পূর্ববর্তী লেখা “মস্তিষ্কের কর্মকান্ড: অভ্যন্তরীণ বাচন (১)” এর পর থেকে।
এই যে এই পোস্টটি দেখার পর আপনি মনে মনে বলছেন, “বিজ্ঞান ব্লগের নতুন পোস্ট!”- এই মনে মনে কথা বলাই Inner speaking বা অভ্যন্তরীণ বাচন। গতো পোস্টে এই বিষয়ে অল্প কিছু তথ্য জেনেছিলাম আমরা। আর আজ অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক বাচনের সম্পর্কের গল্প শুনবো। এ গল্প যেমন একদিকে এদের ভেতরকার সম্পর্কের বয়ান দেয়, তেমনই একসাথে বলে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী মনের কথা। Inner speech বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা শুরুতেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, একে বুঝতে গেলে এর জ্ঞাতিদের সম্পর্কে খোঁজ না নিলেই নয়। তাইতো তারা মনের গহীন কথা আর মুখ ফুটে বলা কথার সম্পর্কটা ঠিক কোন জায়গায় শুরু আর কোন জায়গায় শেষ তা বোঝার প্রচেষ্টা নিলেন। বিজ্ঞানীদের এই চেষ্টার ইতিহাস বেশ লম্বা, কিন্তু ভাবী বিজ্ঞানীদের জন্য পথপ্রদর্শক ও বটে।
প্রথমেই আমরা বলি বিজ্ঞানী ওয়াটসনের কথা। বিজ্ঞানী ওয়াটসন হাইপোথিসিস দাঁড়া করিয়েছিলেন, মনে মনে কথা বলার সময়ও বাহ্যিক বাচনে সাহায্যকারী অঙ্গসমূহের (যেমন- তালু, জিহবা, ফ্যারিংক্স) ব্যবহার ঘটে। এই মতামত আমাদের একটানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক বাচনের মোটাদাগের সমতার লাইনে।
কিন্তু, এটা ছিলো শুধুমাত্রই একটা মতবাদ। এটার সত্যতা যাচাইয়ের ভার নিলেন বিজ্ঞানী স্মিথের নেতৃত্বে একদল গবেষক। তাঁরা কিছু স্বেচ্ছাসেবীকে curare প্রয়োগ করলেন যাতে তাদের মাথা, ঠোঁট, চোয়াল এবং চোখের পাতার প্যারালাইসিস ঘটে। এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে এসব নাড়ানো অসম্ভব সেখানে ও কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রশ্ন শুনে, বুঝে, বাম ভ্রু নাড়ানোর মধ্য দিয়ে জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ থেকে বিজ্ঞানীরা বলেন, Inner speaking এ Talking out loud এর কারিগর (জিহ্বা, তালু) এসবের ভূমিকা নেই। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানীরা অভ্যন্তরীণ বাচন আর চিন্তাকে একই ধরে এই উপসংহার টানেন।
এতো গেলো একদিক দিয়ে Inner Speech এর রূপায়নের চেষ্টা। এখন এর শারীরবৃত্তীয় দিকগুলো লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা বিজ্ঞানীদের। তার জন্য তাঁরা বেছে নিলেন শ্বাস-প্রশ্বাসের হারকে। তাঁরা লক্ষ্য করলেন, মনে মনে ভাবার সময় শ্বাসক্রিয়ার হার < জিব নাড়ায়ে শব্দ না করে শ্বাসক্রিয়ার হার < কথা বলার সময় শ্বাসক্রিয়ার হার। এই পরীক্ষা এবং আরোকিছু পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীদের দলনেতা কনরাড উপসংহার টানলেন, শ্বাসক্রিয়ার হারের ধারাবাহিক বৃদ্ধি আসলে মনে মনে কথার বলার সময় মস্তিষ্কের শব্দ সৃষ্টির মোটর কার্যক্রমের অনুপস্থিতি এবং এর পরে শব্দ করে কথা বলার সময় এই কার্যক্রমেরই সাক্ষ্য দেয়। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো, বিজ্ঞানীরা একসময় ভাবলেন, অভ্যন্তরীণ বাচন আর মুখ নিঃসৃত বাণীর প্রক্রিয়া একই, শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ বাচনের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের শব্দ (জোরে) তৈরির প্রক্রিয়া অনুপস্থিত।
সোজা কথায়, অভ্যন্তরীণ বাচন = বাহ্যিক বাচন – জোরে শব্দ তৈরির প্রক্রিয়া। তবে এ ব্যাপারটা অতি সরলীকরন দোষে দুষ্ট। আমাদের Inner speech সাথে Outer speech এর সম্পর্ক এতো একরৈখিক না। এ মতবাদে Vygotsky এর বলা একটি উদাহরণ টানা যাক। ধরুন, আপনার বাসার পাশের রাস্তায় হঠাৎ ধুপ করে শব্দ হলো। আপনি জানেন, পাশের বাসায় একটি বিড়াল আছে, যে প্রায়ই রাতে এধরনের অঘটন ঘটায়। আগের জমা এই তথ্যের আলোকে আপনার মস্তিষ্ক বলে উঠবে, “বিড়াল!” খুব কমক্ষেত্রেই বলবে, “পাশের বাসার বিড়াল এই কান্ড ঘটালো।” এই যে বাক্যের সংকোচন (Condensation) এটাও মগজ ঘরের কথার একটি অনন্য রূপ।
এবার চোখ দেওয়া যাক স্নায়ুবিজ্ঞানীরা কি বলছেন তার দিকে। মস্তিষ্কের ইমেজিং পদ্ধতিতে দেখা যায়, উভয় ক্ষেত্রেই মস্তিষ্কের ভাষার রাজ্য (যেমন-ব্রংকাস এরিয়া) উদ্দীপ্ত হয়। কিন্তু, বাহ্যিক বাচনের ক্ষেত্রে মোটর এবং সেরিব্রাল মোটর বেশি উদ্দীপ্ত হয়- যা কিনা মনের কথা জিহবার মাধ্যমে প্রকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত। স্নায়ুবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। তারা অভ্যন্তরীণ বাচন = বাহ্যিক বাচন – জোরে শব্দ তৈরির প্রক্রিয়া, এই সরল ফর্মূলায় বিশ্বাসী নন। তারা মনে করেন, Inner speech আরো বেশি কিছু। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, এক এক ধরণের Inner speech এ মস্তিষ্কের এক এক নিউরাল নেটওয়ার্ক উদ্দীপিত হয়। যেমন- কিছু গননা করার সময়, কোনো কবিতা ভাবার সময়, কোনো প্ল্যানিং করার সময়- প্রতিটি ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন অংশ কাজ করে।
তাইতো বিজ্ঞানীদের মতে অভ্যন্তরীণ বাচন আসলেই “সহজ কথা যায় না বলা সহজে” তবে তাঁরা মোটেও মস্তিষ্কের ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলী দেননি। নিত্য নতুনভাবে অভ্যন্তরীণ বাচনকে বোঝার চেষ্টায় তাঁরা মত্ত।
Leave a Reply