কোষ জীবদেহের একটা অপরিহার্য উপাদান এবং জীবদেহ গঠনের ক্ষুদ্রতম একক। বর্তমান পৃথিবীর সকল জীবই এক প্রকার কোষ থেকে বিবর্তন (Evolution) প্রক্রিয়ায় আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এজন্য পৃথিবীর সকল প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষ দ্বারা গঠিত। যদিও উদ্ভিদ বা প্রাণীর ক্ষেত্রে এই কোষের প্রকৃতি ভিন্ন আবার এককোষী এবং বহুকোষী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও কোষের গঠন ভিন্ন। তাহলে এখানে প্রশ্ন থাকে যে যদি এক ধরনের কোষ থেকেই পৃথিবীর সকল জীবের উদ্ভব হয় তাহলে জীবের ধরনভেদে কোষের এই ভিন্নতা কেন!
সত্যি বলতে এইসব প্রশ্নের অতি উত্তম ব্যাখ্যা থাকলেও সেটা দিতে গেলে আমাকে বেশ কয়েকটি বই লিখে ফেলতে হবে যা আপাতত করা যাচ্ছেনা। এই লেখাতে আমি কোষীয় বিবর্তনের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিয়ে আলোচনা করবো, অর্থাৎ একটা সাধারন আদিকোষ থেকে কিভাবে অপেক্ষাকৃত জটিল কোষের উদ্ভব হলো সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।
বর্তমানে প্রাপ্ত প্রায় সকল এককোষী জীব মুলত আদিকোষ দিয়ে গঠিত এবং সকল বহুকোষী জীব প্রকৃতকোষ দ্বারা গঠিত। আদিকোষের গঠন খুন সাধারন, যেমন একপর্দা কোষঝিল্লী, সাইটোপ্লাজম ও ক্রোমাটিন তন্তু নিয়ে গঠিত; অপরপক্ষে প্রকৃতকোষগুলো গঠনের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত জটিল, যেমন এক পর্দা কোষঝিল্লী, আন্তঃকোষিয় অঙ্গাণু, নিউক্লিয়াস (Nucleus), মাইটোকন্ড্রিয়া (Mitochondria), ক্লোরোপ্লাস্ট (Chloroplast) ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। যাহোক, আদিকোষ থেকে কিভাবে প্রকৃতকোষ এলো, এর পক্ষে বেশ কিছু থিওরি বিদ্যমান, তবে সবথেকে আলোচিত ও নির্ভরযোগ্য থিওরি হচ্ছে এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরি (Endosymbiotic Theory)। এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরি এটা বলে যে, প্রকৃতকোষ এবং আদিকোষ একসময় প্রায় অনুরুপ ধরনের কোষ ছিল এবং বিভিন্ন কোষের এন্ডোসিম্বায়োসিস এর মাধ্যমেই মুলত আদিকোষ থেকে প্রকৃতকোষের আবির্ভাব ঘটে।
একটি ব্যাপার এখানে পরিষ্কার করা প্রয়োজন – সাধারন অর্থে থিওরি মানে এমন কিছু ধারনা বুঝায় যা বাস্তবতার সাথে না মিলতেও পারে। অনেকেই কথায় কথায় বলে বসেন, থিওরি দিয়ে তো আর জীবন চলেনা কিন্তু বিজ্ঞান মতে থিওরি দিয়ে পুরা জগত চলে। বিজ্ঞানে থিওরি শব্দের অর্থ যেটা বাস্তবতা ও প্রমাণের আলোকে গৃহীত একটা অনুসিদ্ধান্ত যা কিনা যেকোন সময় প্রমাণ করা যায়। অর্থাৎ, থিওরি জিনিসটা বিজ্ঞান জগতে অনেক নির্মম দৃঢ় সত্য। ইউব্যাক্টেরিয়া হলো প্রাক পৃথিবীতে আদিকোষের মত আবির্ভুত আরেকটি কোষ যেটা একটু উন্নত ছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2020/11/how-endosymbiosis-happened.jpg?resize=960%2C720&ssl=1)
মাইটোকন্ড্রিয়া, ক্লোরোপ্লাস্ট ও ইউব্যাক্টেরিয়ার সহাবস্থান
আমার লেখাটি সহজে বোঝার জন্য বেশ আদিম এক পৃথিবীর কথা কল্পনা করুন যখন সেখানে উদ্ভিদ বা প্রাণীর বিবর্তন তখনো হয়নি; এমনকি প্রকৃতকোষের আবির্ভাবও হয়নি। প্রাক পৃথিবীর বৈরি পরিবেশে বিভিন্ন আকার-আকৃতির কিছু ব্যাকটেরিয়া-সদৃশ আদিকোষের আবির্ভাব ঘটে। এরা আজকের ব্যাক্টেরিয়ার (ইউব্যাকটেরিয়া) মত ততটা উন্নত ছিলনা। ধারনা করা হয়, প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য কিছু ব্যাকটেরিয়া অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে। কোষের মধ্যে ঢুকে এরা কোনভাবে বেচে যায় এবং পরবর্তিতে এভাবেই অভিযোজিত হয়। প্রায় ৩২০ কোটি বছর পুর্বে এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাব ঘটে যারা সুর্যের আলো এবং বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে খাদ্য উৎপন্ন করতে পারত এবং বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন মুক্ত করতো – এভাবে প্রথম ফটোসিন্থেটিক (Photosynthetic) ব্যাক্টেরিয়ার আবির্ভাব ঘটে।
যেহেতু তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেরাই তৈরি করতে পারে তাই এরা পরিবেশ থেকে খাবার গ্রহন করার প্রতি অনুৎসাহী হয়ে ওঠে ফলে একটা সময় পরিবেশ থেকে খাবার গিলে ফেলার ক্ষমতা এদের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যায়। ওদিকে বায়ুমন্ডলে কিন্তু অক্সিজেনের পরিমান বাড়তেই আছে। এখন অক্সিজেন যেহেতু কোষের জন্য ক্ষতিকর কারন বিভিন্ন অক্সিডেটিভ রেডিক্যালস কোষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, এজন্য এই ফটোসিন্থেটিক ব্যাক্টেরিয়াদের জন্য পরিবেশে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে এবং কালের বিবর্তনে তাদেরই কিছু অংশ অক্সিজেন যুক্ত পরিবেশে টিকে থাকার উপযোগী হয়ে ওঠে এবং অক্সিজেন ব্যবহার করে তারা শক্তি তথা এটিপি তৈরি করতে পারে। এভাবে চলতে থাকে এবং পরিবেশে অক্সিজেন যেমন বাড়তে থাকে তেমনি এদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর প্রায় ১৭০ কোটি বছর পর নতুন একধরনের কোষের আবির্ভাব ঘটে যারা প্রায় আদিকোষের মতই কিন্তু এদের মধ্যে সুগঠিত নিক্লিয়াস বিদ্যমান, এদেরকে বলা হয় প্রথম প্রকৃতকোষ। এদের একটি বড় সুবিধা হলো এরা পরিবেশ থেকে বিপুল পরিমান খাবার গিলে ফেলতে পারে এবং এজন্য এরা আকারেও বড় হতে থাকে। এই পর্যায়ে কিন্তু মোট তিন ধরনের কোষ পরিবেশে বিদ্যমানঃ ফটোসিন্থেটিক ব্যক্টেরিয়া, অক্সিজেন ব্যবহারকারী ব্যাকটেরিয়া এবং প্রকৃতকোষ।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2021/02/evolution_of_endosymbiosis.png?resize=640%2C300&ssl=1)
চিত্রঃ এন্ডোসিম্বায়োসিসের ফলে কোষীয় বিবর্তনের ফাইলোজেনেটিক ট্রি
একপর্যায়ে প্রকৃতকোষ ফটোসিন্থেটিক এবং এরোবিক ব্যাকটেরিয়াকে গিলে ফেলে। এতে অবশ্য প্রত্যেকেরই লাভ হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃতকোষ বাকিদের জন্য খাদ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তা প্রদান করে। আর ওদের উৎপন্ন শক্তিকে নিজে ব্যবহার করে। এটা প্রকৃতকোষের (হোস্ট) জন্য এক বিরাট সুবিধা ছিলো কারন আগে গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় সে পেতো মোট ৪টি এটিপি যার দুটি খরচ হতে নিট ২টি এটিপি থাকতো কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া গিলে ফেলার পর দেখা গেল তারা গ্লাইকোলাইসিস প্রকৃিয়ায় প্রাপ্ত পদার্থ দিয়ে এমন কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে যা থেকে মোট ৩৬-৩৮টি এটিপি উৎপন্ন হয় যার দুটি খরচ হয় এবং নিট লাভ হয় ৩৪-৩৬টি এটিপি। এই অতিরিক্ত শক্তি উৎপন্ন করতে পারার কারনে তারা প্রকৃতিতে আরো বেশি উপযোগী হয়ে উঠলো এবং বহু বছরের বিবর্তনে আজকের মত পরিনত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, তাহলে প্রাণী কোষের ক্লোরোপ্লাস্ট গেল কই! উত্তর হলো প্রাণীর কোষে কখনো ক্লোরোপ্লাস্ট ছিলনা। আসলে পার্পল এরোবিক অর্থাৎ আজকের মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ফটোসিন্থেটিক সায়ানোব্যাকটেরিয়া তথা আজকের ক্লোরোপাস্ট দুটি ভিন্ন সময়ে এবং এই কোষগুলোতে প্রবেশ করেছিলো। মানে আমি বলতে চাইছি, সর্বপ্রথম মাইটোকন্ড্রিয়া প্রকৃতকোষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে অভিযোজিত হয়, এরপর এই কোষগুলো থেকে দুটি ভিন্ন প্রকৃতকোষের উদ্ভব হয় যাদের একটি আজকের সকল প্রাণীর পুর্বপুরুষ এবং অন্যটি থেকে আজকের সকল উদ্ভিদের উদ্ভব হয়েছে। এই দ্বিতীয় প্রকৃতকোষে মূলত ফটসিন্থেটিক সায়ানোব্যাক্টেরিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং ধীরে ধীরে আজকের ক্লোরোপ্লাস্টে পরিনত হয়। যারা বুদ্ধিমান বা জীব কোষ সম্পর্কে ধরনা আছে তারা হয়তো ভাবা শুরু করেছে তাহলে ইউক্যারিওটিক কোষের অন্যান্য অঙ্গানুগুলাও এভাবে এসেছে কিনা! নাহ, এভাবে অভিযোজিত হয়নি তারা বরং কোষের বিভিন্ন ভাজ বা বিভিন্ন রকমের স্ট্রেস থেকে তৈরি হয়েছে, যেমন গল্গি বডি বা এন্ডপ্লাজমিক রেটিকুলাম, নিউক্লিয়াস ইত্যাদি।
মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট ব্যাক্টেরিয়া- এর পক্ষে প্রমাণ
এখন হুট করে বলে দিলেই তো হয়না, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্ট যে একসময় আলাদা সত্ত্বা ছিল এর প্রমাণ কি! বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে এমন অনেক জোরালো প্রমাণ পেয়েছেন যেগুলো এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরিকে আরো ধারালো করে তুলেছে। তেমনই কিছু ব্যাপার দিচ্ছি এখানেঃ
- মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্ট উভয়েরই নিজস্ব পৃথক জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল আছে যা সম্পুর্ন আলাদাভাবে রেপ্লিকেশন হয় এবং এই জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল ব্যাক্টেরিয়া কোষের মত বৃত্তাকার ডিএনএ, যাকে বলা হয় প্লাজমিড। কোষের মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের সম্পুর্ন আলাদা ভাবে টিকে থাকার ক্ষমতা আছে।
- আকৃতির দিক দিয়েও মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্ট ব্যাক্টেরিয়াদের সাথে সমতুল্য যা মূলত ১-১০ মাইক্রনের মত। যদি এদের আকৃতিতে অনেক বেশি পার্থক্য থাকতো তাহলে এই থিওরি মিথ্যা হয়ে যেত।
- উভয়েরই কোষঝিল্লি দুইস্তর বিশিষ্ট ফস্ফোলিপিড কোষঝিল্লী এন্ডোসিম্বায়োসিসের আরো একটি বড় উদাহরন, কারন পার্পল এরোবিক এবং ফটোসিন্থেটিক উভয় ব্যাকটেরিয়ার কোষেই একপর্দা ফসফোলিপিড কোষঝিল্লী থাকে। যেটা এখনকার মাইটোকন্ড্রিয়া বা ক্লোরোপ্লাস্টের ভিতরের দিকের কোষঝিল্লীর অনুরুপ।
তাহলে প্রশ্ন থাকে যে, মাইটোকন্ড্রিয়া বা ক্লোরোপ্লাস্টে দুই স্তর কোষঝিল্লী এলো কোথা থেকে? হুম, যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন, উত্তর হলো বাইরের দিকের দ্বিতীয় ঝিল্লীটি এসেছে মূলত ইউব্যাক্টেরিয়ার কোষঝিল্লী থেকে। এটা হয়েছিল যখন ফ্যাগোসাইটোসিসের মাধ্যমে ইউব্যাক্টেরিয়া পার্পল এরোবিক ব্যাক্টেরিয়াকে গিলে নিয়েছিল। নিচের চিত্র থেকে এটা সহজেই বোঝা যাবে।
![](https://i0.wp.com/www.biology.iupui.edu/biocourses/N100/images/018f2.gif)
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2020/11/evolution_of_membrane-1.jpg?resize=685%2C358&ssl=1)
চিত্রঃ দুইস্তর বিশিষ্ট ফস্ফোলিপিড ঝিল্লীর উৎপত্তি
কিছু কথা হোক মজার
এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ মজার কথা বলি, বিভিন্ন কারনে আমাদের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ক্রোমোজোম তথা জিনগুলোর দ্রুত পরিবর্তন হয় ফলে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে জিনের বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। এই পরিবর্তন হওয়ার প্রধান কারণ আমাদের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত জিনের অর্ধেক আমরা পাই মায়ের কাছ থেকে আর বাকি অর্ধেক পাই বাবার কাছ থেকে কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়া পাই শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে তাই মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনের পরিবর্তনও অনেক কম হয়। মাইটোকন্ড্রিয়ায় অবস্থিত জিনের পরিবর্তন খুব ধীরে হয় ফলে প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে এদের বৈচিত্রতা অনেক কম। একারনে একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতি জেনেটিকালি কতটা দূরে সেটা নির্ণয় করার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াল জিন নিয়ে তুলনা করা হয়। এভাবে আমাদের আদি মাতা কে এবং কত পুর্বে তার অস্তিত্ব ছিল সেটাও অত্যন্ত সফলতার সাথে নির্ণয় করা হয়েছে এবং আমাদের উৎপত্তিস্থল এবং সেখান থেকে কিভাবে পুরো পৃথিবী ছড়িয়ে পড়েছি তারও ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে।
![Migration Patterns](https://i0.wp.com/learn.genetics.utah.edu/content/cells/organelles/images/migration-patterns.jpg)
চিত্রঃ মানুষের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার মাইটোকন্ড্রিয়াল ম্যাপ
তথ্যসুত্রঃ
Endosymbiosis – The Appearance of the Eukaryotes
Endosymbiosis – The Appearance of the Eukaryotes
Endosymbiotic Theory
Symbiogenesis
Evidence for endosymbiosis
http://users.rcn.com/jkimball.ma.ultranet/BiologyPages/E/Endosymbiosis.html
Evidence for the Endosymbiotic Hypothesis
Leave a Reply