কান ফাটানো শব্দ এবং তার চেয়ে বেশী কিছু

লেখাটি , , বিভাগে প্রকাশিত

জেট ইঞ্জিন কিংবা নিউক্লিয় বোমার আঘাত এদের কোনটির শব্দ বেশী জোরালো? পৃথিবীতে এসবের সৃষ্ট শব্দই কি সবচেয়ে জোরালো? সম্ভাব্য সবচেয়ে তীব্র শব্দ কতটা তীব্র হতে পারে বা তীব্রতার কি কোনো নির্দিষ্ট সীমা আছে? চলুন দেখা যাক।

শব্দ হলো একপ্রকার চাপীয় তরঙ্গ যা কোনো মাধ্যমের, যেমন: বায়ুর মধ্যে এর অণুগুলোর নির্দিষ্ট স্থানে সংকোচন আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রসারণ এবং ক্রমশঃ সংকোচিত এলাকার অণুর প্রসারণ এবং প্রসারিত এলাকার অণুর সংকোচনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলে।  পরপর একটি সংকোচন ও একটি প্রসারণ মিলে একটি পুর্ণ স্পন্দন তৈরি করে। একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমে যেহেতু শব্দের বেগ নির্দিষ্ট তাই সম্পন্দের হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে কম্পাঙ্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এতে শব্দের তীক্ষ্ণতাও বৃদ্ধি পায়। প্রতি সেকেন্ডে সৃষ্ট কম্পাঙ্কের পরিমানকে আমরা হার্জ একক দ্বারা সূচিত করি। মানুষ সবচেয়ে কম ২০ হার্জের শব্দ থেকে সবচেয়ে বেশী ২০,০০০ হার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে পায়।

Untitled-1

অবশ্য শব্দের শক্তি শুধুমাত্র তীক্ষ্ণতা থেকে পাওয়া যাবে না। আমরা যখন গান শুনি তখন ভলিওম বাড়ালে বা কমালে শব্দের তীক্ষ্ণতা কম-বেশী হয় না। ড্রামের শব্দ অল্প ভলিওমে যেমন মোটা, বেশি ভলিওমেও একই রকম মোটা। একই ভাবে সিম্বলের তীক্ষ্ণ শব্দও ভলিওমের হ্রাস বা বৃদ্ধির সাথে একই রকম থাকে। পরিবর্তন হয় তীব্রতায়; তীব্রতা, যেই শব্দটি নিয়ে আমরা এই লেখাটি শুরু করেছিলাম। একই কম্পাঙ্কের শব্দের তরঙ্গের বিস্তার কম-বেশী হওয়ার সাথে সাথে তীব্রতা কম-বেশী হয়ে থাকে। একই কম্পাঙ্কের অপেক্ষাকৃত তীব্র শব্দের ক্ষেত্রে অনুগুলো একই গতিতে কিন্তু আগের চেয়ে অনেক প্রবলতার সাথে সংকোচন-প্রসারণ ঘটায় ফলে আমাদের কানের পর্দায়ও দোলা দেয় আরো জোরের সাথে এবং আমরা শব্দ আরো তীব্র ভাবে অনুভব করি।

শব্দের এই তীব্রতার পরিমাপ করা হয় ডেসিবেল এককে। এটি একটি লগারিদমিক একক যার ভিত্তি ১০। অর্থাৎ প্রতি একক তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শব্দ আসলে শক্তিতে ১০ গুণ করে বৃদ্ধি পায়। ১০ ফুট দূর থেকে মশার পাখা ঝাপটানোর শব্দের তীব্রতা ০ ডেসিবেল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথা বললে যে শব্দ শোনা যায় তা ৩০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। টেলিফোনের যে ডায়ালটোন শোনা যায় তা ৮০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। যদিও এখনো পর্যন্ত যেই ঘটনাগুলোর উল্লেখ করেছি এগুলো প্রায় শ্রবণ অযোগ্য শব্দ কিন্তু তারপরেও ডেসিবেল এককে বেশ দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দশগুণ করে বাড়ে বলে অপেক্ষাকৃত জোরালো শব্দগুলো আরো দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। যেমন: লনের ঘাস নিড়ানোর যন্ত্রের শব্দ তিন ফুট দূর থেকে ১০৭ ডেসিবেল কিংবা ব্যান্ড সঙ্গীতের কনসার্টের তীব্রতা ১১৫ ডেসিবেলের উপরে। ১২৫ ডেসিবেলের চেয়ে তীব্র শব্দে আমাদের কানে ব্যাথা শুরু হয়, একটি জেট ইঞ্জিনের ১০০ ফুট দূর থেকে ১৪০ ডেসিবেল তীব্রতার শব্দ অনুভূত হয় আর ১৮০ ডেসিবেল তীব্রতায় কানের শ্রবণটিস্যুর তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে।

কিন্তু এই তীব্রতার সীমা কত বা একটি শব্দ কতটা জোরালো হতে পারে? একটি শব্দ কতটা জোরালো হতে পারে তা নির্ভর করবে এর মাধ্যমের উপরে। একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমে শব্দ-তীব্রতার সর্বোচ্চ মাত্রা নির্দিষ্ট। একটি মাধ্যমে অণুগুলোতে যথেচ্ছা পরিমাণ সংকোচণ সৃষ্টি করা যায় কিন্তু শব্দ যেহেতু সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে চলে তাই প্রসারণের সময় তা পাশ্ববর্তী এলাকায় কি পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করতে পারবে তার উপর নির্ভর করবে শব্দের তীব্রতা সর্বোচ্চ কত হতে পারবে। তাই দেখা যায় সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতায় বাতাসের এই প্রসারণ চাপ হয় প্রতি বর্গইঞ্চিতে ১৪ পাউন্ড। এভাবে হিসেবে করলে বায়ু মাধ্যমে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ তীব্রতার শব্দ পাওয়া যায় ১৯১ ডেসিবেল। তবে ভিন্ন বস্তুর ক্ষেত্রে এই তীব্রতার সীমাও ভিন্ন হবে। যেমন পানির নিচে শব্দ ভয়াবহ রকমের জোরালো হতে পারে। প্রবল শব্দ সামুদ্রিক প্রানীগুলোর শিকারের অস্ত্রও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: পিস্তল শ্রিম্প (pistol shrimp) নামের একধরনের চিংড়ি ২১৮ ডেসিবেলের শব্দ তৈরির মাধ্যমে শিকারকে অসাড় করে দিতে পারে এবং তা করে খুব সহজে। এটি এর থাবার মাধ্যমে খুব দ্রুত পানি ছুঁড়ে মারে ফলে একটি পানিশুন্য ক্ষুদ্র অঞ্চল তৈরি হয়। পানিশূন্য হওয়ায় সেখানে পানির বাস্পচাপ কমে যায় এবং কিছুটা পানি বাস্পে পরিণত হয় ও পানির বাস্প থেকে একটি বুদবুদ উৎপন্ন হয়। যেহেতু সমুদ্রের গভীরে বিপুল পরিমান পানি উচ্চ চাপ তৈরি করে ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই বুদবুদটিতে প্রকান্ড চাপ পড়ে। যার ফলে অতিদ্রুত এটি গুটিয়ে যায় এবং এর মাধ্যমে এখানে খুব অল্প সময়ের জন্য বিপুল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটে। এই তাপমাত্রা সুর্যপৃষ্ঠের চেয়েও বেশি হতে পারে! তবে খুব অল্প সময়ের জন্য ঘটে বলে এতে শক্তির পরিমাণ খুব বেশী থাকে না তাই মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য আশঙ্কাজনক কোনো কিছু এর মধ্যে নেই।

এবারে বৃহৎ পরিসরের কিছু নিয়ে ভাবা যাক। কোনো কিছুর চাপ যখন এতোই বেশ হয় যে সেগুলো তরঙ্গে আমরা আর শব্দ বলতে পারি না বরং আমরা তখন এইধরনের তরঙ্গকে শকওয়েভ (shochwave) বলি এবং অন্য আরেকটি একক ‘রিখটার’ এর মাধ্যমে পরিমাপ করি। এই স্কেলটিও একটি লগারিদমিক স্কেল এবং প্রতি একক বৃদ্ধির সাথে সাথে তরঙ্গের তীব্রতা ১০ গুণ করে বৃদ্ধি পায়। তবে তরঙ্গ দশগুণ বৃদ্ধি পেলেও নির্গত শক্তির পরিমাণ ৩২ করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ১ একক বৃদ্ধির জন্য আমাদের তরঙ্গের মাত্রা জানার জন্য ১০ গুণ করে বাড়াতে হবে আর শক্তিমাত্রা এবং এর দরুন সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা নিরুপনের জন্য ৩২ গুণ করে বাড়াতে হবে। একটি বড় হাতে ছোঁড়া গ্রেনেড হতে উৎপন্ন শকওয়েভের তীব্রতা হয় ০.২ রিখটার। কিন্তু মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিস্ফোরিত পারমানবিক বোমা, জার বোমবা (Tsar Bomba) যে বিপুল পরিমান শক্তি নির্গত করেছিলো তা রিখটার স্কেলের ৮.২ মাত্রার ভুমিকম্পের সমান। সম্প্রতি জাপানের একটি ভুমিকম্পের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ৯ পর্যন্ত পরিমাপ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত রিখটার স্কেলে ১০ কিংবা তার বেশী তীব্রতার কোনো কিছু মানবজাতি পর্যবেক্ষণ করেনি তবে ধারনা করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর পুর্বে পৃথিবীপৃষ্ঠে যে গ্রহাণুর পতনে ডাইনোসরসহ ইঁদুর জাতীয় প্রানীর চেয়ে বড় সকল প্রানী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো তার আঘাত এতোই জোরালো ছিলো যে এটি রিখটার স্কেলে ১২.২৫ মাত্রা অতিক্রম করেছিলো।

আকাশে এসজিআর-১৮০৬-২০ এর অবস্থান
আকাশে এসজিআর-১৮০৬-২০ এর অবস্থান

একেবারে মাত্রাতিরিক্ত কিছু চিন্তা করতে হলে আমরা নক্ষত্র তরঙ্গের (star waves) কথা বিবেচনা করতে পারি। এই ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয় যখন নক্ষত্রের অন্তিম মূহূর্তে এটি হঠাৎ সংকুচিত হয় এবং নিউট্রন তারকায় পরিণত হয়। এই সময় এদের ঘনত্ব এত বেশী হয় যে একটি ছোট চা চামচ পরিমান নিউট্রন তারকার ভর হয়ে যায় সবচেয়ে বড় পিরামিড, গিজার পিরামিডের প্রায় ৯০০ গুণ! এই সংকোচনের ঘটনাকে পৃথিবীর ভূমিকম্পের সাথে তুলনা করাই যায় তবে এই দুয়ের তীব্রতার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। ২০০৪ সালে এধরনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি পর্যবেক্ষন করা হয়েছিলো যখন একটি নক্ষত্র, ম্যাগনেটার এসজিআর-১৮০৬-২০ (Magnetar SGR-1806-20) এই ধরনের একটি নাক্ষত্রিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলো। এর তীব্রতা পরিমাপ করা হয়েছিলো রিখটার স্কেলের ২২০.৭। এই ঘটনা পৃথিবী থেকে ৫০০০০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে ঘটেছিলো। তবে যদি এধরনের ঘটনা পৃথিবীর আরো কাছাকাছি ঘটে যেমন: ধরা যাক ১০ আলোকবর্ষ দূরেও যদি ঘটে তারপরেও এই দূরত্ব হবে ৯৬ লক্ষ কোটি কিলোমিটার এবং এত দূরে থেকেও এই ঘটনা পৃথিবীতে একটি গণবিলুপ্তি ঘটনানোর মত যথেষ্ট তীব্র হবে।

[মাইকেল স্টিভানের Loudest Possible Sound ভিডিও অবলম্বনে]

লেখাটি 1,628-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. অনেক ভালো লাগল। তথ্যবহুল লেখা। বিশেষ করে চিংড়ি মাছের ঐটুকু পড়ে অনেক অবাক হয়েছি!

    1. ধন্যবাদ।

  2. তরঙ্গের ভয়াবহ শক্তির উপর একটা ভয়াবহ পোস্ট!

    1. ধন্যবাদ।

  3. রাশেদ রাশিব Avatar
    রাশেদ রাশিব

    সহজবোধ্য আর প্রাঞ্জল একটি লেখা 🙂

    1. ধন্যবাদ।

  4. abu jakaria Avatar
    abu jakaria

    অনেক কিছু জানতে পারলাম, সেই সাথে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। শুভ কামনা।

    1. ধন্যবাদ। আপনার জন্যও রইল শুভ কামনা।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading