বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ কেন গুরুত্বপূর্ণ? মূলধারায় বিজ্ঞান চর্চা বলতে গবেষণা বোঝানো হয়। তবে বিজ্ঞান চর্চাকে কেবল গুরুগম্ভীর গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে বড় ভুল হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন, সাহিত্য চর্চার তিনটি কান্ড রয়েছে। প্রথমত জ্ঞানকান্ড, দ্বিতীয়ত রসকান্ড, তৃতীয়ত কর্মকান্ড। সাহিত্যচর্চায় ‘জ্ঞান’ ও ‘রস’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনিই তিনি ‘কর্মকান্ড’ অর্থাৎ সাহিত্যচর্চার বিভিন্ন আয়োজন-সংগঠনকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। একই কথা বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও বলা যায়। যদি সমাজে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ ঠিকমতো না হয়, তাহলে সে পটভূমিতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হওয়া দুষ্কর। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানবোধ তৈরি করা ভীষণ জরুরী। বিশেষ করে নবীন ও তরুণ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ক কৌতুহল উস্কে দেয়া ও নানাবিধ কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের আগ্রহ জিঁইয়ে রাখাটা দরকার। বিজ্ঞানবোধের হাত ধরে আসে পরমতসহিষ্ণুতা, যু্ক্তি দিয়ে যুক্তি খন্ডানোর সংস্কৃতি। বিজ্ঞানবোধ কোন পূর্বসংস্কারের বশীভূত না হয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করে মতামত প্রদানকে উৎসাহিত করে। একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ গঠনে এ বিষয়গুলোর ভূমিকা অপরিসীম।
কিন্তু আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে বিজ্ঞানের খুব সাধারণ বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা কি রকম? এ প্রেক্ষিতে রাজশাহীতে সেখানকার অনুসন্ধিৎসু চক্রের শাখা সাধারণ মানুষের মহাকাশ জ্ঞান নিয়ে একটি জরিপের কথা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। সেই জরিপের প্রতিবেদন থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি:
সাধারণ মানুষের মহাকাশ বিষয়ক জ্ঞান কতটুকু সঠিক তা যাচাই করার জন্য অনুসন্ধিৎসু চক্রের উদ্যোগে আমরা আজকে রাজশাহী মহানগরের সাহেব বাজার, সোনাদিঘী মোর, পদ্মাপাড়, আলুপট্টি ও এদের আশপাশের এলাকায় গিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করি। সেখানে ৯ বছর বয়সী স্কুল ছাত্র থেকে ৭০ বছর বয়সী পুরুষ এবং নারী সবাইকে আমরা ৩ টি খুব সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম।
প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ
১) ক) পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে? নাকি খ) সূর্য পৃথিবীর চার দিকে ঘোরে?
২) তারা আলোকিত হয়- ক) নিজের আলোয়? নাকি খ) সূর্যের আলোয়?
৩) চাঁদ আলোকিত হয়- ক) নিজের আলোয়? খ) সূর্যের আলোয়?
আমাদের জরিপে অংশ নেওয়া সব বয়সের ৫১ জনের মধ্যে ৭৫% মানুষ ১ নাম্বার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে। যেখানে ২ নাম্বার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে মাত্র ৪৫% এবং ৮৬% মানুষ ৩ নাম্বার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল। আমরা এই পরিসংখ্যানের হিসাবটাকে যদি পুরুষ এবং মহিলা এই ভিত্তিতে ভাগ করে ফলাফল বিশ্লেষণ করি তাহলে একই ফলাফল দেখা যায়, অর্থাৎ নারী পুরুষে এই ব্যাপারে জ্ঞানের কোনো ভেদাভেদ নেই।
যেহেতু বয়সের ভিত্তিতে সবাইকে নিয়ে এই জরিপ করা, তাই স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ জন, তাদের মধ্যে ১৩ জন প্রথম প্রশ্নের উত্তর সঠিক দেয়, শুধুমাত্র ৪৭ ভাগ বা ৭ জন ২ নাম্বার প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে বলতে পেরেছিল। একজন বাদে বাকি ১৪ জনই ৩ নাম্বার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল। ছেলে এবং মেয়ে বিবেচনা করে জরিপ বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় ফলাফল একই।
এই জরিপ খুবই অল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ে করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে থেকে এই উপসংহারে আসা যেতে পারে যে দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি স্কুলের ছেলেমেয়েদের বেশীর ভাগেরই অজানা যে তারকা বা নক্ষত্র আসলে কি জিনিস। কিংবা বলা যেতে পারে যে সূর্য এবং রাতের আকাশের তারকা/নক্ষত্র যে একই ধরনের এবং এদের নিজস্ব আলো আছে, এই বিষয়ে মোটামুটি বেশীরভাগই অজ্ঞাত। অবাক করার মত হলেও সত্য যে এই দেশের সাধারণ মানুষদের এখনো একটি অংশ রয়ে গেছে যারা জানেনা যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।
আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের কোন একটা অংশ নিয়ে খুব ছোট রকমের বিজ্ঞান ভিত্তিক একটা জরিপ করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা। সেই বিবেচনায় এটি ছিল ক্ষুদ্র উদ্যোগ মাত্র। ভবিষ্যতে আমরা আর বড় আকারে এই কাজটা করার আশা রাখি। জরিপকাজে সহযোগিতা করেছে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অব রুয়েটের সদস্য মেহেদী হাসান ইমরান , তাসনিম তামান্না,তাহসিন মাসরুর, বদরুদ্দোজা শামীম, প্রাঙ্গন দাস, মীম নাজ রহমান, মাহমুদ বাপ্পী, অনন্যা ডরিস, তাসনিম মোহনা, আতিকুর রহমান এবং এই জরিপ কাজে উৎসাহ ও পরামর্শ প্রদানের জন্য ড. দীপেন ভট্রাচার্য স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
(বাপ্পী রহমান)
যদিও এটা খুব ছোট একটা জরিপ, তবুও এখান থেকে বাংলাদেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ যে কতটা জরুরী তা উঠে আসে। জরিপের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে যে স্কুলের বিজ্ঞানশিক্ষা যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য বিজ্ঞান ক্লাবগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে গিয়ে কাজ করতে পারে। এক সময় বাংলাদেশে প্রায় চার শতাধিক বিজ্ঞান ক্লাব থাকলেও এখন এ সংখ্যাটি কমে এসেছে হাতে গোনা কয়েকটিতে [1]। তবে আশার কথা, সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুনরায় বিজ্ঞান ক্লাব চালু হচ্ছে। এছাড়াও অনলাইনে বিজ্ঞান ভিত্তিক কয়েকটি ফোরামের সক্রিয়তা লক্ষ্যণীয়। এদের মধ্যে আছে অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠন, বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি, জিরো টু ইনফিনিটি, ওমেগা প্রাইম, বিজ্ঞান পত্রিকা, বিজ্ঞানবিশ, বিজ্ঞানযাত্রা, বিজ্ঞান পাঠশালা, ঢাকা ইউনিভার্সিটি সায়েন্স সোসাইটি, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি সায়েন্স ক্লাব, সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনা ইত্যাদি। আশা করা যায় অাবারো বাংলাদেশে বিজ্ঞান আন্দোলন জোড়দার হবে।
তথ্যসূত্র
[1] বিজ্ঞান ক্লাব।
Leave a Reply