সম্পাদকের ভূমিকা: সম্প্রতি একাত্তর টেলিভিশনে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আলিমুল ইসলাম দাবী করেছেন, ইথানল বাষ্প শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে করোনা সহ শ্বসনতন্ত্রের অন্যান্য রোগ ভালো হবে। তিনি নিজের এবং তার ছাত্রদের উপর এটি পরীক্ষা করেছেন বলে দাবী করেছেন। বস্তুত, নিশ্বাসের মাধ্যমে অ্যালকোহলের বাষ্পগ্রহণ অত্যন্ত বিপদ্জনক ও ক্ষতিকর। কোন গবেষণা ছাড়াই এ ধরনের দাবী জনসম্মুখে করার ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এ বিষয়টি যাচাই করার জন্য এই লেখাটি লিখেছেন অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্র আশিক মাহমুদ। – আরাফাত রহমান
অ্যালকোহল কিংবা ইথানল হলো সুপরিচিত একটি জীবাণুনাশক। এর বহুল ব্যবহার প্রচলিত আছে। যেমন: ল্যাবরেটরি কিংবা ডাক্তারদের অস্ত্রপচার কিংবা ফার্মাসিতে বিভিন্ন কাজেই এটি পরিষ্কারক বা জীবাণুনাশক রুপে অহরহ ব্যবহৃত হয়। নতুন করে এটি সম্পর্কে বলার কারণ হচ্ছে- গবেষণা সমাপ্ত না করে, কিংবা এটিকে মানুষের মাঝে ব্যবহারের পূর্বের কিছু ধাপ (ট্রায়াল) শেষ না করে বা FDA এর Authorization ছাড়া তা বলার কারণে আমাদের মানুষ এটি ব্যবহার শুরু করলে তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর হতে পারে? এসম্পর্কে আমাদের কিছু তথ্য জানা অতি জরুরী।
Alcohol Inhalation!
অ্যালকোহল বাষ্প হলো অ্যালকোহলকে তাপ প্রদান কিংবা শুষ্ক-বরফের উপর অ্যালকোহল ঢেলে দিলে যে ধুম্র বের হয় সেটাই। অ্যালকোহল-বাষ্প তৈরী করার যন্ত্রটি আমেরিকার কিছু প্রদেশে ব্যবহার কিংবা ক্রয় নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে৷
অ্যালকোহল বা মদে বরাবরই মানুষের কিছুটা আগ্রহ থাকে কারণ যে কোন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের শুরু থেকেই ভালবাসা বেশি কাজ করে৷ যাই হোক মুল বক্তব্যে আসা যাক- মানুষ যখন অ্যালকোহল বাষ্পগ্রহণ (ঘ্রাণ নেয়া) করে তখন তা সরাসরি অতিমাত্রায় ফুসফুসে প্রবেশ করে। একইসাথে তা দ্রুত রক্তে-প্রবাহিত হয় এবং মতিষ্কেও পৌছায় যা ক্ষতিকর। পাশাপাশি তা পাকস্থলীতেও পৌছাতে পারে। আরেকটি মজার তথ্য হলো পেটে পাচার করে দেবার চেয়ে বরং, সামান্য পরিমাণ আলকোহল বাষ্প গ্রহণ করাতেও মানুষ বেশি মাতাল হয়ে পড়ে এবং মাতাল হবার জন্য সময় অনেক কম লাগে৷
এই পদ্ধতির ফলে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের মত ব্যাপারসহ বিষক্রিয়ার মত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়৷ এছাড়া, এটি যেহেতু নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহন করা হয় তাই গ্রহণ মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্যও হিসাব রাখা যায় না। টোবাকো বা সিগারেটের মতই এটি ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। অ্যালকোহলের ব্যবহার কম বয়স্কদের ক্ষেত্রে আরো বেশি ক্ষতিকর। কেননা, তাদের মস্তিষ্কের বেড়ে ওঠা অসম্পূর্ণ থাকে৷ এছাড়া, এটি যেহেতু দাহ্য পদার্থ আমাদের পাকস্থলীতে জ্বলন অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে৷ পাশাপাশি এ বাষ্প গ্রহনের ফলে ধীর গতির শ্বাসক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে কিংবা দীর্ঘস্থায়ী শ্বসন-জটিলতার মত ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে৷
যে কোন নতুন ড্রাগ মানুষে ব্যবহারের পূর্বে ইদুরের উপর ট্রায়াল (পরীক্ষা) করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানেও কিছু সমস্যা দেখা গেছে৷ যেমনঃ অতিমাত্রায় অ্যালকোহলের বাষ্প গ্রহণের ফলে ইঁদুরের মধ্যেও উন্মাদনা, রাগ বা ক্রোধ, মাদকাসক্তির ব্যাপারগুলো দেখা গেছে৷ পাশাপাশি এর উপসর্গ প্রশমিত হবার সময়ও রাগান্বিত, কম্পন, শরীর থেকে পানি নিঃসরণ, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ও হৃদরোগের সম্ভবনা থাকে৷ সে কারণে, মানুষে ব্যবহারের চিন্তাই করা দূরহ৷ অ্যালকোহল মুখে রাখা, এর বাষ্পগ্রহন কিংবা গলধঃকরণ সব কিছুতেই কিছু নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান। কিছু সুস্থ মানুষের উপর বিভিন্ন মাত্রার অ্যালকোহল নিয়েও একটা পরীক্ষা করা হয়েছে। যেখানে, ৪%, ১০% ও ৪০% মাত্রার অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়েছে৷ এসব পরীক্ষায় গ্যাস্ট্রোস্কোপির (পাকস্থলীর অভ্যন্তর দেখার জন্য একটি পদ্ধতি) সময় অ্যালকোহল সরাসরি পাকস্থলীর নিম্নাংশে স্প্রে আকারে দেয়া হয়। সেখানে, দেখা যায়- অ্যালকোহলের ঘনমাত্রা যতবেশি পাকস্থলীর ক্ষয়ও ততবেশি এবং পাকস্থলীর রক্তকণিকারও ভাঙন দেখা যায়৷ তবে, ক্ষুদ্রান্ত্রের কোন ক্ষয় দেখা যায় নি। ১০% এর বেশি অ্যালকোহলের মাত্রায় পাকস্থলীতে যে ক্ষতি হয় তার সাড়াতে ১ দিনেরও বেশি সময় লাগে।
অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের এ নিয়ে যেসব বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা বিপদজনক হতে পারে। হয়তো কেউ ভাবছেন ইথানলের বাষ্প গ্রহনে হয়ত শরীরে তার প্রভাব থাকবে না যেহেতু সরাসরি পেটে যাচ্ছে না, সরাসরি গ্রহনের চেয়ে আসক্ত হবার সম্ভাবনা কম, ক্ষতিকর প্রভাব গুলি হবার সম্ভবনা নেই — এ সবগুলিই ধারণা এবং ভুল। বরং, সরাসরি গ্রহনের মতোই এর বাষ্প গ্রহন বা ঘ্রাণ নেয়া ক্ষতিকর।
আমরা জানি ইরানেও ভয়ংকর মাত্রায় Covid-19 ছড়িয়ে পড়েছে৷ সেখানেও, অ্যালকোহল সেবন করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ করতে পারবে এরকম একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ফলে অ্যালকোহল গ্রহনে ৬০০ এর অধিক মানুষ মারা যায় এবং ৩০০০ এর মত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। সুতরাং, পরীক্ষাগত প্রমাণ ছাড়া কোন তথ্যতেই আশ্বস্ত হওয়া কিংবা তা গ্রহন করা ঠিক হবে না। এর পূর্বেও, Hydroxychloroquine এবং Azithromycin এর এরকম একটা খবর ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়েও মৃত্যুর ঘটনা দেখা গেছে।
বর্তমানে যে বিষয়টি আমরা জানতে পারছি যে করোনা গ্রুপের একটি ভাইরাস যা মুরগী থেকে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে৷ যদিও তা in vitro অর্থাৎ, মুরগী থেকে আলাদা করার পর সেটিকে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়েছে, সরাসরি নয় (not in vivo)। যদিও তা কার্যকরী হয় তবুও মানুষের ক্ষেত্রে কতটুকু ফলপ্রসূ তা বলা যাবে না। কারণ, in vitro এর কার্যকারীতা বাস্তবক্ষেত্রে বা in-vivo তে অনেকসময়ই ফলপ্রসূ হয় না। পাশাপাশি আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন। কেননা, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় – একটা প্রজাতির সব স্ট্রেইনের উপরও একটি অ্যান্টিবায়োটিক সমান ভাবে কাজ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে, অ্যালকোহল মুরগীর করোনা গ্রুপের ভাইরাসের উপর কাজ করলেও মানুষের করোনার উপর কাজ করবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ও রয়ে যায়। এছাড়া, মানুষে ব্যবহারের পূর্বে আরো অনেক ট্রায়াল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার এবং তার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। কেননা, দেখা যায় অনেক সময় যা প্রাণীর উপর কাজ করে তা মানুষে কাজ নাও করতে পারে বরং উল্টা ক্ষতিকর হতে পারে। একারণে, প্রমাণ ব্যতিত কোন কিছু গ্রহন আমাদের জন্য ক্ষতিকর।
তাছাড়া, মানুষের ক্ষেত্রে যে ঠান্ডা প্রশমিত হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে তা Covid-19 আক্রান্ত ব্যক্তি কি না বলা হয় নি! কিংবা সাধারণ ঠান্ডা ছিলো কিনা সেটাও যাচাইয়ের প্রয়োজন। কেননা, সাধারণ ভাইরাস জনিত (rhino virus) কোন ঠান্ডা এমনিতেই সেড়ে যায় এবং এরজন্য আহমরি কোন ওষুধ নাই কিংবা প্রয়োজনও নেই। পাশাপাশি এটির ব্যবহার কার্যকরী কিনা অর্থাৎ, অ্যালকোহল শ্বসনের (inhaling) সাথে গ্রহণ কতটুকু নির্ভরযোগ্য তাও ভাববার বিষয়!
তাই, কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে হাত পরিস্কারের জন্য ইথানল ভিত্তিক হাত-পরিস্কারক ব্যবহার করলেও ইথানলের বাষ্প নিশ্বাস নেয়ার মতো ক্ষতিকর কাজ থেকে দূরে থাকুন।
Leave a Reply