নিকোলো প্যাগানিনি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের একটি বিখ্যাত নাম। আঠারোশো শতকের শেষ দিকে ইতালিতে জন্ম নেন তিনি। প্যাগানিনি সমসাময়িক ইউরোপ মাতিয়ে তুলেছিলেন তার বেহালার জাদু দিয়ে। পাশ্চাত্য সংগীতে বেহালা বাজানোর আধুনিক রীতি স্থাপন করেছেন তিনি। তার তৈরি সুর এখনো জনপ্রিয়। বহু বেহালা-বাদকের অনুপ্রেরণা হলেন প্যাগানিনি। অদ্ভূত বিষয় হলো, তার এই সাফল্যের অন্তত আংশিক কারণ ছিলো বংশগতির একটি দূর্লভ রোগ।
অন্য অনেক প্রতিভাধর সংগীতজ্ঞের মতোই প্যাগানিনি ছোটবেলাতে সংগীতচর্চা শুরু করেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে গিটার আর সাত বছর বয়সে বেহালা বাজানো শেখা শুরু করেন। খুব দ্রুতই এ যন্ত্রগুলো তার আয়ত্বে চলে আসে। মাত্র আঠারো বছর বয়সে আশেপাশের এলাকায় তিনি পরিচিতি লাভ করেন। আর ত্রিশ বছর হতে না হতেই সারা ইউরোপে তার খ্যাতি ছড়িয়ে যায়। কিন্তু প্যাগানিনি যখন মারা যান তখন তার জন্মস্থান জেনোয়ার গীর্জা ক্যাথলিক রীতিতে কবর দিতে অস্বীকার করে। কারণ আর কিছুই নয় – গুজব ছিলো প্যাগানিনি নাকি একজন শয়তানের উপাসক!
বেহালা বাজানোর বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন প্যাগানিনি। এ ছাড়াও তিনি হাতের আঙুলগুলো এমন ভাবে বাঁকিয়ে বেহালা বাজাতে পারতেন, যা অন্য কেউই পারতো না। এমনভাবে হাতে আঙুল খেলিয়ে বেহালার চার তারে তিনটি পূর্ণ অষ্টক বাজাতে পারতেন — যা এখনো অনেক বেহালাবাদক অসম্ভব বলে মনে করেন। প্যাগানিনির মৃত্যুর প্রায় দেড়’শ বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা এ রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি একটি দূর্লভ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। বংশগতির এ জটিল রোগের নাম মারফান সিন্ড্রোম। প্যাগানিনি শারিরীকভাবে প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। তবে মারফান সিন্ড্রোম রোগ তার সঙ্গীত-মেধার দিক দিয়ে জন্য শাপে-বর হয়ে গিয়েছিলো।
মারফান সিন্ড্রোম দেহের সংযোজক কলা বদলে দেয়। সংযোজক কলা দেহের সকল কোষ ও অঙ্গকে ধরে রাখে। সাধারণত মারফান সিন্ড্রোমে হাত, পা, আঙ্গুল স্বাভাবিকের তুলনায় লম্বা হয়ে পড়ে। আর আঙুলের গিট ইত্যাদি সন্ধিস্থান নমনীয় হয়ে পড়ে। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে প্যাগানিনি আঙ্গুল ছড়িয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়িয়ে দিতে পারতেন। প্যাগানিনি চাইলেই হাত না নড়িয়ে আঙুলের প্রথম সন্ধি সমকোণে বাঁকিয়ে বেহালা বাজাতে পারতেন। সমসাময়িক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইউরোপিয়ানদের কাছে এটা ছিলো বিস্ময়ের — কেউ ভাবতো প্যাগানিন ডাইনি-পুত্র, কেউ ভাবতো শয়তানের উপাসনার বিনিময়ে এই বিশেষ গুণটা প্যাগানিনি পেয়েছেন। প্যাগানিনি নিজেকে ঘিরে মানুষের এই ভীতি উপভোগ করতেন। রহস্য পছন্দ করতে তিনি। এজন্য তিনি কালো জামা পড়ে কনসার্টে যেতেন, আর কখনো কখনো কালো ঘোড়ায় টানা কালো ক্যরিয়েজে করে চলাফেরা করতেন।
মধ্যযুগে ইউরোপে শয়তানের অনুচর কিংবা ডাইনী অপবাদে প্রচুর মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। সে দিক দিয়ে প্যাগানিনির মৃত্যু পরবর্তী ঘটনা হয়তো ততটা নাটকীয় মনে হবে না। ১৮৪০ সালে এই সঙ্গীতজ্ঞ মৃত্যুবরণ করেন। এর চার বছর পর তার শবদেহ জন্মস্থান জেনোয়াতে নিয়ে আসার অনুমতি মেলে, কিন্তু দাফন করা হয় নি। ১৮৭৬ সালে অবশেষে তার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। মৃতদেহ নিয়ে এত টানা-হেঁচড়ার মতো অপমানজনক আর কি হতে পারে? অথচ এই সঙ্গীতজ্ঞ ডাইনী বা শয়তানের অনুচর নন, তিনি একটি বংশগতির রোগে আক্রান্ত। মারফান সিন্ড্রোম বংশগতির রোগ। অর্থাৎ বংশের মধ্য দিয়ে বাবা-মা’র মাধ্যমে এর রোগটি সন্তানকে আক্রান্ত করে। সংযোজক কলা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় একটি জিনে মিউটেশনের কারণে এ রোগ হয়।
প্যাগানিনির এই গল্প নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছে: The Devil’s Violinist (২০১৩) ।
এ সবই বংশগতির ব্যপারস্যাপার। বংশগতি হয়তো কখন শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়, আর কখনো ভোগায়। তবে আমরা যে ‘আমরা’ হয়ে উঠি, তার পেছনে বংশগতির রহস্যময় হাত রয়েছে। আমরা কি পুতুল নাচের পুতুল? বংশগতি কি আমাদের মাথার উপর সুতো ঘোরাচ্ছে?
[চলবে]
সূত্র:
– Paganini, How The Great Violinist Was Helped By A Rare Medical Condition
– The Violinist’s Thumb – Sam Kean (2012)
– উইকিপিডিয়া
[লেখাটি আমার জেনেটিক্স: বংশগতিবিদ্যার সহজপাঠ বইটি থেকে নেয়া। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বাতিঘর, রকমারী ও চন্দ্রদ্বীপ সহ বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।]
Leave a Reply