু। অসাধারন এর প্রয়োজনীয়তা, অসাধারন এর জটিলতা। ছোট্ট-বদ্ধ একটা কোঠরে থেকেও, একটি কোয়ান্টাম কণার স্পন্দন থেকে মহাবিশ্বের নিঃসীমতা- বহু কিছুই ধারন করতে পারে। ভালো লাগা, খারাপ লাগা, চলাফেরায় ভারসাম্য রাখা- এই ব্যাপারগুলো মগজের নিউরনের মধ্যে ছড়ানো কিংবা সাজানো থাকে। মন ভালো নাই- নির্দিষ্ট কিছু নিউরন কাজ করছে। সুন্দর একটি গান শুনে মন ভালো হয়ে গেল, অন্য এক গুচ্ছ নিউরন এখন সক্রিয়। কিংবা ভাইভা দিতে গিয়ে সব ভূলে যাওয়া, তখন সব নিউরন নিষ্ক্রিয়। মাত্রাতিরিক্ত সরলীকৃত করে বলা যায় যে, নিউরনের সক্রিয়তা/নিষ্কৃয়তাই আমাদের আবেগ-অনুভূতি, আচরনের ভৌত রূপ।

মানুষের স্বভাবই হচ্ছে শর্টকাট খোজা। সমুদ্র দেখতে মানুষের ভালো লাগে, তাই মানুষ কক্সবাজার যায়। কিন্তু সমুদ্রে তো সবসময় যাওয়া যায়না, তাই শর্টকাট হিসেবে আগের দিনে ঘরের দেয়ালে সমুদ্রের ছবি শোভা পেত। আস্তে আস্তে মানুষ বিজ্ঞান শিখলো, টেলিভিশন আবিষ্কার করে তাতে সমুদ্রের ছবি দেখতো। তারপর বিজ্ঞান আরো স্মার্ট হলো। মানুষ এখন শুধু শর্টকাট না, সব কিছু এক ক্লিকে চায়। এখন মানুষ এক ক্লিকে স্মার্টফোনে/ট্যাবে সমুদ্র দেখতে পারে। কিন্তু একটা সমস্যা সবসময়ই ছিল, মগজ তো ঠিকই বুঝে- কোনটা আসল সমুদ্র আর কোনটা ফাঁকি। তো কি করা যায়? চোখ/কান দিয়ে সমুদ্র বাইপাস করে আর নয়। এইবার সরাসরি নিউরন নিয়ে চিন্তা করতে হবে। প্রথমে বুঝতে হবে কোন নিউরন সমুদ্র চিনে, তারপর তাকে ধরে সক্রিয় করার জন্য বুদ্ধি বের করতে হবে। কি দিয়ে কাজটা করা যায়ঃ বিদ্যুৎ? কাজ হয়… কিন্তু এই পদ্ধতিতে ঠিক নির্দিষ্ট কিছু নিউরনের সক্রিয়করন সম্ভব হয়নি। ওষুধ? কাজ হয়, কিন্তু বেশ ধীরে। চুম্বক? আমি নিশ্চিত না এরকম কিছু আছে কিনা। আলো? এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে ভালো। এর ফলাফল সাথে সাথেই পাওয়া যায়, আর একদম খাপে খাপে কাজ করে। এই বিষয়টাই হচ্ছে অপ্টোজেনেটিক্স।

আমাদের মগজে কোটি কোটি নিউরন আছে। কোন নিউরনের কাজ কি সেটা কেমনে বুঝব? আগের দিনে সেটা বুঝার জন্য অপেক্ষা করা লাগতো, কিসের অপেক্ষা? গ্যাঞ্জামের অপেক্ষা। একদিন ব্যপক ঝড়ের পর দেখা গেল আপনার বাসায় সামনে কিছু তার ছিড়ে পড়ে আছে। আপনার ধারনা নেই সেটা কিসের তার। তখন ঘরে ঢুকবেন, বাতির সুইচ টিপবেন বাতি জ্বলল। তাহলে সেটা বিদ্যুতের তার নয়। টেলিভিশন চালু করলেন, ছবি আসছে- তার মানে ডিশের লাইনেও সমস্যা হয়নি। কম্পিটার অন করে দেখা গেল ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এখন তাহলে বুঝতে হবে, ইন্টারনেটের তার ছিড়ে গেছে। ঠিক তেমনি কোন রোগ, দূর্ঘটনা কিংবা এক্সপেরিমেন্টাল ড্রাগ এমনকি ইলেক্ট্রোড ঢুকিয়ে যখন কোন নিউরনে ‘গ্যাঞ্জাম’ লাগানো হয়, তার ফলে যদি সেই নিউরনের মালিক কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তখনি ধারনা করতে পারেন ওই নিউরনের কাজ কথা বলা নিয়ন্ত্রন করা। বেশ সময় সাপেক্ষ কাজ। কিন্তু অপ্টোজেনেটিক্সের কল্যানে বর্তমানে গবেষকরা আলো ব্যবহার করে নির্দিষ্ট নিউরন নিয়ে গবেষনা করতে পারেন আলোর বেগে!

১৯৭০ থেকে এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ার বায়ো-ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলোতে এক বিচিত্র ধরনের প্রোটিন আবিষ্কৃত হয়েছে, যার নাম মাইক্রোবিয়াল অপসিন। এই প্রোটিন আলোর উপস্থিতিতে সাড়া দেয়, কিভাবে সাড়া দেয়? অনুজীবের মেমব্রেনের ফাক-ফোকড় দিয়ে চার্জিত আয়ন আদান প্রদান অর্থাৎ চার্জের পরিবর্তনের মাধ্যমে। মজার বিষয় হল, একটি উত্তেজিত নিউরন পাশের নিউরনে সংকেত দেবার সময় যেরকম চার্জের পরিবর্তন হয় এবং এই প্রোটিন গুলো আলোর উপস্থিতিতে যে চার্জের পরিবর্তন তৈরি করে, তা বেশ কাছাকাছি! আর তাতেই বৈজ্ঞানিকেরা নাচতে নাচতে এই প্রোটিন নিয়ে নিউরনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। যদিও এককোষী অনুজীবেরা এই প্রোটিনগুলোকে অন্য কাজে ব্যবহার করে, যেমন আলোর উপস্থিতির সাপেক্ষে এদিক ওদিক চলাফেরা করে সবুজ শৈবাল তার সালোকসংশেষন চালু রাখে। যাই হোক, ২০০৫ সালে বিজ্ঞানীরা ইদুরের নিউরনের মধ্যে এরকম অপসিন স্থাপন করেন, এবং আলোর প্রভাবে সূক্ষ সময়ে নিউরনকে উত্তেজিত করতে সফল হন। ২০০৭ সালের মধ্যে এই প্রযুক্তি ইদুরের কিছু আচরন সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা অর্জন করে। এর পর, এই সম্পর্কিত আরো কিছু প্রোটিন যেমনঃ ব্যাক্টেরিওরোডপসিন, হ্যালোরোডপসিন এবং চ্যানেলরোডপসিনকে শনাক্ত করা হয়।


অপ্টোজেনেটিক্স এর প্রকৃয়াটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমে, বুঝতে হবে কোন অপসিন প্রোটিন নিয়ে কাজ করতে হবে। আগেই বলেছি বেশ কয়েক ধরনের অপসিন রয়েছে। তবে অপ্টোজেনেটিক্স মূলক মাইক্রোবিয়াল অপসিন নিয়ে কাজ করে, কেননা এরা আলো পেলেই আয়নের প্রবাহে নাড়াচাড়া দিয়ে বসে। অপরদিকে এনিমেল অপসিন গুলো আয়ন নয়- বায়োকেমিক্যাল জিনিসপত্রের আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রন করে। যাই হোক, নিউরন সক্রিয় করার জন্য চ্যানেলরোডপসিন এবং নীল আলো কাজে লাগানো হয়, নিউরন নিষ্কৃয় করার জন্য হ্যালোরোডপসিন এবং হলুদ আলো ব্যবহার হয়। আবার, অপ্টোএক্সআর(OptoXR) প্রোটিন সবুজ আলোর প্রতি সংবেদনশীল এবং রিসেপ্টরের মাধ্যমে অন্তঃকোষীয় সংকেত আদান প্রদানে কাজে লাগে।

দ্বিতীয় ধাপে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, যার মাথা নিয়ে পরীক্ষা করছি তার মাথার নিউরনে যেন অপসিন থাকে। এখন এই প্রোটিন তো আর ধরে ধরে পুশ করা সম্ভব না, এত সূক্ষ সিরিঞ্জ ও নাই। তাই- যেই জিনের কারনে এই প্রোটিন তৈরি হয়, সেটার প্রোটিন কোডিং অংশটুকু আলাদা করা হয়। মাথায় একটা প্রোমোটার জুড়ে দিয়ে ভাইরাসের সাহায্যে কাংক্ষিত কোষের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়।

তৃতীয় ধাপটা সবচেয়ে সহজ, মাথার খুলিতে ফুটো করে ফাইবার অপটিক্স বসিয়ে দেয়া।

তো কি বুঝা গেল? অপ্টোজেনেটিক্স হচ্ছেঃ জিন-প্রকৌশল ব্যবহার করে কাংক্ষিত নিউরন বা নিউরনগুচ্ছের মধ্যে অপসিন প্রোটিন সন্নিবেশের দ্বারা ফাইবার অপটিক্স বা অন্য কোন উপায়ে আলোর উপস্থিতি ঘটিয়ে নিউরনকে সক্রিয় বা নিষ্কৃয় করাই হল অপ্টোজেনেটিক্স।

যাই হোক, অপ্টোজেনেটিক্স আসলেই অনেক সম্ভাবনাময় একটা ক্ষেত্র। । ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেম, কোকেইন রিওয়ার্ড সিস্টেম, পার্কিন্সন্স, ঘুম গবেষনা, সাইকোলজি, মেমরী ফর্মেশন… বহু গবেষনায় অপ্টোজেনেটিক্স ব্যবহৃত হচ্ছে। অপ্টোজেনেটিক্স নিজেও অবশ্যই দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। প্রাইমেট নিউরনে অপ্টোজেনেটিক নিয়ন্ত্রন নিয়ে কাজ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেখানো হয়েছে যে, চ্যানেলরোডপসিন মানুষের নিউরনেও কাজ করতে সক্ষম। অপ্টোজেনেটিক্স এর সাহায্যে ‘ডিপ ব্রেইন সিমুলেশন’, opto-fMRI(funcional Magnetic Resonance Imaging) এই পদ্ধতিগুলো ব্রেইন ম্যাপিংকে করবে গতিশীল। যার ফলে- মগজের সকল রহস্যের সমাধান নয়, আরো জটিলতর কোন রহস্যের খোজ দেবে- সেই প্রত্যাশাই করেন বৈজ্ঞানিকেরা।

তথ্যসূত্রঃ
১।Optogenetics: Sahar C. P. Williams and Karl Deisseroth.
২।Optogenetics as a neuromodulation tool in cognitive neuroscience: E. A. Claudia Pama, Lorenza S. Colzato and Bemhard Hommel.

লেখাটি 706-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. অপ্টোজেনেটিক্সের বিষয়টা নতুন জানলাম। ঘটনাটা কি এরকম, নিউরনে অপসিন ঢুকিয়ে দাও, তারপর ঐ নিউরনে আলো ফেলে সক্রিয় করে দেখো কি ঘটে?

    1. ঠিক তাই! তবে সরাসরি অপসিন না ঢুকিয়ে অপসিনের জিন ঢুকানো হয়।

    2. নিষ্কৃয় করেও দেখা হয়।

      1. কিন্তু এর মাধ্যমে ঐ নিউরনকে কিভাবে কোন অভিজ্ঞতায় আলোড়িত করা যায়? কিংবা আমরা কিভাবে বুঝবো ঐ নিউরনটা এই অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত? বিশেষ করে সেটা যদি সমুদ্র-দর্শনের মতো কিছু হয়?

  2. দারুণ বিষয়! নতুন কিছু জানলাম ( y)

  3. […] নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই লেখায়)। এই আয়ন-চ্যানেল খুলে যাওয়ার ফলে […]

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading