এইডস একটি প্রাণঘাতী মরণব্যাধি এ কথা কম বেশি সবার জানা। এর প্রতিষেধক আজও বিজ্ঞানীদের অজানা। প্রতিষেধক না থাকার কারণে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব নয়। তবে পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়ে টিমোথি ব্রাউন নামের এইচআইভি আক্রান্ত এক ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে রোগমুক্ত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের কাছে তিনি “বার্লিন রোগী” নামে পরিচিত।
দীর্ঘ ১১ বছর এইচআইভি নিয়ে বসবাস করার পর ব্রাউন জানতে পারেন তিনি অ্যাকিউট মায়োলয়েড লিউকেমিয়ায় (অস্থিমজ্জার ক্যান্সার)আক্রান্ত (উল্লেখ্য এইচ আইভির সাথে লিউকেমিয়ার কোন যোগসূত্র নেই)। লিউকেমিয়ার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি যখন ব্যর্থ হল তখন ব্রাউনের দেহে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হল। এ অবস্থায় চিকিৎসকেরা ব্রাউনকে অ্যান্টিরেট্রোভিয়াল ড্রাগ (এইডসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষুধ) দেয়া বন্ধ করে দিল। সাধারণভাবে এইচআইভি আক্রান্ত রোগী যদি এই ড্রাগ নেয়া বন্ধ করে দেয় তবে ৭দিনেই রোগীর শরীরে উচ্চমাত্রায় ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্রাউনের শরীরে এমন কিএক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে উঠল যে গত ৭ বছরে তার রক্তে খুবই নগন্য পরিমাণ ভাইরাল জেনেটিক ম্যাটারিয়াল পাওয়া গেল। এই নগন্য পরিমাণ জেনেটিক ম্যাটারিয়ালও আবার প্রতিলিপি তৈরিতে অক্ষম।
ব্রাউনের এই অসামান্য রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। ব্রাউনের শরীরে কিভাবে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠল তা নিয়ে প্রথমত বিজ্ঞানীরা তিন রকম ধারণা করলেনঃ
১) কেমোথেরাপি ব্রাউনের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলেছে।
২) ব্রাউনের অনকোলজিস্ট (ক্যান্সার চিকিৎসক) গেরো হাটার ব্রাউনের অস্থিমজ্জা দাতার জিনে এমন এক ধরনের মিউটেশন খুঁজে পেলেন যা শ্বেতরক্তকণিকার একধরণের রিসেপ্টরকে বিকল করে দেয় যা শ্বেতরক্তকণিকায় ভাইরাস আক্রমণের জন্য আবশ্যকীয়। এই মিউটেটেড জিন ব্রাউনকে এইডস থেকে মুক্তি দিয়েছে।
৩) তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধারণাটি হল, ব্রাউনের নতুন ইমিউন সিস্টেম আগের এইচ আইভি আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস করেছে।
এই তিন ধারণার মধ্যে কোনটি সত্যি তা জানার জন্য ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট গুইডো সিলভেস্ট্রি ও তার দল রেসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানরের উপর পরীক্ষা চালালেন।
প্রথমে তারা তিনটি বানরের রক্ত থেকে হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল (সকল ধরণের রক্তকণিকা এখান থেকেই তৈরি হয়) আলাদা করে সংরক্ষণ করলেন। পরে বানরের শরীরে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে SHIV ভাইরাস ( সিমিয়ান এবং হিউম্যান এইডস ভাইরাসের হাইব্রিড রূপ) প্রবেশ করানো হল।

বানরগুলোকে অ্যান্টিরেট্রোভিয়াল থেরাপি দেয়া হল। একইসাথে রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হল। কয়েকমাস পর বিশেষজ্ঞরা বানরগুলোর দেহে তাদের নিজস্ব ভাইরাসমুক্ত স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করল। এই সময়ে বানরগুলোর অ্যান্টিরেট্রোভিয়াল থেরাপি বন্ধ করে দেয়া হল। স্বাভাবিক নিয়মে বানরগুলোর রক্তে ভাইরাসের সংখ্যা হুরহুর করে বেড়ে যাওয়ার কথা ।হলোও তাই, তবে ব্যতিক্রম একটি বানর। এই বানরটি ঠিক সেই বার্লিন রোগীর মত SHIV ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। তবে দুঃখের বিষয় এই যে দুই সপ্তাহের মাথাতেই কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার কারণে বানরটিকে সমাহিত করা হয়। তারপরও এই ফলাফলের মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে, রেডিওথেরাপির মাধ্যমে কোষ ধ্বংসের সাথে সাথে দেহে ভাইরাসের আক্রান্ত কোষের সংখ্যা কমতে থাকে,মৃত বানরটির ক্ষেত্রে এই ধারণা প্রায় প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছিল।

এদিকে প্রফেসর ড্যানিয়েল কারিৎজকিস ক্যামব্রিজের একটি হাসপাতালে দুজন এইডস আক্রান্ত রোগী যাদের লিউকেমিয়া ছিল তাদের দেহে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করেন। এদের অস্থিমজ্জাদাতার জিনে কোন মিউটেশন ছিল না।কয়েক মাস পর রোগীদের অ্যান্টিরেট্রোভিয়াল থেরাপি বন্ধ করে দেয়া হলেও ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল কম। তাই ধারণা করা যেতে পারে ,এইচ আইভি প্রতিরোধে মিউটেটেড জিনের কোন ভূমিকা নেই।
হয়ত ভবিষ্যতে আরও নিয়ন্ত্রিত স্টেমসেল প্রতিস্থাপন অথবা রেডিওথেরাপি এইচ আইভি প্রতিরোধের হাতিয়ার হবে।
সূত্রঃ সাইন্স ম্যাগাজিন
Leave a Reply to রুহশান আহমেদCancel reply