জিন সম্পাদনায় মিলবে প্রোজেরিয়ার সমাধান

২০০৯ সালে ভারতীয় জনপ্রিয় চলচিত্র পরিচালক আর.বালকি কর্তৃক পরিচালিত ‘পা’ সিনেমাটি দিয়ে শুরু করা যাক। ছবিটিতে দেখা যায় ১২ বছরের একটি ছেলে অরো খুবই বুদ্ধিমান এবং মানসিক ভাবেও স্বাভাবিক। কিন্তু শারীরিক ভাবে সে দেখতে তার বয়সের ৫ গুণ বেশি বয়স্ক বলে মনে হয়। যেন এই বয়সেই বুড়িয়ে যাচ্ছে। ছবিটিতে অরো চরিত্রে অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী অমিতাভ বচ্চন। আসলে ছবিটিতে অরো একটি অটোসোমাল জিনগত রোগ ‘প্রোজেরিয়ায়‘ আক্রান্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি ‘হাচিনসন-গিলফোর্ড ‘ নামেও পরিচিত। ১৮৮৬ সালে জনাথন হাচিনসন এবং ১৮৯৭ সালে হাসটিং গিলফোর্ড পৃথক পৃথক ভাবে এই রোগ শনাক্ত করেন। তাই রোগটির এরকম নামকরন করা হয়েছে।

প্রোজেরিয়া একটি অটোসোমাল প্রকট জিনগত রোগ। আমাদের কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২২ জোড়া ক্রোমোজমকে বলা হয় অটোসোম আর বাকি ১ জোড়াকে বলা হয় সেক্স ক্রোমোজোম। অটোসোম ক্রোমোজোম গুলো দেহের সঠিক গঠনের সাথে জড়িত। অটোসোম গুলোর ১ নং ক্রোমোজোম এ অবস্থিত লেমিন (Lamin A) প্রোটিন তৈরির জিন এ মিউটেশান ঘটলে প্রোজেরিয়া দেখা দেয়। লেমিন প্রোটিনটি কোষের নিউক্লিয়ার পর্দার গঠনে সহায়তা করে। প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের এই প্রোটিন সংশ্লিষ্ট জিন এ মিউটেশন ঘটে। লেমিন এ জিনের একটি সাইটোসিন বেস এর জায়গায় একটা থাইমিন বেস যুক্ত হয়। ফলে তাদের শরীর এ লেমিন প্রোটিন এর পরিবর্তে প্রোজেরিন নামক প্রোটিন তৈরি হয়। এতে করে রোগীর কোষের নিউক্লিয়াসের স্বাভাবিক গঠন ব্যাহত হয়। অস্বাভাবিক নিউক্লিয়াস এর কারণে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশু এবং একটি অস্বাভাবিক নিউক্লিয়াস(ডানে নিচে)। ছবি সূত্রঃ WIKIPEDIA

দেহের বৃদ্ধি মন্থর হয়ে যায়। মাথার সব চুল উঠে যায়। এ ছাড়াও পেশী প্রোটিন ভাঙ্গতে শুরু করে, চর্বি কমতে থাকে,চামড়া কুচকিয়ে যায়,অস্টিওপোরেসিস,অ্যাথেরিওস্ক্লেরেসিস দেখা দেয়। সাধারণত প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১৪-১৮ বছর বয়সে মারা যায়।

এ যাবত পুরো বিশ্বে প্রায় ৪০০ জন প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশু শনাক্ত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত এ রোগের কোনো সুরাহা হয় নি। তবে সম্প্রতি একটি নতুন গবেষণা আশার আলো জাগিয়েছে। হয়তো প্রোজেরিয়ার সমাধান মেলবে নিকট ভবিষ্যতেই। ৬ জানুয়ারি তারিখে নেচার এ এমনই একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন থেরাপি গবেষক গোয়াংপিং গাও বলেন গবেষণাটি সত্যিই চমৎকার। গবেষণাটি মূলত ইদূঁরের উপর করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন সম্পাদনা বিষয়ক গবেষক ফয়োডর উরনভ বলেন গবেষণার ফলাফল ছিল আশাতীত! প্রথমে বিজ্ঞানীরা প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত ইদূঁরের মিউটেড জিন কে ঠিক করতে ক্রিসপার/ক্যাস পদ্ধতিকে ব্যবহার করেন। কিন্তু ফলাফল ছিল মধ্যম ধরনের এবং এই ধরনের পদ্ধতিতে একটা ভালো জিনের কপি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সমস্যার সমাধানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড লিও ক্রিসপার পদ্ধতিকে অনুকরণ করে আরেকটি জিন সম্পাদনার প্রণালী প্রস্তুত করেন।

তবে ক্রিসপার পদ্ধতির সাথে এর পার্থক্য আছে। সাধারণত ক্রিসপার প্রক্রিয়ায় ডিএনএ এর দুটো সুতায় কাটা হয় কিন্তু এই গবেষণায় ব্যবহৃত জিন সম্পাদনার পদ্ধতিটি ডিএনএ এর একটা সুতায় কাটে এবং কেবলমাত্র একটা বেসকে আলাদা করে। জিন সম্পাদকেরা এই পদ্ধতিটি আগে পৃথক পৃথক ভাবে লিভার,চোখ,কান,ব্রেন কোষে ব্যবহার করেন কিন্তু লিউ সেটি প্রোজেরিয়া রোগের সমাধানের জন্যে ব্যবহার করতে চান যা কিনা অনেকগুলো অঙ্গ অথবা টিস্যুর সাথে জড়িত। লিউ এর গবেষণা দল ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জনাথন ব্রাউন এবং ফ্রঙ্কিস কলিন এর সাথে একত্রে কাজ করা শুরু করেন। গবেষক দলটি প্রথমে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী থেকে নেয়া কিছু কালচারড কোষের মধ্যে জিন সম্পাদনা করে। দেখা যায় বেস এডিটরটি কোষগুলোর মিউটেড জিন গুলোকে ঠিক করে। তারপর তারা বেস এডিটর কে কপি করে ডিএনএ তে প্যাকেজড করে এডিনো অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাসে তা যুক্ত করেন। উল্লেখ্য যে এডিনো অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস (AAVs) জিন থেরাপিতে জিন বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তারপর তারা বেস এডিটর যুক্ত ভাইরাসটিকে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত ইদূঁরে প্রবেশ করিয়ে দেয়।

প্রজেরিয়ায় বেস এডিটর ব্যবহার করে জিন মেরামত। সুত্রঃ nature.com


পরীক্ষাটির ফলাফল সত্যিই আশাতীত ছিল। ৬ মাস পরে ইদূঁর গুলোকে পরীক্ষা করে দেখা যায় সেগুলোর হাড়, লিভার, হৃদপিন্ড, অ্যাওর্টা এর ২০%-৩০% নির্ধারিত ডিএনএ কপি বহন করছে। সেই সাথে ইদূঁর গুলোর টিস্যু কোষে লেমিন এ প্রোটিন এর পরিমাণ বেড়ে যায়। এবং কিছু মাস পরে দেখা যায় এগুলোর শরীরে পেশী কোষ বিনষ্ট হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু ইদূঁরে এডিনো অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস থেরাপি কোষে টিউমার সৃষ্টি করে কিন্তু মানুষে এখনো এমনটা ঘটে নি। তারপরেও লিউ এবং গবেষক দলটি চেষ্টা করে যাচ্ছে পদ্ধতিটির আরো অগ্রগতি ঘটাতে যাতে। গবেষণাটির সহকারী-অথর লেসাইল গরডন প্রোজেরিয়া রিসার্স ফাউন্ডেশনের কো-ফাউন্ডার। তার একটি ছেলে সন্তান প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই ঘটনাই তাকে প্রোজেরিয়া রিসার্স ফাউন্ডেশন তৈরি করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। প্রতিষ্ঠানটি জানায় শিঘ্রই তারা তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিটির একটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর ব্যবস্থা করবেন। গরডন বলেন, ”আমরা শিশুদের জন্যে সমস্যাটি সমাধান করার একটি উপায় খুঁজে পাবো”।

তথ্য সূত্রঃ সায়েন্স ম্যাগাজিন


সুজয় কুমার দাশ Avatar

মন্তব্য

  1. JANNATUL FIZA Avatar
    JANNATUL FIZA

    মুভিটি অামার দেখা হয়নি কিন্তু কাহিনীটা জানতাম। তথ্যবহুল লেখা এবং এসব রোগ সম্পর্কে অামরা জানিনা। CRISPR এর সাহায্যে ভবিষ্যৎ অনেক কিছুই ঘটতে পারে

  2. Sujoy Kumar Das Avatar

    ধন্যবাদ…❤

  3. আরাফাত রহমান Avatar

    বেস এডিটর টেকনিকটা খুবই সাম্প্রতিক অগ্রগতি। এ গবেষণাটা দারুণ, উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া গেছে। বরাবরের মতোই চমৎকার লেখা, রোগের বর্ণনা থেকে শুরু করে রোগ-সংশোধন গবেষণার সম্পর্ক সুন্দরভাবে সম্পর্কিত করেছো।

  4. b180607021 Avatar
    b180607021

    ধন্যবাদ ভাইয়া..❤

Leave a Reply