“তোমরা যে বলো দিবস রজনী, ভালোবাসা, ভালোবাসা/ সখী ভালোবাসা কারে কয়?” “তোরা যে যা বলিস ভাই”-ভালোবাসা একটি শারীরবৃত্তীয় রাসায়নিক প্রক্রিয়া।
হ্যাঁ, এর হরেকরকম ব্যাখ্যা থাকতে পারে, দিক থাকতে পারে, কিন্তু এর রাসায়নিক দিকটি উড়িয়ে দেওয়ার দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন তাহলে ঘুরে আসি এক লম্বা সফরে; বিজ্ঞানীগণ ভালোবাসা নিয়ে কী বলেন-জেনে আসি। তবে এই যাত্রায় যাওয়ার আগেই বলে রাখি আমরা এই যাত্রাপথকে-প্রেমের আবেগ, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের উদ্দীপতা এবং হরমোনঘটিত পরিবর্তন-অনুযায়ী তিন পর্বে ভাগ করে তবেই আগাচ্ছি।
প্রথম পর্বঃ প্রেমে পড়া
আপনাদের ঐ গল্পটা জানা আছে? ঐ যে এক ছাত্র পরীক্ষার জন্য শিখে গেলো “ধান”-রচনা, কিন্তু পরীক্ষায় আসলো “রেলভ্রমণ”। ছাত্র লেখা শুরু করলো, “রেলে চড়ে আমরা একবার মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। আদিগন্ত বিস্তৃ্ত ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে চলার সময় রেল লাইনচ্যুত হয়ে পড়লো ধানক্ষেতের মাঝে। সোনালী রঙ্গে ভরা সেই ধানক্ষেত হরেক ধানে পরিপূর্ণ। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-আউশ, আমন, বিরি ইত্যাদি। এই ধান আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। …………”
প্রেমের প্রথমদিকে আমাদের আচরণ ও ঠিক এরকমই হয়ে যায়। নিজে প্রেমে পড়লে বা ঘনিষ্ঠ কোনো প্রেমাক্রান্ত বন্ধুকে লক্ষ্য করলে দেখবেন, এই সময় আমরা/তারা নিজের ভালবাসার মানুষটির কথা বলা বা ভাবা ছাড়া আর তেমন কিছু করতে পারি না/পারে না। এই সময়টায় আমাদের প্রতিদিনকার ছোটোখাট কাজকর্মে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়াটা ও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা আমাদের আমজনতার কাছে যতোটা রোমান্টিক, স্নায়ুবিজ্ঞানীদের কাছে ঠিক ততোটাই মানসিক অসংলগ্নতার সমার্থক। এমনকি অনেক বিজ্ঞানীরা ভালোবাসাবাসির প্রথম প্রহরগুলোকে “Obsessive Compulsive disorder”- নামক খটোমটো মানসিক ব্যাধির সাথে তুলনা করতে ও পিছপা হন না। এতো গেলো কথার কথা, কিন্তু আসলেই কি বিজ্ঞানীদের কাছে এ ব্যাপারে প্রমাণ আছে? দুঃখের কথা- আছে। বিজ্ঞানী ভন স্টিন-বার্গেন এবং তার দল ৪৩ জন সদ্য প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন এমন ছাত্র-ছাত্রীর (২৩ জন ছাত্রী, ২০ জন ছাত্র) উপর পরীক্ষা চালান। তারা কী গভীর প্রেমে নিমগ্ন তা বুঝতে প্রথমে বিজ্ঞানীরা সাহায্য নেন-“Passionate Love scale”-এর (হ্যা, এরকম একটা স্কেল আছে বৈকী!) এরপর আসল পরীক্ষায় যাবার আগে পরীক্ষণপাত্রদের কিছু রোমান্টিক গান শোনানো হয় এবং তাদের সঙ্গীর সাথে কাটানো ভাল মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতে বলা হয়। সকল ভাবাভাবি, গান শোনানো শেষে তাদের কিছু কাজ করতে দেওয়া হয় যেখানে তাদের নিজ নিজ চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অসংখ্য অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য,সংখ্যা,চিহ্ন এর ভেতর থেকে সংগতিপূর্ণ সবকিছু বেছে নিতে হবে। এই পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, যারা Passionate Love scale-এ উচ্চ নাম্বারপ্রাপ্ত তারা চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে কাজ করতে তুলনামূলক অপারদর্শী। এখন কি আপনি ভয় পেয়ে পুরো প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা শুরু করছেন? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। “Nothing lasts forever….”- আপনি সময়ের সাথে সাথে যতো বেশি সম্পর্কের পরিপক্কতার দিকে আগাবেন-আপনার বোধশক্তি ব্যবহার করে কাজ করার ক্ষমতা পুনরায় আগের মতো হয়ে পড়বে।
এই যে প্রথমের আকুলি-বিকুলি প্রেম, তারপর সময়ের সাথে সাথের স্বাভাবিকতা-এখানে কিউপিডের ভূমিকা কোথায় বলুন তো? উত্তর হচ্ছে, মানব প্রেমের ক্ষেত্রে এই ভালোবাসার তীর হাতে দেবতার কোনো ভূমিকাই নেই। আপনার এই সমস্ত অভিজ্ঞতার নিয়ন্ত্রক আপনার মস্তিষ্ক, যা এই কাজটা করে হরমোন নামক কিছু কেমিক্যালের মাধ্যমে। হরমোন সম্পর্কে সবাই মোটামুটি কম বেশি জানি, তাও কিছুটা বলে রাখি। হরমোন হচ্ছে আমাদের শরীরের বিভিন্ন রস বা কেমিক্যাল যা শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তনকালে পরিমাণগত ভাবে পরিবর্তিত হয় অথবা বলা যায় এদের পরিমাণগত পরিবর্তনের কারণে শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে।
প্রেমের প্রথম দিকে কর্টিসল নামক হরমোনের প্রভাব খুব বেশি থাকে। এই হরমোন নতুন বা অপরিচিত কিছু গ্রহণ করার প্রাথমিক যে ভীতি তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এইসময় সেরোটোনিন নামক এক নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ভালোবাসার প্রথম প্রহরের আচ্ছন্নতার পিছনে সেরোটোনিনের পরিমাণ কমে যাওয়া বড়ো কালপ্রিট হিসেবে কাজ করে।
এমনকি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের পরীক্ষা ও এই ঘটনার পক্ষে সাক্ষী দেয়। ফ্রন্টাল কর্টেক্স নামক মস্তিষ্কের অঞ্চল এই সময় হ্রাসকৃত কার্যক্ষমতা দেখায় যা কিনা আপনাকে আপনার সংগীর আচরণ, চরিত্র সঠিকভাবে যাচাই করার ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে; পড়িয়ে রাখে আপনাকে একটি রংগীন চশমা।
দ্বিতীয় ধাপঃ আবেগপূর্ণ ভালোবাসা
এই ধাপটা ভালোবাসার কিছুটা অস্থির পর্যায়ের পর কিছুটা স্থিরতা এনে দেয়। এই সময় নিরাপত্তা, দৃঢ়তা আর ভারসাম্য আসে সম্পর্কে। আবেগ থাকে;সাথে সাথে ঘনিষ্টতা, অংগীকার বাড়ে। কর্টিসল, সেরোটোনিনের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে আসে, অন্যদিকে অক্সিটোসিন আর ভেসোপ্রেসিনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই অক্সিটোসিন আর ভেসোপ্রেসিন করেটা কী?
পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসরণের পর এই হরমোনগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন রিসেপ্টরের বা গ্রাহক প্রোটিনের সাথে বন্ধন তৈরী করতে চায়। ভেসোপ্রেসিন আর অক্সিটোসিনের রিসেপ্টর বা গ্রাহক প্রোটিনগুলো থাকে মস্তিষ্কের এমন এক অঞ্চলে যা ভালোলাগার অনুভূতি তৈরির জন্য কাজ করে। যখন এই হরমোন আর রিসেপ্টরের মিলন ঘটে, ডোপামিন নামে আরেকটি নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ হয় এবং প্রেমিক যুগল আনন্দ, প্রাণপ্রাচূর্্যে ভরে উঠে।
অক্সিটোসিন আর ভেসোপ্রেসিন যে একদম একই কাজ করে তা কিন্তু না। নারীদের অক্সিটোসিন তুলনামূলক বেশি থাকে এবং তা সংগীর সাথে নিবিড় বন্ধনে জড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, পুরুষদের বেশি থাকে ভেসোপ্রেসিন-যাকিনা যে কোনো ভীতিকর, চাপদায়ক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্য করে।
একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন,এই হরমোনগুলো আদিকাল থেকে চলে আসা মাতাপিতা-সন্তানের ভালোবাসার পেছনে ও ভূমিকা রাখতো। যেখানে মা বাচ্চার যত্ন নিতেন এবং বাবা বাচ্চার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন।
তৃতীয় ধাপঃ “আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে”
সব সম্পর্ক অবশ্য বিষাদে শেষ হয় না। তবে আজ আমরা এই দিকটা নিয়েই একটু আলোচনা করি।
আপনাদের কখনো এমন হয়েছে- দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার বুকে ব্যথা? (গায়ক আসিফের গানের বুকের ব্যথা না, আক্ষরিক অর্থেই বুকের ব্যথা) এমনটি হয়ে থাকলে জেনে রাখুন, এ আপনাদের মনের ভুল নয়। বিজ্ঞানীরা আমাদের জানাচ্ছেন, শারীরিক ব্যথার সময় মস্তিষ্কের যে নেটওয়ার্কগুলো কাজ করে মানসিক ব্যথার সময় ও ঠিক একই নেটওয়ার্ক উদ্দীপ্ত হয়, তাই তখন এরকম বুকে ব্যথা হতে পারে, যা কিনা মোটে ও “বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা”-নয়। যেকোনো বিষয়ে বিলম্বে সাড়া দেওয়ার মতো মানসিক পরিবর্তন ও ঘটে এসময়। এ্যাড্রেনালিনের মতো কিছু স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনের ঝুঁকিতে ভুগতে থাকেন বেশিরভাগ বিষাদগ্রস্ত যুবক-যুবতী।
অনেক হলো ভালোবাসার বৈজ্ঞানিক ব্যাখার গল্প। এখন স্টার্নবার্গের ( ভালোবাসার ত্রিভুজতত্ত্বের প্রবক্তা) একটি মতামত দিয়ে শেষ করি। চিরস্থায়ী সুখের ভালোবাসার সম্পর্ক নির্ভর করে আবেগ, ঘনিষ্টতা এবং অঙ্গীকার- এই তিনটি শব্দকে কাজে রূপান্তর করার মধ্যে। শুভকামনা সবার জন্য।
(লেখাটি জিরো টু ইনফিনিটি, ফেব্রুয়ারী ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)
Leave a Reply