অণুজীব পরিচিতিঃ Clostridium tetani

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

ছোটবেলায় নানা রকম দুষ্টুমি করতে গিয়ে কত লোহা পেরেকের গুঁতো খেয়েছি। তখন যে কথাটি অবধারিতভাবে শুনতে হয়েছে তা হলো ‘লোহার গুঁতো খেলে কিন্তু টিটেনাস ইনজেকশন দিতে হবে’। এ অভিজ্ঞতা যে হয় নি তা নয়। লোহার গুঁতো খেয়ে ইনজেকশনের শরণাপন্ন আমাকে হতে হয়েছে। তখন যা জানতাম তা হলো ধনুষ্টঙ্কার হলে ঘাড় মটকিয়ে যায়। তাই ছোটবেলায় পেরেককে ভয় পেতাম খুব। মজার বিষয় হচ্ছে আজ এতদিন পর আমি সেই ধনুষ্টঙ্কারের জন্য দায়ী অণুজীব নিয়েই লিখতে বসেছি!

প্রথমে জানা যাক ধনুষ্টঙ্কার সৃষ্টিকারী অণুজীবের নাম টা কি? শিরোনাম থেকে বুঝতেই পারছেন মূল অপরাধী হলো Clostridium tetani. Kitasato Shibasaburo সর্বপ্রথম মানবদেহ থেকে C.tetani আলাদা করেন। C. tetani কিভাবে রোগ সৃষ্টি করে তা জানার আগে খোদ C. tetani এর সাথে একটু পরিচয় হওয়া যাক। C. tetani এর প্রথম পরিচয় এটি একটি গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া। এরা দেখতে রডের মত এবং এরা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বাঁচতে পারে না। এজন্য এদেরকে অবাত শ্বসনকারী (anaerobic) বলা হয়। এরা এমনিতে অধিক তাপ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কঠিন পরিবেশে এরা স্পোর সৃষ্টি করে।

স্টেইনিং পর C.tetani কে টেনিস রেকেটের মত দেখায়
স্টেইনিং পর C.tetani কে টেনিস রেকেটের মত দেখায়

মাটিতে, মানুষ ও পশুর পায়খানায় C.tetani  থাকে। তবে এটা এমনিতে শরীরে সংক্রমিত হয় না। শরীরের কোন জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হলে সেই ক্ষতের মাধ্যমে যদি C.tatani প্রবেশ করে তবে ধনুষ্টঙ্কার হয়। এরা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে সাড়া শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষত হওয়ার পর উপসর্গ দেখা দিতে সাধারণত কয়েক মাস সময় লাগতে পারে তবে গড়ে ৮ দিনের মত সময় লাগে। নবজাতকের ক্ষেত্রে তা গড়ে ৭ দিনের মত সময় লাগে। একটা অণুজীব শরীরে প্রবেশ করলেই রোগ সৃষ্টি করবে এমনটি কিন্তু না। প্রত্যেক অণুজীবের নিজস্ব উপাদান থাকে যার মাধ্যমে সে রোগ সৃষ্টি করে যাকে ইংরেজিতে বলে virulence factor. তো C.tetani এর ক্ষেত্রে সে উপাদানটি হলো একটি টক্সিন যার নাম টিটানোস্পাসমিন(Tetanospasmin)। আমাদের শরীরের পেশী সংকোচন করে এসিটাইলকোলিন। ইন্হিবিটোরি নিউরোট্রান্সমিটার এসিটাইলকোলিনকে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। ফলে পেশী স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। কিন্তু টিটানোস্পাসমিন ইন্হিবিটোরি নিউরোট্রান্সমিটারকে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। ফলে শরীরে অস্বাভাবিক পেশী সংকোচন দেখা দেয়।

প্রথম দিকের এ রোগের উপসর্গ হলো মুখের চোয়াল লেগে যাওয়া। যাকে ‘লক জ’ (Lock jaw) বলে। আর অন্যান্য উপসর্গগুলো হলো খিঁচুনি, খাবার গিলতে সমস্যা হয়, উচ্চরক্তচাপ,ঘাম,জ্বর। পেশীর অত্যাধিক সংকোচনের ফলে স্পাইনাল কর্ড কিংবা শরীরের হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে। সাথে শ্বাস প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ধনুষ্টঙ্কার চার ধরণের হতে পারে।

এর একটা হলো সাধারণ ধনুষ্টঙ্কার। আমরা ধনুষ্টঙ্কার বলতে যা বুঝি মূলত এটা সেটাই। এটা আক্রান্ত স্থান থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রথম উপসর্গ হলো ‘লক জ’ বা চোয়াল লেগে জাওয়া। আসতে আসতে বাকি উপসর্গগুলো প্রকাশ হয়। সাধারণ ধনুষ্টঙ্কার থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক মাস সময় লাগে।

ধনুষ্টঙ্কারে খিঁচুনি হয়। এই ছবিটা এঁকেছিলেন Sir Charles Bell

দ্বিতীয় ধরণের ধনুষ্টঙ্কার হলো লোকালাইজড (Localized) ধনুষ্টঙ্কার। এর মানে হলো আক্রন্ত স্থানেই এই ধনুষ্টঙ্কার সীমাবদ্ধ থাকে । এই ধনুষ্টঙ্কার খুবই কম হয়। এই রোগ থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে।

তিন নম্বর ধনুষ্টঙ্কারটি হলো সেফালিক (Cephalic) ধনুষ্টঙ্কার। এটাও এক ধরণের লোকালাইজড ধনুষ্টঙ্কার। এটা আমাদের ক্রেনিয়াল (Cranial) নার্ভকে আক্রান্ত করে। ফলে এতে আমাদের মুখের পেশী আক্রান্ত হয়।

আর সর্বশেষ ধনুষ্টঙ্কারটি হলো নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার। জন্মের পর যখন নাড়ি কাটার সময় যদি জীবাণুযুক্ত কাচি ব্যবহার করা হয় তখন এ রোগের সঙ্ক্রমণ হয়। কিছু কিছু সংস্কৃতিতে নাড়ি কাটার পর তাতে গরুর গোবর দেয়া হয়। কি সাঙ্ঘাতিক! এ যেন দাওয়াত দিয়ে ধনুষ্টঙ্কার ডেকে নিয়ে আসা! যদিও এই রোগ ধিরে ধিরে কমছে তবুও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও এই রোগের হার অনেক।

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ধনুষ্টঙ্কার নির্ণয় করা যায় না। ধনুষ্টঙ্কার রোগ নির্ণয় মূলত উপসর্গ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে করা হয়। কারণ C.tetani  চিহ্নিত করা। আক্রান্ত ব্যক্তির শুধুমাত্র ৩০% এর ক্ষেত্রে C.tetani শনাক্ত করা যায়। এমনকি সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রেও C.tetani  চিহ্নিত হতে পারে। যেটা আমাদের ভুল নির্ণয় দেখাবে। ধনুষ্টঙ্কার নির্ণয়ের আরেকটি উপায় হলো স্পাটুলা টেস্ট (Spatula test)

ধনুষ্টঙ্কার প্রতিরোধের জন্যে Tetanus toxoid টীকা নেয়া হয়। CDC এর মতে প্রতি দশ বছর পর পর ধনুষ্টঙ্কারের টীকা নেয়া উচিত। ধনুষ্টংকার চিকিৎসার জন্যে metronidazole , diazepam ব্যবহার করা হয়। শুরুতে পেরেক আর ধনুষ্টংকার নিয়ে যে কথা বলেছিলাম সেক্ষেত্রে বলে রাখি পেরেক বা লোহা বিঁধলেই যে ধনুষ্টংকার হবে এমন কোন কথা নেই। ধনুষ্টংকার হতে হলে সেই পেরেকে C.tetani  থাকতে হবে!

(আগামী লেখায় থাকবে যক্ষ্মার রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব Mycobacterium tuberculosis নিয়ে)

পুনশ্চঃ কেন জানি ইন্টারনেটে C.teatani  নিয়ে খুব বেশি একটা পেলাম না! তাই লেখার কিছু কিছু অংশ হয়তো প্রায় অনুবাদের মত হয় গেছে। সেক্ষেত্রে লেখার সেই অংশটুকুর স্বত্বাধিকার নাম না জানা সেইসব লেখকদের।

লেখাটি 273-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো, ছোটবেলায় এটা নিয়ে বেশ ভয় ছিল।

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      ধন্যবাদ।

  2. লেখাটা ভালো লাগলো। শুরুটা করেছো ব্যক্তিগত কথা দিয়ে … এটা একটা দারুণ স্টাইল। সামনের লেখাগুলোতে এরকম একটু ইনফর্মাল রেখো। আর দেখো দুয়েকটা গল্প দেয়া যায় কি না, মানুষ কাঠখোট্টা তথ্যের চেয়ে গল্প বেশি পছন্দ করে। যেমন titenus story দিয়ে গুগলে সার্চ দেয়ার পড় এ লিঙ্কটা পেলাম: http://www.dairygoatjournal.com/84-1/amanda_stout/
    আমরা নিদেনপক্ষে একটা ই-বই চাই, আর হার্ড বুক হলে আরো ভালো। সিরিজ চলুক।

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      অনেক ধন্যবাদ 🙂 পরবর্তী লেখায় পরামর্শগুলো মাথায় রাখবো!

  3. ওহ আচ্ছা, ধনুকের আকৃতির সাথে সম্পর্কিত বলেই তাহলে এই নাম!
    চলুক সিরিজটা…

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      ধন্যবাদ রুহশান ভাই 🙂

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers