জমজ সম্পর্কে কিছু কথা

লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

আমাদের পৃথিবীটা অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ, এখানে বিভিন্ন প্রকার বিচিত্র ঘটনার যেন অভাব নেই। ঠিক তেমনই একটা বিচিত্র কিন্তু প্রাকৃতিক ঘটনা হল যমজ শিশুর জন্ম। বিচিত্র বলার কারণ এই যে, দুটি শিশু একই সাথে জন্ম নেবে যারা একই রকম দেখতে হবে, একই রকম সুরে কথা বলবে, একে অন্যের পুরোপুরি ক্লোন হবে, এটা আসলেই অনেক মজার একটা ব্যাপার। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের কাছেও যমজ শিশু খুব জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় একটা বিষয় – এ নিয়ে গবেষণার যেন শেষ নেই। যমজ শিশুর জন্ম একটা প্রাকৃতিক ঘটনা, প্রকৃতিতে সবসময়ই সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে দেখা যায়। মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়, তাই ভাবলাম এটা নিয়ে দু-চার কথা লিখলে কেমন হয়! অনেকেই হয়তো যমজ শিশু সম্পর্কে জানেন, অনেকেই হয়তো জানেননা অথবা আমার মতো অল্প-স্বল্প জানা পণ্ডিত ব্যাকটি, তবুও সবার জানার উদ্দেশ্য নিয়েই যমজ শিশু নিয়ে একটু বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করলাম আর কি!

যমজ কি?

সাধারণত কোন নারী একবারে একটি মাত্র সন্তানই প্রসব করে থাকে। সন্তানটি ছেলে কিংবা মেয়ে হতে পারে। অনেক সময় কোন কোন নারীকে দুই বা ততোধিক সন্তান প্রসব করতে দেখা যায়। একই মায়ের দুই বাততোধিক শিশু একবারে ভূমিষ্ঠ হলেসেই শিশু-দ্বয়কে যমজ সন্তান বলে।

অন্যকথায়, যমজ সন্তান বলতে,দুটি অঙ্কুর বা দুটি ডিম থেকে, প্রতিটি পৃথক শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত শুক্রাণু কোষ বিপরীতভাবে, দুই বা ততোধিক ভ্রূণের বিকাশ,যা গর্ভে দুই বা ততোধিক সন্তানের জন্ম দেয়। বিভিন্ন প্রকার যমজজিনগত ভাবে এবং নিষেক প্রক্রিয়ার দিক থেকে দেখলে সকল প্রকার যমজদের প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
মনোজাইগোটিক (Monozygotic) বা অভিন্ন যমজ (Identical Twin)
ডাইজাইগোটিক (Dizygotic) বা ভিন্ন যমজ (Non-identical Twin)

Twin - Wikipedia

উপরোক্ত দুই প্রকার যমজদের নিয়েবিস্তারিত বলার আগে একটা বিষয় জানা দরকার যে একটা শুক্রাণু সবসময় একটা ডিম্বাণুকেই নিষিক্ত করবে এবং নিষিক্ত হওয়ারপরপরই এটি খুব দ্রুত বিভাজন (Cleavage) শুরু হয়ে ভ্রূণ তৈরি করে এবং ধীরে ধীরে এটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়।

অভিন্ন যমজ (Monozygotic or IdenticalTwin):

একটি মাত্র নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে যদি দুটি শিশুর জন্ম হয় তাকে অভিন্ন যমজ (Monozygotic Twin) সন্তান বলা হয়। এক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণুটি বিভাজিত হয়ে দুটি পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হয়। এর ফলে দুটি শিশুর জন্য কেবল একটি মাত্র ফুল বা অমরা (Placenta) থাকে। যেহেতু শিশুদুটি পুরোপুরি একই জীন (Gene) বহন করে এবং সকল বৈশিষ্ট্য একই রকম হয় তাই এদের কে অনেক সময় অভিন্ন যমজ (Identical Twin) বলা হয়।শিশু দুটির লিঙ্গ এবং সকল শারীরিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য ওএক হয়ে থাকে। যমজ শিশুদের মধ্যে এই প্রকার শিশুরা শুধুমাত্র এক তৃতীয়াংশ। অনেক সময় এ ধরনের যমজ শিশু একজন অপরজনের কাছ থেকে পুরোপুরি আলাদা হয় না এবং জন্মের পরও এদের কিছু কিছু অঙ্গ সংযুক্ত থাকে (Siamese twin)। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে এ সকল শিশুকে আলাদা করে একটি অর্থবহ জীবন দান করা বর্তমান বিশ্বে এখন আর অসম্ভব কিছু না।

ভিন্ন যমজ(Dizygotic or Non-identical Twin):

যখন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে দুটি শিশু জন্ম নেয় আর এদের নিষিক্ত করা শুক্রাণু দুটিও পুরো ভিন্ন ভিন্ন, তখন তাদের ডাইজাইগোটিক যমজ বলে। যার অর্থ একই সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি শিশু ঘটনাক্রমে একই সময় জরায়ুতে বড় হচ্ছে। ফলে শিশু দুটির আলাদা আলাদা দুটি ফুল বা অমরা(Placenta) থাকে এবং এদের লিঙ্গও এক বা ভিন্ন হতে পারে। এমন দুটি শিশুর একসাথে লেগে থাকার সম্ভাবনা থাকেনা। যমজ বাচ্চাদের দুই তৃতীয়াংশই এমন ভাবে জন্ম নেয়। যার ফলে দেখা যায় যমজ হলেও এদের লিঙ্গ, রক্তের গ্রুপ, গড়ন, গায়ের রঙ বা অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্য এক নয়। তবে দুজন একই রকম হওয়াটাওকিন্তু অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দুটি আলাদা ডিম্বাণু ওশুক্রাণু হওয়ার কারণে জেনেটিক দিক থেকে এরা ভিন্ন হয় একারণে এদের কে অন্যভাবে ভিন্ন যমজ (Non-identical Twin) বলা যায়।

প্লাসেন্টায় জমজ

যমজ সন্তান জন্মের কারণ:

একটিবার ভেবে দেখুন তো, দুটি একইরকম শিশু একটা গর্ভে বেড়ে উঠছে! এটা অবশ্যই একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার কিন্তু কারণবিহীন ঘটনা নয়। যমজ সন্তান জন্মানোর কারণ হিসাবে বিভিন্ন বিষয় ধরা হয়, তবেপ্রধান দুটি কারণ হল:

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: সন্তান জন্মের জন্য প্রধান উপাদান ডিম্বাণু ও শুক্রাণু। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উভয়ই হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে যমজ সন্তান জন্মানোর ক্ষেত্রে ডিম্বাণুর ভূমিকা সবথেকে বেশি কারণ মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে প্রতিমাসে একটি মাত্র ডিম্বাণু উৎপন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে কোন কোন মাসে একেবারে দুটি পূর্ণ ডিম্বাণু তৈরি হতে পারে ফলে, মিলন পরবর্তী সময়ে শুক্রাণু দুটি ডিম্বাণুকেই নিষিক্ত করে (যেহেতু শুক্রাণুর ক্ষেত্রে সংখ্যার কোন বাধ্যবাধকতা নেই, উপরন্তু শুক্রাণুর সংখ্যা অনেক)। ফলশ্রুতিতে, দুটি পৃথক পৃথক নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে দুটি সন্তান জন্ম নেয়। ডাইজাইগোটিক যমজ জন্ম নেওয়ার প্রধান কারণ হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। হরমোনের এধরনের ভারসাম্যহীনতা বিভিন্ন কারণে আসতে পারে, বংশগতি সম্পর্কিত কারণে, খাদ্যাভ্যাস, বয়স ইত্যাদি।
জন্মবিরতিকরণ পিলের কারণেও হরমোনাল সমস্যা হতে পারে, কারণ জন্মবিরতিকরন পিল ৬-৭ মাস গ্রহণ করে বন্ধ করার পর বাড়তি ১-২ চক্র সময় লাগতে পারে হরমোন উৎপাদন ও এর কার্যক্রম স্বাভাবিক হবার জন্য। ঠিক এই সময়ে কেউ গর্ভধারণ করতে চাইলে যমজ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে কারণ এইসময়েমহিলারা অধিক উদ্দীপনা (HormoneStimulation) অনুভব করতে পারে, ফলে একের অধিক ডিম্বাণু তৈরি হতে পারে।

অনিয়মিত এবং দ্রুত কোষ বিভাজন:
অনিয়মিত কোষ বিভাজনের কারণেও যমজ সন্তান জন্ম হতে পারে। সাধারণত, নিষিক্ত হওয়ার পরে ডিম্বাণু বিভাজন (Cleavage) শুরু করে এবং ভ্রূণ গঠন করে। এই বিভাজন একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে কোষ বিভাজনে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায় এবং দ্রুত বিভাজন সম্পন্ন হয়, ফলে কোষ বিভাজনের কোন এক পর্যায়ে এটা ভেঙ্গে যায় এবং পরবর্তীতে ওই ভেঙ্গে যাওয়া কোষ-গুচ্ছের প্রত্যেকটি হতে একটি করে ভ্রূণ তৈরি হয় যেগুলো ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়, এবং যথাসময়ে ভূমিষ্ঠ হয়। এইভাবে ভূমিষ্ঠ সন্তানেরা দেখতে একই রকম হয় এবং তাদের লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য গুলি হয় একই রকম-এবং এরা সবসময় একই লিঙ্গের হয়ে থাকে। কারণ দুটো সন্তানেই একই ডিম্বাণু থেকে জন্ম লাভ করে।যাহোক, মায়ের বংশে বা পারিবারিক ইতিহাসে যদি কারো যমজসন্তান থাকে তাহলে অনাগত সন্তানযমজ হতে পারে। তাছাড়া ফলিক এসিড গ্রহণ করলেও যমজ সন্তান হবার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। একটা অস্ট্রেলিয়ান জরিপানুসারে ফলিক এসিড যারা গ্রহণ করে তাদের ক্ষেত্রে অনাগতসন্তান যমজ হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। এছাড়াও বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় যেসব মহিলার ওজন, উচ্চতা বেশি; যারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ায় তাদের যমজ হবার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে ৩গুণ বেশি।

যমজ সন্তান গর্ভধারণে কিছু সমস্যা

যমজ সন্তান হওয়া স্বাভাবিক একটিঘটনা হলেও যমজ সন্তান ধারণ করলে গর্ভবতী মাকে একটু বাড়তি সাবধানতা গ্রহণ করতে হয়। এ সকল মায়ের এনিমিয়া, এক্লাম্পসিয়া, এন্টিপারটাম হেমোরেজ, ম্যাল প্রেজেন্টেশন, প্রিটার্ম লেবারসহ নানাবিধ সমস্যা হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। এমনকিএক্ষেত্রে মৃত্যুর আশংকা ও যথেষ্ট বেশি। এজন্য এসকল ক্ষেত্রে শুরু থেকেই একজন স্ত্রী ও প্রসুতি রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থাকলে মা এবং শিশু দুজনেরই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

Twin - Wikipedia

বিশ্ব পরিসংখ্যানে জমজ:

১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত করা জরিপের তথ্যানুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যমজ সন্তান জন্মের হার পূর্বের থেকে ৭৬% বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জনে ১৮.৯ থেকে ৩৩.৩ জোড়া যমজ বাচ্চা হয়। সারা পৃথিবীর মধ্যে ইয়ুরুবা তে যমজ বাচ্চা জন্মের হার সব থেকে বেশি, প্রতি ১০০০ জনে ৪০-৫০ জোড়া যমজ বাচ্চা জন্মলাভ করে-এর কারণ হিসাবে দায়ী করা হয় তাদের খাদ্যাভ্যাসকে। ইয়াম নামের এক ধরনের খাদ্য তারা অনেক বেশি পরিমাণ খায় যেটা কিনা প্রাকৃতিকফাইটোইস্ট্রোজেন সমৃদ্ধ (ইস্ট্রোজেন ডিম্বাণু নিঃসরণের হার বৃদ্ধি করে)। মধ্য আফ্রিকাতেও এই পরিমাণে যথেষ্ট বেশি, প্রায় ১০০০ জীবিত বাচ্চার মধ্যে ১৮-৩০ যমজ জোড়া দেখা যায়।সে তুলনায় ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় যমজ বাচ্চা জন্মানোর হার বেশ কম পরিলক্ষিত হয়, মাত্র ৬-৯ জোড়া যমজ প্রতি ১০০০ জন জীবিত বাচ্চার মধ্যে। এছাড়া উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ অন্তর্বর্তী অঞ্চলে জীবিত প্রতি ১০০০ জনে ৯-১৬ জোড়া যমজ জন্মগ্রহণ করে থাকে।

উপসংহার:

একজন মা সাধারণত একটি সন্তানই প্রসব করে থাকেন। তবে এর ব্যতিক্রমও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, একই গর্ভাবস্থায় যখন কোনও মা একাধিক ভ্রূণ ধারণ করে থাকেন এবং একাধিক সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন, তখন তাদের যমজ সন্তান বলাহয়ে থাকে। যদিও কিছুটা বিরল, তবেমানুষ এবং পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণিতেও যমজ সন্তান প্রসবের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানুষে মূলত দুই ধরণের যমজ দেখা যায়- অভিন্ন (Identical or Monozygotic Twin) ও ভিন্ন যমজ (Non-identical or Dizygotic Twin)। কেবলমাত্র একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে যখন সমধর্মি ও একই লিঙ্গের যমজের জন্ম হয়ে থাকে, তখন আমরা তাকে অভিন্ন যমজ বলে থাকি। অন্যদিকে, ভিন্ন ভিন্ন দুই বা ততোধিক ডিম্বাণু যদি ভিন্ন ভিন্ন শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয় তবে ভিন্ন যমজের ঘটনা ঘটে থাকে। প্রধানত নিষিক্তডিম্বাণুর অনিয়মিত বিভাজন, হরমোনের তারতম্য, বংশগতি, খাদ্যাভ্যাস ও অন্যান্য কারণগুলো যমজ সন্তান প্রসবের জন্য দায়ী। যদিও প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়, যমজ সন্তানের জন্মদান কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা ও সন্তান উভয়ের জন্য বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে থাকে।বংশগতির কোন একটি বৈশিষ্ট্য কতটা জিন দ্বারা আর কতটা পরিবেশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়, তা জানার জন্য যমজ সম্পর্কিত গবেষণা এক্ষেত্রে অনেকটা সহায়ক। তবে এইধরনের গবেষণা কাজের নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।

লেখাটি 3,787-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. অনেক কিছু জানা গেল। লেখককে অনেক ধন্যবাদ। ছোট্ট পরামর্শ: পরবর্তীতে লেখা সাবমিশনের আগে অভ্র স্পেল চেকার দিয়ে ভুল বানান ঠিক করে নেবেন। ডাউনলোড: https://www.omicronlab.com/avro-keyboard-download.html

  2. vibek basak Avatar
    vibek basak

    অনবদ্য
    ভালো থাকবেন

Leave a Reply to vibek basakCancel reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers