বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি সপ্তাহদুয়েক ধরে অসুস্থ। ডাক্তারের সন্দেহ টাইফয়েড, পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চলছে। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশ ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। টের পেলাম, বুকের উপরটায় যেন চেপে বসে আছে কেউ। হাত-পা-দেহ নাড়াতে পারছিনা একেবারেই। তখনই বুঝলাম আমাকে বোবায় ধরেছে। তবে একেবারেই ভয় পাই নি, কারণ আমি বোবায় ধরার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা জানতাম। বোবায় ধরাকে বলে Sleep Paralysis। জানতাম, ঘুমের এই পক্ষাঘাত সাময়িক। একটু পরেই সেরে যাবে। ঠিক তাই হলো। কিছুক্ষণ পর আমার শরীর নড়াচড়া করার ক্ষমতা ফিরে এলো। আসলে ‘বোবায় ধরা’-য় কিছুই ধরে না। এটা বলতে গেলে ঘুমের সমস্যাও নয়। বরং আমাদের মস্তিষ্কে স্বপ্ন দেখা সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার একটি সামান্য ত্রুটি থেকে এই ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
ঘুম-পক্ষাঘাতের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম হতে পারে। অনেকে অনুভব করেন তার চারপাশে কোন অপার্থিব উপস্থিতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কারো মনে হয় কিছু একটা বুকের উপর চেপে বসে আছে। ফুসফুস ভর্তি করার জন্য তিনি বড় দম নেয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু খুব সামান্যই দম নিতে পারছেন। কেউ আবার অনুভব করেন তিনি ধীরে ধীরে নিজ দেহ থেকে বের হয়ে উর্ধগগনে চলে যাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুম পক্ষাঘাত কয়েক মিনিটের জন্য স্থায়ী হলেও অনেকের জন্য এটা কয়েক ঘন্টার দীর্ঘ অত্যাচার! তবে ঘুম পক্ষাঘাত কোন অতিপ্রাকৃতিক জগতের দরজা খুলে দেয় না। এ সময় দেহ থেকে আত্মাও বের হয়ে আসে না, বা কেউ বুকের উপর চেপে বসে থাকে না। কেন ঘুম পক্ষাঘাত ঘটে, এটা বোঝার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে একটু উঁকি দিয়ে আসতে হবে।
মানুষের মস্তিষ্ককে তিনটি তলার বাড়ি হিসেবে কল্পনা করা যায়। এর নিচতলায় হেডকোয়ার্টার হিসেবে আছে ব্রেনস্টেম সহ আরো কিছু অঞ্চল। এ অঞ্চল শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, ঘুম সহ দেহের মৌলিক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রেনস্টেমের সাথে আছে সেরেবেলাম। সেরেবেলাম হাঁটাচলা সমন্বয় করতে সাহায্য করে। এ অঞ্চলগুলোকে অনেক সময় সরীসৃপ মস্তিষ্ক হিসেবে ডাকা হয়। কারণ কাজের দিক দিয়ে এটি গড়পড়তা গিরগিটি বা টিকটিকির মস্তিষ্কের সমতুল্য।
সরীসৃপ মস্তিষ্কের ঠিক উপরের তলায় রয়েছে স্তন্যপায়ী মস্তিষ্ক। সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কে এই অঞ্চলগুলো দেখা যায়। এর কাজ হলো দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে আসা তথ্য লেনদেন করা। এছাড়া স্মৃতি গঠন, আবেগ পরিচালনা, মনোরম ও বিতৃষ্ণ অভিজ্ঞতার মাঝে পার্থক্য করার জন্য এ মস্তিষ্ক দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই তিনটি কাজকে একসাথে লিম্বিক সিস্টেমও বলে। সাপ কিংবা কচ্ছপকে চেষ্টা করলেও পোষ মানানো যায় না। কারণ ওরা সরীসৃপ, ওদের মস্তিষ্কে লিম্বিক সিস্টেম নেই। অন্যদিকে কুকুরের প্রভুভক্তির কথা সুবিদিত। কিংবা সার্কাসের হাতি বা সিংহকে চাবুকের বিতৃষ্ণ অভিজ্ঞতার ভয় দেখিয়ে মনিব বিভিন্ন খেলা শেখান। এগুলো সম্ভব হয় লিম্বিক মস্তিষ্কের কারণেই।
নি:শ্বাস-প্রশ্বাস কখন কিভাবে নিতে হবে সেটা কি আমরা কখনো সচেতনভাবে ভাবি? বা পরিবেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী দেহের বিপাকীয় গতি ঠিক করি? না। আসলে মগজ-বাড়ির নিচের দুই তলা এইসব স্বয়ংস্ক্রিয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকটা বিমানের স্বয়ংচালিত অবস্থার মতো। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কের সবচেয়ে উপরের তলা মুক্ত হয়ে যায় স্বাধীন চিন্তা, পরিকল্পনা, ভাষা, ও দর্শন-ঘ্রাণ-শব্দে পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি-বস্তু-প্রাণীকে চিনতে পারার জন্য। এই উপরের তলাকে বলা হয় প্রাইমেট মস্তিষ্ক। মানুষের মধ্যে প্রাইমেট মস্তিষ্কের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী ও প্রাইমেট মস্তিষ্ক বিভিন্ন রাসায়নিক নিউরোট্রান্সমিটার দিয়ে নিজেদের মধ্যে তথ্যবিনিময় করে। এই তিন তলা একসাথে সমন্বয় করে কাজ করে। সরীসৃপ মস্তিষ্কে ব্রেনস্টেমের মধ্যে একটি এলাকা হলো পনস। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে পনস স্তন্যপায়ী মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে প্রাইমেট মস্তিষ্কে স্বপ্ন শুরু করার সংকেত পাঠায়। একই সাথে পনস মস্তিষ্কের নিচে স্পাইনাল কর্ডে অন্য একটি সংকেত পাঠায়। এর ফলে ঐচ্ছিক পেশীসমূহ সাময়িকভাবে অসাড় হয়ে পড়ে। এটা মূলত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যাতে আমরা স্বপ্নের মধ্যে হাঁটাচলা বা অঙ্গসঞ্চালনা না করি। তবে কখনো কখনো এই ব্যবস্থার সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে যায়।
আমরা পিঠের উপর ঘুমালে কখনো কখনো কন্ঠনালী দিয়ে ঠিক মতে বাতাস যেতে পারে না। তখন ফুসফুসে অক্সিজেন কমে যায়। স্বপ্নহীন গভীর ঘুমে এটা কোন সমস্যা না। মস্তিষ্কের যে গহীন অঞ্চল অক্সিজেন তত্ত্বাবধান করে, তা শরীরকে গভীর ঘুম থেকে আধোজাগরণ অবস্থায় একটু তুলে দেয়। তখন হয় আমরা নাক ডাকি, বা মাথা ঘোরাই, বা পাশ ফিরে শুই। কিন্তু স্বপ্নদেখা ঘুমের বিষয়টা একটু জটিল। তখন মস্তিষ্ক পনসকে নির্দেশনা দেয় পেশি অসাড় করার প্রক্রিয়া থামিয়ে দিতে। কখনো কখনো পনস এ নির্দেশে সাড়া দেয় না। এমন অবস্থায় মস্তিষ্ক ঘুম থেকে দেহকে আরো একটু জাগিয়ে দেয়। কিন্তু মস্তিষ্ক অসাড়ই থাকে, আর শ্বাসপ্রবাহের সমস্যা রয়ে যায়। ঘটনা আরো সংকটপূর্ণ হওয়া শুরু করে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মস্তিষ্ক একেবারেই পূর্ণজাগ্রত হয়ে যায়। মন তখন বুঝতে পারে কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে নিঃশ্বাসের সমস্যা তখন ভালো ভাবেই টের পাওয়া যায়। দম নিতে পারছি না, আবার দেহও নাড়াতে পারছি না এরকম একটা অনুভূতি আসে। তখন স্তন্যপায়ী মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা সক্রিয় হয়ে ভয়ের অনুভূতি উদ্রেক করে। ফলাফল – মস্তিষ্কে ‘পালাও বা যুদ্ধ করো’ পরিস্থিতির উদ্ভব! তাতে অবশ্য কোন লাভ হয় না কারণ দেহ নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। শুরু হয় আতঙ্ক। এ অবস্থাকে সাধারণ মানুষ ‘বোবায় ধরা’ নাম দিয়েছে।
অনেকের ক্ষেত্রে বিশ্রী পরিস্থিতিটা নাটকীয় দিকে মোড় নেয়। অনেকে পূর্ণজাগ্রত না হতেই এই অবস্থায় প্রবেশ করে। তারা কখনোই স্বপ্ন থেকে বের হতে পারে না। তারা একদিকে অর্ধজাগ্রত ভাবে চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সজাগ, অন্যদিকে দেহ নাড়াতে পারছে না, অন্যদিকে স্বপ্নের মধ্যে অর্থহীন দৃশ্যপট ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানব মস্তিষ্ক বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক টানতে বেশ পারদর্শী, বিশেষ করে ঘটনাগুলো যদি সন্দেহজন হয়। তাই তারা স্বপ্নের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে ঘুম পক্ষাঘাতের হ্যালুসিনেশনের সম্পর্ক টানে। এ পরিস্থিতিতে মানুষ নিজ নিজ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে ব্যাখ্যা দেয়। কেউ দাবী করে এলিয়েনরা এসেছিলো, কেউ বলে শয়তান ভর করেছিলো, আর কেউ বা বলে ভূতে ধরেছিলো! অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির অর্ধ-জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্ন আর ঘুম-পক্ষাঘাত এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় যে তারা আসলেই এসব অশরীরী অনুভূতি পায়, দেখে, শোনে!
যাদের ঘুম-পক্ষাঘাত ঘন ঘন হয়, তাদের পাশ ফিরে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। তবুও যদি ‘বোবায় ধরে’, তখন ভয়ের কিছু নেই। কারণ এই নাটকীয় পক্ষাঘাত সাময়িক। বোবায় ধরা বা ঘুমের মধ্যে কেউ ভর করা একটা কুসংস্কার মাত্র। আসলে আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে তা একটা অশ্চর্যকর বিষয়। ঘুম-পক্ষাঘাতের পেছনেও স্নায়ুবিজ্ঞানের চিত্তাকর্ষক একটা ব্যাখ্যা রয়েছে, যা আমাদের মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়ার প্রতি আগ্রহ কেবল বাড়িয়েই তোলে।
প্রচ্ছদ ছবি কৃতজ্ঞতা: “PARASOMNIAs / GIFs / CINEMAGRAPHs” by Petra Švajger, Maja Poljanc is licensed under CC BY-NC-ND 4.0
Leave a Reply