যদি বলা হয “একজন হেঁটে যাওয়া ব্যক্তির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির বয়স বেশি বাড়বে”। – কথাটা কতটা গ্রহণ যোগ্য? ঠিক আছে প্রশ্নটায় পরে আসছি। তার আগে দুটি ঘটনা বলে নেওয়া যাক।
ঘটনা–১: পৃথিবীর কোথাও দুই বন্ধু ইভান ও বিভান বাস করে যাদের প্রত্যেকের বয়স ২০ বছর। ইভান রকেটে করে মহাকাশ ভ্রমনে বের হলো। তার রকেটের বেগ ছিল . 0.995c (এখানে c হচ্ছে আলোর বেগ 3.00 × 108 m/s অর্থাৎ রকেটের বেগ হবে 0.995 × 3.00 × 108 m/s = 2.985 × 108 m/s অর্থাৎ আলোর বেগের চেয়ে কিছু কম। এই রকেটে করে ইভান ৩ বছর মহাকাশে ভ্রমণ করল। ঠিক তিন বছর পর রকেটটা ঘুরিয়ে একই বেগে পৃথিবীতে ফিরে এল। যাওয়া আসায় ৬ বছরে ইভানের বয়স বেড়ে হয়েছে ২০+৬=২৬ বছর। কিন্তু পৃথিবতে এসে ইভান অবাক হয়ে দেখে বিভানের বয়স ৮০ বছর। শুধু বিভান নয় পৃথিবীর সব কিছুই তার চেয়ে ৬০ বছর এগিয়ে গেছে।
ঘটনা ২– একজন কৃষক তার 100m লম্বা খামার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আরেক ব্যক্তি 200m লম্বা একটা খুঁটি নিয়ে 0.866c বেগে খামার বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। খুঁটি সহ লোকটা খামার বাড়ির ভেতর ঢোকার পর কৃষক 5.77 ন্যানো সেকেন্ডের জন্য দুই দরজাই বন্ধ করে দিলো। এই অল্প সময়ের জন্য 200m রম্বা খুঁটিটা 100m খামারের মধ্যে এঁটে গেলো। কৃষক ঠিক 5.77 ন্যানো সেকেন্ডের জন্য খামারের দরজা দুটো খুলে দিলো। লোকটা খুঁটি সহ ছুটে বেরিয়ে গেল।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের শুরু যেখানে
স্যার আইজ্যাক নিউটন ১৬৮৭ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “Philosophiǽ Naturalis Principia Mathematica”প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তাঁর গতিবিষয়ক তিনটি সূত্র, মহাকর্ষ ও ক্যালকুলাস নিয়ে আলোচনা করেন। যা মানবজাতির জ্ঞানের জগতের একটা বিরাট অগ্রগতি। কিন্তু দিন দিন আরো অনেক নতুন প্রশ্ন জমা হতে থাকে যার ব্যাখ্যা নিউটনের বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর “স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি” প্রদান করেন। এই তত্ত্বের স্বীকার্য ছিল দু’টি।
১। একই বেগে গতিশীল কিংবা স্থির সব কিছুর জন্য পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম এক থাকবে।
২। শূন্য স্থানে আলোর বেগ গতিশীল বা স্থির যে কারও জন্য ধ্রুব।
আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের গানিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়–
ক) আলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল বস্তু। কোন কিছুর গতি আলোর গতির সমান বা বেশি হওয়া সম্ভব না। শুধুমাত্র ফোটনের মত ভরহীন কণার গতি আলোর গতির সমান গতি হওয়া সম্ভব।
খ) গতিশীল বস্তুর চেয়ে স্থির বস্তুর সময় দ্রুত চলে।
গ) গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘ্য তার গতির দিকে সঙ্কুচিত হয়।
ঘ) বস্তুর ভর ও শক্তি অভিন্ন জিনিস। ভরকে শক্তিতে, শক্তিকে ভরে রূপান্তর করা যায়। (E=mc2)
ঙ)স্থান কাল দুটি অভিন্ন জিনিস।
চ) গতিশীল বস্তুর ভর তার স্থির অবস্থার ভরের চেয়ে বেশি।
এবার প্রথম প্রশ্ন ও ঘটনা দুটির ব্যাখ্যা দেওয়া যাক–
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে কথাটা গ্রহণযোগ্য। গতিশীল ব্যক্তির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির বয়স দ্রুত বাড়বে (চমকে যাবার মতোই কথা) কারণ গতিশীল একজনের চেয়ে স্থির একজনের সময় দ্রুত চলে। একই ভাবে “ঘটনা–১” এর জন্যও কথাটি সত্য। ইভান যেহেতু আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ৬ বছর মহাকাশ ভ্রমণ করল তাই ওর বয়স বেড়েছে ঠিক ৬ বছরই। কিন্তু পৃথিবীতে থাকা বিভানের বয়স বেড়েছে ৬০ বছর অর্থাৎ ৬ গুন। নিচের তালিকায় স্থির বস্তুর তুলনায় গতিশীল বস্তুর সময় কতটা ধীর তার একটা তুলনামূলক তালিকা দেওয়া হল–
গতিবেগ | বাহন | অতিক্রান্ত সময় ধীর হয়ে যাবে |
10km/h | হাঁটা | 2 × 10 -14 % |
100km/h | গাড়ি | 2 × 10 -12 % |
1000 km/h | উড়োজাহাজ | 2 × 10 -10 % |
15km/s | রকেট | 2 × 10 -7 % |
0.1c | কল্পিত বাহন | 2.0% |
0.99c | কল্পিত বাহন | 7 গুন |
0.999c | কল্পিত বাহন | 22 গুন |
0.999999c | কল্পিত বাহন | 700 গুন |
এটমিক ক্লক (পারমাণবিক ঘড়ি যা অত্যন্ত সূক্ষ্ণ সময় দিতে সম্ভব) দিয়ে বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং সত্যতা পেয়েছেন। ১৯৭৭ সালে একটা উড়োজাহাজে কিছু বিজ্ঞানী উঠে বিশ্ব ভ্রমনে বের হন। পৃথিবী কয়েকবার ঘুরে এসে দেখলেন উড়োজাহাজে রাখা ঘড়ির চেয়ে পৃথিবীর ঘড়ির অতিক্রান্ত সময় বেশি দেখাচ্ছে।
“ঘটনা–২” ও সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা আপেক্ষিক তত্ত্বের আলোকে প্রমাণ করতে পেরেছেন। একটা উদাহরন দেওয়া যাক। মহাকাশ থেকে মহাজাগতিক রশ্মি আমাদের বায়ুমন্ডলে আঘাত করে। তখন সেখানে মিউওন নামে এক ধরনের অস্থায়ী কণিকা তৈরি হয় যার আয়ু মাত্র 2.2 মাইক্রো সেকেন্ড (1 মাইক্রো সেকেন্ড= 1/1000000 সেকেন্ড) মিউওন প্রায় আলোর কাছাকছি বেগে চলে (0.9994cবেগে চলে)। আলোর কাছাকাছি বেগে চললেও 2.2 মাইক্রো সেকেন্ডে মিউয়ন অতিক্রম করবে মাত্র 660 m । অর্থাত মিউওন কণাটি বায়ুমন্ডল থেকে ভূ–পৃষ্ঠের বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারার কথা না। কিন্তু মিউওন কনাটি ঠিকই ভূ–পৃষ্ঠে পৌছে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে। আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে মিউওন যখন প্রায় আলোর বেগে গতিশীল (0.9994c) তখন সেটা পৃথিবীর সাপেক্ষে নিজেকে স্থির মনে করে এবং পৃথিবী তার দিকে 0.9994c বেগে এগিয়ে আসে। ফলে বায়ুমন্ডল থেকে ভূ–পৃষ্ঠ পর্যন্ত দূরত্ব সঙ্কুচিত হয়ে যায়। মিউওন কণা ওই কম দূরত্বটুকু খুব সহজেই পেরিয়ে যেতে পারে।
সুতরাং “ঘটনা–২” এর ক্ষেত্রে কৃষকের কাছে খুঁটির দৈর্ঘ্য 100m লম্বা হয়ে গিয়েছিল আর কৃষক মাত্র 5.77 ন্যানো সেকেন্ডের (১ ন্যানো সেকেন্ড =1/1,000,000,000 সেকেন্ড) জন্য খুঁটিটি খামারে আঁটাতে পেরেছিল। বস্তুর গতিজনিত সঙ্কোচন সত্যি ঘটে। যা শুধু মাত্র আলোর গতি বা তার কাছাকাছি গতিতে গতিশীল হলেই দেখা সম্ভব হতো মানুষের চোখে। নিচে গতির সাথে দৈর্ঘ্য সঙ্কোচনের তুলনামূলক একটি তালিকা দেয়া হল।
গতিবেগ | বাহন | দৈর্ঘ্য সঙ্কোচন ঘটে |
10km/h | হাঁটা | 2 × 10 -14 % |
100km/h | গাড়ি | 2 × 10 -12 % |
1000 km/h | উড়োজাহাজ | 2 × 10 -10 % |
15km/s | রকেট | 2 × 10 -7 % |
0.1c | কল্পিত বাহন | 2.0% |
0.99c | কল্পিত বাহন | 7 গুন |
0.999c | কল্পিত বাহন | 22 গুন |
0.999999c | কল্পিত বাহন | 700 গুন |
নিউটনের গতিসূত্র থেকে আমরা জানি, কোন বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করলে বস্তুটির ভরবেগের পরিবর্তন হয়। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কারের পূর্বে ভাবা হত শুধু বেগের পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু এখন আমরা জানি বস্তুর গতি বাড়লে ভরও বাড়ে। কোন বস্তুর ওপর প্রচন্ড বল প্রয়েগ করলেও তার বেগ আলের বেগেরে সমান হবে না বা তার চেয়ে বেশি হবে না। বরং তখন বল প্রয়োগ করলে বস্তুর বেগ না বেড়ে ভর শত শত গুণ বেড়ে যাবে। তাই ভরযুক্ত কোন বস্তু বা কণাই আলোর বেগের সমান বেগ প্রাপ্ত হতে পারে না।
চলুন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে অন্যান্য তত্ত্ব জানা যাক
কোয়ান্টাম মেকানিক্স
আইনস্টাইনের সূত্রকে বলা হয় বড়দের (গ্রহ–নক্ষত্র) সূত্র। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে বলা হয় ছোটদের (পরমাণু ও অতিপারমাণবিক কণা) সূত্র। অতিপারমাণবিক কণাদের নিয়ম এতই অদ্ভুৎ যে তাদের গতি ও অবস্থান সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যায় না। বরং তাদের গতি ও অবস্থান সম্পর্কে সম্ভাব্য একটা ধারণা প্রদান করা যায়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এই হিসাব নিকাশের পদ্ধতিটিই কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক প্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রদান করেন। তত্ত্বানুসারে কোন বস্তু থেকে শক্তি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিঃসৃত হয় না। শক্তি বা বিকিরণ ছিন্নায়িত অর্থাৎ শক্তি গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে প্যাকেট বা কোয়ান্টাম হিসেবে নিঃসৃত হয়।
১৯০৫ সালে আইনস্টাইন বলেন – শক্তি যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয় তখনও তা কণারূপে বিরাজ করে এবং ঐ কণাগুলো আলোর বেগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছিন্নায়িত ভাবে শক্তি সঞ্চালিত করে।
১৮৬৪ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রমাণ করেছিলেন আলো একপ্রকার তরঙ্গ। তারমানে বলা যায় আলো একই সাথে কণা ও তরঙ্গ।১৯২৪ সালে বিজ্ঞানী লুইস দ্য ব্রগলি বলেন প্রত্যেকটি বস্তুরই কণা ও তরঙ্গ দ্বৈত ধর্ম রয়েছে। চলমান কণিকার সাথে তরঙ্গ প্রকৃতি যুক্ত। ১৯২৭ সালে (একজন জার্মান বিজ্ঞানী) ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ বলেন “একটি কণিকার একই সাথে ভর ও বেগ কখনই সূক্ষ ভাবে মাপা সম্ভব না। একে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বলা হয়।
উপরে বর্ণিত আধুনিক তত্ত্বগুলো দ্বারাই বর্তমান পরমাণু জগতকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়।
অতিপারমাণবিক কণা
আমরা যারা বিজ্ঞান সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর রাখি তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় পদার্থ কি দিয়ে গঠিত? তাহরে আমরা উত্তর দেবো পদার্থ অণু–পরামাণু, প্রোটন–নিউট্রন–ইলেকট্রন দিয়ে গঠিত। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় প্রোটন–নিউট্রন কি দিয়ে গঠিত? আমাদের বেশির ভাগেরই উত্তর হবে হয় “জানি না” নয়ত “প্রোটন নিউট্রনকে আর ভাঙ্গা যায় না। এরাই মৌলিক কণিকা”। কিন্তু আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান বলছে প্রোটন–নিউট্রনকেও ভাঙা যায়। অতিপারমাণবিক কণিকাদের মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১। ফার্মিওন–এই ধরনের কণিকা দিয়েই সকল পদার্থ গঠিত।
২। বোসন– প্রকৃতির সকল প্রকার মৌলিক বল বা শক্তি এই কণিকা দিয়ে গঠিত। মৌলিক বল চারটি হলো– মহাকর্ষ বল, তড়িত–চুম্বক বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, সবল নিউক্লিয় বল।
১। ফার্মিওন কণারা আবার দুই প্রকার – ক) কোয়ার্ক খ) লেপটন
ক) কোয়ার্ক– পরমাণুর মৌলিক কণিকা। এর ৬টি ধরণ আছে। যাদের ফ্লেভার বলা হয়। প্রত্যেক ফ্লেভার লাল, নীল, সবুজ হয়। অর্থাৎ ৬টি ফ্লেভারের ১৮টি কোয়ার্ক রয়েছে। এই ১৮টি কোয়ার্কের জন্য আরো ১৮টি এন্টি কোয়ার্ক আছে। তিনটি করে কোয়ার্ক মিলে একটি প্রোটন হয়। কোয়ার্ক আবার দুই রকম।
অ) বেরিয়ন–তিনটি করে কোয়ার্ক মিলে বেরিয়ন তৈরি করে। প্রোটন, নিউট্রন এদের উদাহরণ।
আ) মেসন– একটি কোয়ার্ক ও একটি এন্টি কোয়ার্ক মিলে মেসন তৈরি হয়।
খ) লেপটন– আমাদের সবচেয়ে পরিচিত লেপটন হচ্ছে ইলেকট্রন। পদার্থের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। লেপটন দুই প্রকার – চার্জ লেপটন, নিউট্রাল লেপটন।
২। বোসন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে এই কণার নাম রাখা হয় বোসন। বোসন দুই ধরনের ক) মৌলিক বোসন খ) যৌগিক বোসন
ক) মৌলিক বোসন– এটি ৫ ধরনের। চার ধরনের গেজ বোসন কণা যারা প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের জন্য দায়ী, সাথে একধরনের হিগজ–বোসন কণা যারা বস্তুর ভর সৃষ্টির জন্য দায়ী।
খ) যৌগিক বোসন হলো মেসন জাতীয় কণা।
বিগব্যাং
মহাবিশ্ব কি দিয়ে গঠিত? কত দিন আগেই বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে? কিভাইবেই বা তৈরি হল? এসব প্রশ্নের চূড়ান্ত কোন জবাব না দিতে পারলেও পদার্থ বিজ্ঞান কিছু প্রামাণিক ও কিছু যৌক্তিক তত্ত্ব দিতে সক্ষম হয়েছে।
মহাবিশ্বের ২৩% ডার্ক ম্যাটার, ৭৩% ডার্ক এনার্জি ও মাত্র ৪% আমাদের জানা শোনা পদার্থ দিয়ে গঠিত। ৪% এর মধ্যে ৩.৬% মুক্ত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম বাকি অংশ আলো, নিউট্রিনো, গ্রহ–নক্ষত্র। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন এখন থেকে ১৩৭৫ কোটি বছর আগে আমাদের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। আইনস্টাইনের “জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি”–র গাণিতিকি বিশ্লেষণে পাওয়া যায় মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে এবং এর বেগ আলোর বেগের সমান। ১৯২২ সালে আলেকজেন্দ্রোভিচ ফ্রিডম্যান নামে এক রাশিয়ান বিজ্ঞানী প্রথম মহাবিশ্বের প্রসারণের কথা বলেন। এরপর ১৯২৭ সারে জর্জ লেমেত্রি নামে বেলজিয়ান এক পাদ্রী, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিজ্ঞানী যাকে “বিগ ব্যাং” তত্ত্বের জনক বলা হয় তিনি এই প্রসারণের ধারণাকে কেন্দ্র করে একটি মডেল দাঁড় করান, যেখানে বলা হয় এই মহাবিশ্ব ছিল একটি বিন্দুবত। যার নাম দেন “Primeval Atom” বা “ আদিকণা”। আর সময়টাকে তিনি বর্ণনা করেন “A day without yesterday ”। পরবর্তীতে জর্জ গ্যামে নামে আমেরিকা প্রবাসী এক রাশিয়ান বিজ্ঞানী বৈজ্ঞানিক মহলে এই “বিগ ব্যাং’ তত্ত্বকে জনপ্রিয় করেন। ১৯৪৬ তিনি ও তাঁর ছাত্র মিলে এই মডেলে দেখান সময়কে উল্টে দিয়ে প্রসারণমান বিশ্বকে তার আদি অবস্থায় নিয়ে গেলে তা ঘন একটি অবস্থায় পৌছবে। যার নাম দেন তাঁরা “Ylem”। এই ঘন বিন্দুবত অবস্থা বা Ylem প্রসারিত হতে থাকে। তখন তাপমাত্রা ছিল কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই সময়টায় কোন পদার্থ ছিল না। ছিল প্লাজমার স্যুপ। প্রসারণ শুরুর এক সেকেন্ড পর কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, নিউট্রনো সৃষ্টি হয়ে। তখনও অণু–পরমাণু তৈরি হওয়ার অবস্থা ছিল না। সৃষ্টির তিন সেকেন্ড পর হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম তৈরি হয়। আরও এক লক্ষ বছর পর পদার্থ তৈরি হয়। ১৯৬৫ সালে “বিগ ব্যাং” তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে মহাজাগিতিক বিকিরণ সনাক্ত করা হয়; যার দৈর্ঘ্য পূর্বানুমান মত ২ সে.মি. এর কম এবং তাপমাত্রা ৩ কেলভিন।
Inflation Theory বা স্ফীতি তত্ত্ব
“বিগ ব্যাং” এর আগে কি ছিল? কিছু ছিল, না শূন্য ছিল? তার আগে একটা তত্ত্ব আমাদের জানা দরকার। আমরা শূন্যস্থান বলতে যা বুঝি তা আসলে মোটেও শূন্য নয়। “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” তত্ত্ব মতে শূন্য স্থানে একটি ইলেকট্রন ও একটি পজিট্রন 10-10cm দূরত্বে সৃষ্টি হয় আর মাত্র 10-21 s সময়ের মধ্যে পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে। “বিগ ব্যাং” এর আগে ছিল সময়, স্থান ও পদার্থ শূন্যতা। তার অর্থ শূন্যতা মানে পদার্থ ও প্রতিপদার্থের সৃষ্টি। আইস্টাইনের সূত্রে দেখা যায় “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” এর সময় এক প্রবল ঋণাত্মক মহাকর্ষ বল সৃষ্টি হয় এবং তা উৎপন্ন পদার্থ সমূহকে 1030 গুণ স্ফীত করে ফেলে। গণনায় দেখা যায় “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনকে” আমদের মহাবিশ্বের সমান আয়ু হতে হলে তার ভর হতে হবে 10-65 গ্রাম। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা বলছেন শূন্য থেকে এ মহাবিশ্বের সৃষ্টি। স্টিফেন হকিং তাঁর “কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” বইয়ে বলেছেন –মহাবিশ্বের সকল শক্তি, সকল চার্জ, সকল ঘূর্ণন যোগ করলে তার মান হবে শূন্য।
M-Theory ( Theory of Everything)
আমরা আগেই জেনেছি প্রকৃতিতে মৌলিক বল চারটি। বিজ্ঞানীরা গত দুইশতক ধরে এই মৌলিক বল একীভূত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাড়িত চৌম্বক বল, দুর্বল ও সবল নিউক্লয় বলকে একত্র করতে পারলেও মহাকর্ষ বলকে একত্র করতে পারেননি। একে বলা হয় “The greatest scientific problem of all time”। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকলে তো হবে না। বিজ্ঞানীর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এবং তাত্ত্বিক একটা সমাধান দিয়েছেন। সেই তত্ত্বটার নাম দিয়েছেন “M-Theory” বা “Theory of Everything”। এই থিওরির মাধ্যমে তাত্ত্বিক ভাবে মাহাবিশ্বের সকল ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। এই তত্ত্ব মতে –
১। প্রকৃতির সবকিছুই এক ধরনের কম্পমান তার দিয়ে গঠিত (যাকে স্ট্রিং বলা হয়)।
২। এই তার, ব্রেন (মেমব্রেন) নামে আরেকটি মৌলিক সত্ত্বার সাথে যুক্ত থাকে। ব্রেন ও তার গুলো ১ থেকে ১১ মাত্রার মধ্যে অবস্থান করে এবং কাঁপে (বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চারটি মাত্রাকে স্বীকার করেন। যেগুলো হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, সময়)। এর মধ্যে ১০টিই স্থানের মাত্রা। একটি সময়ের মাত্রা। একেক স্ট্রিং ও মেমব্রেন একেক রেজোনেন্সে কাঁপে ফলে একেক রকম কণার সৃষ্টি হয়।
৩। স্ট্রিং গুলো নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম মেনে স্থান ও কালের মধ্যে জটিল গতির সৃষ্টি করে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৯৬৮ সালে CERN (European Organization for Nuclear Research) এর এক তরুণ বিজ্ঞানী লক্ষ করেন নিউক্লিয় কণিকা থেকে আসা গননা ইউলার বিটা ফাংশনের সাথে মিলে যায়। পরবর্তীতে নিওনার্ড সাস্কিন্ড নামে এক বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন নিউক্লিও কণিকারা কম্পমান তারের ফাংশন মেনে চলে। এম–থিওরি যার পূর্ব নাম স্ট্রিং থিওরি ধারণার উৎপত্তি হয় ওই ঘটনা থেকেই।
তথ্য সূত্র:
১। থিওরি অফ রিলেটিভিটি– মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২। কোয়ান্টাম মেকানিক্স– মুহম্মদ জাফর ইকবাল
৩। স্ট্রিং থিওরি–হিমাংশু কর
৪। পদার্থ বিজ্ঞান ২য় পত্র (একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণি) – ড. শাহজাহান তপন
৫। উইকিপিডিয়া
৬। পদার্থ বিজ্ঞান ১ম পত্র (একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণি)-ড.শাহজাহান তপন
৭। দৈনিন্দিন বিজ্ঞান – ড. সাখাওয়াত হোসেন
ফিচার ইমেজ: Oceania.org
Leave a Reply