ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির কিছু প্রাথমিক আলোচনা

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

জ্যামিতি গণিতের অত্যন্ত পুরোনো একটি শাখা। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০০ এর আগেও জ্যামিতির ব্যবহার ছিল। প্রথমদিকে জ্যামিতির ব্যবহার ছিল মূলত ভূমি পরিমাপে। কিন্তু আস্তে আস্তে এর বিকাশ ঘটে। প্রথমেই এক্ষেত্রে চলে আসে ইউক্লিডের নাম, যদিও ইউক্লিড একা এই জ্যামিতির প্রণেতা নন, পিথাগোরাস,আর্কিমিদিস, ব্রহ্মগুপ্ত, টলেমি প্রমুখের নামও জড়িয়ে আছে এতে। তবে ইউক্লিডই সর্বপ্রথম The elements এ এসব লিপিবদ্ধ করেন। আর আইজ্যাক নিউটন থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন সকলেই The elements এর প্রশংসা করেছেন। যাহোক, এই ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি আসলে বক্রতলে খাটানো যায় না। তাছাড়া ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ বেশ বিতর্কিত ছিল। যাহোক, সপ্তদশ শতাব্দিতে ডেকার্তে স্থানাঙ্ক জ্যামিতির সূচনা ঘটান। অতঃপর আরও অনেক প্রকার জ্যামিতিই তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে ডিফারেন্সিয়াল জ্যামিতি অন্যতম। বক্রপৃষ্ঠের জন্য ঐসকল জ্যামিতি বিশেষভাবে কার্যকর।

যাহোক, আমরা এবার মূলত কার্টেসিয়ান জ্যামিতি ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি পাঠ শুরু করব। তবে ভেক্টরের ধারণা কাজে লাগাবো।
ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে ত্রিভুজের ভরকেন্দ্র $$\left({x_1+x_2+x_3\over3},{y_1+y_2+y_3 \over 3},{z_1+z_2+z_3 \over 3} \right)$$ কি? মিল খুঁজে পাচ্ছেন? এরকম মিল আছে অন্তর্বিভক্তিকরণ ও বহির্বিভক্তাকরণ সূত্রেও! দূরত্ব নির্ণয়েও প্রায় একই সূত্র: $\sqrt{(x_1-x_2)^2+(y_1-y_2)^2+(z_1-z_2)^2}$। মজা পাচ্ছেন এবার?

দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিতে $ax+by+c=0$ একটি সরলরেখা। তেমনই ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে $ax+by+cz+d=0$ একটি সমতল। আচ্ছা বলুন তো 3D তে $x^2+y^2=1$ কিসের সমীকরণ? কল্পনা করে দেখুন, সমীকরণে যেহেতু $z$ নেই তাই $z$ যেকোনটি হতে পারে। কাজেই, এটি 3D তে দেখতে অসীম উচ্চতা বিশিষ্ট সিলিন্ডারের মতন। অর্থাৎ $xy$ সমতলে বৃত্তটি এঁকে তাকে উপরে নীচে অসীম পর্যন্ত বাড়ালে যা হবে আর কি! আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে যে ত্রিমাত্রিকভাবে সরলরেখার সমীকরণটি কীরকম, দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিতে $(x_1,y_1),(x_2,y_2)$ বিন্দুগামী সরলরেখা ছিল $${x-x_1\over x_1-x_2}={y-y_1 \over y_1-y_2}$$ তাহলে ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিতে $(x_1,y_1,z_1),(x_2,y_2,z_2)$ বিন্দুগামী সরলরেখা হল $${x-x_1\over x_1-x_2}={y-y_1 \over y_1-y_2} = {z-z_1 \over z_1-z_2}$$

এবার ধরুন আপনাকে দুটি সরলরেখা দিয়ে বললাম যে এদের ছেদবিন্দু কত? কী করবেন আপনি?
এখানে যে কথাটি না বললেই নয় তা হচ্ছে দ্বিমাত্রিকভাবে দুটি সরলরেখা সমান্তরাল না হলেই এদের ছেদবিন্দু থাকবে। কিন্তু ত্রিমাত্রিক ভাবে এই কথা সত্য না। বাসার আলমারির দিকে তাকান। দেখুন যে সরলরেখা দুটি একই সমতলে না থাকলে এদের ছেদবিন্দু থাকছে না। এখন ধরুন $x=y=z$ ও $x=y/4=z/2$ দুটি সরলরেখা। যদি সরলরেখার সমীকরণের আকারে এগুলোকে আনেন তবে দেখবেন যে $A(0,0,0), B(1,1,1), C(2,2,2)$ প্রথম রেখার ওপরে অবস্থান করে। তদ্রুপে দ্বিতীয় রেখার ওপর $D(1,4,2), E(2,8,4)$ অবস্থান করে।

এবার ভেক্টর $\mathbf{AB}, \mathbf{CD}, \mathbf{DE}$ নির্ণয় করে ফেলুন। যদি ভেক্টরত্রয় সমতলীয় হয় তবে রেখাদ্বয় একতলে অবস্থান করবে। এবার দেখুন, যে $\mathbf{AB}$ এবং $\mathbf{DE}$ ভেক্টর পরস্পর সমান্তরাল কিনা। যদি সমান্তরাল হয় তবেও ছেদিন্দু থাকবে না। অর্থাৎ যদি সরলরেখাদ্বয় সমতলীয় এবং অসমান্তরাল হয় তবেই এদের ছেদবিন্দু থাকবে। আমার দেয়া সরলরেখাদ্বয়ের ছেদবিন্দু বিদ্যমান। এখন, আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করি রেখাদ্বয়ের অন্তর্গত কোণ কত? খুব সোজা, যেহেতু $\mathbf{AB}$ এবং $\mathbf{DE}$ ভেক্টরদ্বয় রেখাদ্বয়ের সমান্তরাল তাই এদের ডটগুণ দ্বারা খুব সহজেই মধ্যবর্তী কোণ নির্ণয় সম্ভব। বলা বাহুল্য, কোণ দুটি পাওয়া যাবে।

এবার আমরা ছেদবিন্দু নির্ণয় করব।
ধরি, $x=y=z=k$,
আর অপর রেখাটির সমীকরণ থেকে পাই, $x=y/2$, বা $k=k/2$ অর্থাৎ $k=0$
তাহলে $x=y=z=0$ অর্থাৎ ছেদবিন্দু $(0,0,0)$

অর্থাৎ, একটি সমীকরণের সবগুলো চলককে একটি প্যারামিটারের সাহায্যে প্রকাশ করে অপর সমীকরণে বসাবেন। তারপর প্যারামিটারের মানটি পাওয়া গেলেই ছেদবিন্দু পাওয়া যাবে। (এই পদ্ধতি থেকেও বলে দেয়া যায় দুটো সরলরেখার ছেদবিন্দু থাকবে কিনা- তবে এটা চিন্তা করা আপনার দ্বায়িত্ব।)

এবার, আপনাদের বক্রতলের জন্য অভিলম্ব ও স্পর্শতলের ধারণা দেয়া যাক।
গ্রেডিয়েন্ট নিশ্চয়ই বের করতে পারেন। তাহলে $f(x,y,z)=c$ এর কোন বিন্দুতে অভিলম্ব হবে $\nabla f$ এর সমান্তরাল। যেমন, $x+y+z-5=0$ এর যেকোন বিন্দুতে অভিলম্ব $(\hat \imath + \hat \jmath + \hat k)$ ভেক্টরের সমান্তরাল (খেয়াল করুন যে সমতলের বেলায় $x,y,z$ এর সহগই $\hat \imath, \hat \jmath, \hat k$ এর সহগ)
তাহলে এই সমতলের $(1,2,2)$ বিন্দুতে অভিলম্বের ওপর $(x,y,z)$ কোন বিন্দু হলে, ${x-1\over 1}={y-2\over 1}={z-2\over 1}$ হবে।
অর্থাৎ $(1,2,2)$ বিন্দুতে অভিলম্ব সরলরেখার সমীকরণ $x-1=y-2=z-2$

আর এভাবে বক্ররেখারও কোন বিন্দুতে অভিলম্বের সমীকরণ নির্ণয় সম্ভব। আর ঐ বিন্দুতে অঙ্কিত স্পর্শতলের গ্রেডিয়েন্ট একই হবে। এই শর্ত দিয়ে স্পর্শতল পাওয়া যায়। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে $x^2+y^2+z^2=3$ একটি গোলক, যার কেন্দ্র মূলবিন্দুতে এবং ব্যাসার্ধ $\sqrt 3$. এর ওপর $(1,1,1)$ বিন্দুতে গ্রেডিয়ান্ট $2(\hat \imath + \hat \jmath + \hat k)$। তাহলে অভিলম্ব $x-1=y-1=z-1$,
তাহলে নির্ণেয় স্পর্শতলের সমীকরণ $ax+by+cz=d$ হলে $a=2,b=2,c=2,$ আর এটি $(1,1,1)$ বিন্দুগামী বিধায় $d=6$।
তাহলে স্পর্শতল $x+y+z=3$।

এই ধারণা কাজে লাগিয়ে দুটি সমতলের মধ্যবর্তী কোণও নির্ণয় সম্ভব। তবে এটি চিন্তা করা পাঠকের কর্তব্য।
পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, এই লেখাটি মূলত একাদশ শ্রেণির উপযোগী করে লেখা। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির অনেক বিষয় একজন কলেজ ছাত্র সহজেই বের করতে পারে। শুধু প্রয়োজন চিন্তন দক্ষতার উন্নয়ন, যার জন্য এই লেখা কতটুকু কাজে আসবে তা জানা নেই। তবে কিছু সমস্যাও যদি অন্তত কেউ সমাধানের অনুপ্রেরণা পায় এই লেখা থেকে তবেই আমি একে সার্থক মনে করব।

লেখাটি 1,522-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. বিষয়টা চমৎকার ও লেখার ভঙ্গিটাও ভালো লাগলো। আশা করি সামনে এধরণের লেখা আপনার কাছ থেকে আমরা নিযমিত পাবো।
    আমরা গাণিতিক সূত্র লেখার ক্ষেত্রে ল্যাটেক্স ব্যবহার উৎসাহিত করি। যেমন এই লেখাটি দেখেন: http://bigganblog.org/2016/06/%e0%a6%86%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%83-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a3-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%9a%e0%a6%a8-%e0%a6%b8/ । ল্যটেক্স ব্যবহার করার কারণে সমীকরণগুলো খুব সুন্দর লাগে। এছাড়া ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির মতো বিষয়ে ভেক্টর, সমতল ও বক্রতল বোঝানোর জন্য যেসব বিন্দু, লাইন ইত্যাদি উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলোর ছবি থাকলে সহজবোধ্য হবে।
    হ্যাপি ব্লগিং!

    1. I think there’s a problem in this URL you have given in your comment.

      1. আমিও তাই মনে করি।

  2. ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে এগুলো মাথায় রাখবো।

  3. লেখা সুন্দর হয়েছে। ঘন জ্যামিতি নিয়ে এরকম লেখা চালিয়ে যান। আরাফাত ভাইয়ের পরে আমিও বলছি, লেখায় ছবি হলে ভালো হতো। এর জন্য যে যে ছবি দরকার তা হাতেই আঁকা যায়, একটু সময় দিলে পেইন্টেও আঁকা যাবে। হাতে আঁকলে খাতার পাতার ছবি তুলেও তা ব্লগে যুক্ত করে দেয়া যায়।

    1. আসলে আমি ব্লগিং এ নতুন। কিভাবে ল্যাটেক্স ব্যবহার করতে হয় তা জানা নেই আমার। এটা কি HTML এর মতন?

  4. ল্যাটেক লেখা খুব সহজ এবং চমৎকার। আমিও কিছুদিন আগে শিখেছি। কিছুটা HTML ট্যাগের মতই।
    একটু কষ্ট করে আপনাকে প্রতিটি সমীকরণ ল্যাটেক কমান্ডের ভিতর লিখতে হবে। মানে সমীকরণের সামনে \$ ও পেছনে \$ চিহ্ন দিতে হবে। যেমন: $E=mc^2$ কে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে \$E=mc^2\$ লিখতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন গাণিতিক প্রতীক, চিহ্ন, অপারেটর প্রকাশের জন্য ল্যাটেকে নির্দিষ্ট কমান্ড আছে। ইন্টারনেটে সেগুলো খুঁজলে সহজেই পাবেন। আমি এখানে উইকিপিডিয়ার লিংক দিলাম- https://en.wikibooks.org/wiki/LaTeX/Mathematics

Leave a Reply to সিরাজাম মুনির শ্রাবণCancel reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers