সাপ দেখে শিউড়ে ওঠা আমাদের প্রাচীন আত্মরক্ষা ব্যবস্থারই অংশ। তবে সাপের সাথে আমাদের মিলও কম নয়। বিশেষত কোষের গহীনে জীবন নকশায়। সাপের জিনোমের আকার মানব জিনোমের অর্ধেক। জিনোমের আকারের সাথে প্রাণীদেহের জটিলতার কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই অবশ্য। কিছু কিছু স্যালমান্ডরের জিনোম মানব জিনোমের চেয়ে ষাটগুণ বড়ো, অথচ স্যালমান্ডর একটি নিরীহ সরীসৃপ মাত্র। তো সরীসৃপ হলেও সাপের সাথে মানব জিনোমে অনেক জিনের সিকোয়েন্সে প্রচন্ড মিল।
TRPA1 জিনের কথাই ধরা যাক। আমি বেশিদিন হয় নি এর নাম শুনেছি, সম্ভবত পাঠক আপনিও না। কিন্তু এই জিন থেকে তৈরি প্রোটিনটি উল্লেখ করার মতো। ট্র্যপা-১ প্রোটিনটি সাপকে অবলোহিত আলো, অর্থাৎ তাপ দেখতে সাহায্য করে। তবে মানুষে প্রোটিনটি তাপ দেখার অতিমানবিক ক্ষমতা নয়, বরং খাবারে বিষজাতীয় পদার্থ আছে কি না, সেটার অনুভবশক্তি দেয়।
ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে স্বাদ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, শব্দ ও দর্শন ছাড়াও সূক্ষ্ম অনুধাবন ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। যেমন আমরা খাবারে স্বাদের সামান্য তারতম্যও বুঝতে পারি, পরিবেশ অস্পষ্ট বদলে যাওয়া ধরতে পারি। এ সামর্থ্য আমাদের সুস্বাদু পুষ্টিকর খাবার চিনতে সাহায্য করে। কোনটা খাওয়া যাবে আর কোনটা অখাদ্য তা নির্ধারণ করা আমাদের জন্য কঠিন নয়। খাবারে পুষ্টিগুণ থাকলেও তাতে ক্ষতিকর পদার্থ থাকতেই পারে। যেমন পচা ফলে উচ্চ-পুষ্টি রয়েছে, কিন্তু মরণঘাতী ব্যক্টেরিয়া থাকাও অস্বাভাবিক নয়। প্রাণীদের এধরণের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রকৃতিতে অজস্র ছোট ছোট সংবেদনশীল আণবিক-যন্ত্র তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে একটি হলো ট্র্যপা-১ (TRPA1)।
ট্র্যপা-১ বিস্তৃত করলে হয় ট্রান্সিয়েন্ট রিসেপ্টর পটেনশিয়াল এন্করিন ১। মানব-কোষের বহিরাবরণে প্রোটিনটি বসে থাকে — যেখানে তা অতিপ্রতিক্রিয়াশীল রাসায়নিক সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এসব প্রতিক্রিয়াশীল রাসায়নিক কোষের মাঝে থাকা ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্থ করার ক্ষমতা রাখে। ট্র্যপা-১ প্রোটিনের সাথে বিশেষ অ্যামিনো এসিডের ফাঁস যুক্ত থাকে যেখানে এসব রাসায়নিক আটকা পড়ে। ক্ষতিকর রাসায়নিক এই ফাঁদে পা-দিলেই ট্র্যপা-১ প্রোটিন বিপদ-সংকেত পাঠিয়ে দেয় — “বিপদ! বিপদ! বিষজাতীয় পদার্থ ধরা পড়েছে!” দেহ অবশ্য এসব বিপদ-সংকেতে কিভাবে সাড়া দেবে তা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। ওয়াসাবি (একধরণের জাপানী গাছের মূল যা রান্নায় বিশেষ স্বাদের জন্য ব্যবহৃত হয়), দারুচিনি, কাঁচা রসুন ট্র্যপা-১ সক্রিয় করে। যদিও এরা খুব শক্তিশালী আস্বাদের জন্ম দেয়, কিন্তু কাশি-প্রদাহ-জ্বালাপোড়া তৈরি হয় না। অন্যদিকে কাঁদুনে গ্যাসে থাকা রাসায়নিকও ট্র্যপা-১ সক্রিয় করে — পাশাপাশি ভীষণ বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করে। ঠিক এক কারণেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে কাঁদুনে গ্যাস জনপ্রিয়। কাঁদুনে গ্যাস এড়ানোর জন্য স্বয়ংস্ক্রিয় আচরণ সৃষ্টি করে — ফলে দলবদ্ধ মানুষকে সহজেই ছত্রভঙ্গ করে দেয়া যায়।
ট্র্যপা-১ স্তন্যপায়ী (মানুষ) ও সরীসৃপ (সাপ) ছাড়াও মশা-মাছির মতো পতঙ্গের ডিএনএতে বর্তমান। অর্থাৎ এই জিনটির বহু পুরনো বিবর্তনীয় অতীত রয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতীতে এই জিনে মিউটেশন জমা হয়ে কাজের প্রচন্ড পার্থক্য তৈরি করেছে। যেমন ফলের মাছি ড্রসোফিলা সহ অন্যান্য পতঙ্গে যেমন মানুষের মতোই ক্ষতিকর রাসায়নিক সনাক্ত করতে এই জিন নির্মিত প্রোটিন কাজে লাগে। পাশাপাশি এসব পতঙ্গে এই প্রোটিনটি তাপসংবেদী-ইন্দ্রীয় হিসেবেও কাজ করে। বিরক্তিকর পতঙ্গ মশার মুখের কাছে ট্র্যাপা-১ প্রোটিনটির একটি সংস্করণ ক্ষতিকর রাসায়নিক সনাক্ত ও অন্য সংস্করণ চারপাশের তাপীয় পরিবর্তন সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। পরিবেশে উচ্চতাপমাত্রা সনাক্ত করে সেখান থেকে বিপদ এড়াতে যেমন এই প্রোটিনটি কাজে, তেমনি অন্তত মশার ক্ষেত্রে উষ্ণরক্তের প্রাণির উপস্থিতি সনাক্ত করে শিকার খুঁজতেও কাজে লাগে।
মানুষ ও পিট-ভাইপার সাপ উভয়ের ট্র্যপা-১ প্রোটিনটির ব্যবহার একদম ভিন্ন। র্যটল স্নেকের যেমন চোখের নিচে লরিয়াল পিট নামক বিশেষায়িত জায়গা রয়েছে। লরিয়াল পিট মূলত একরকমের উন্মুক্ত পকেট। এ পকেটের ঝিল্লীতে বিভিন্ন স্নায়ু থাকে যারা আবার ট্র্যপা-১ প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত। এই স্নায়ুগুলো আবার সর্প-মস্তিষ্কের যে অংশ দর্শন-বোধের জন্য দায়ী তার পেছনে যুক্ত। ফলে সাপ চোখ দিয়ে তার চারপাশের ছবি দেখার সাথে সাথে তাপীয় মানচিত্রও দেখতে পায়। অর্থাৎ সাপ ট্র্যপা-১ প্রোটিনের সাহায্যে অবলোহিত আলো দেখতে পারে।
প্রাণীজগতে সংরক্ষিত জিনগুলো পরিবর্তিত হয়ে কতো বৈচিত্র্যময় কাজ করে, তা আসলেই আশ্চর্যের।
সূত্র:
This gene helps snakes “see” heat—and helps humans steer clear of harmful substances
Leave a Reply