প্রকৃতি জীবনের গল্প লিখেছে কতগুলো নিউক্লিওটাইড বেস দিয়ে। সেই গল্পের ভাষা হল জিন। আর কোডন হচ্ছে এর অক্ষরস্বরুপ। কিন্তু ইচ্ছে হলেই সেই ভাষার কোন রকম পরিবর্তন এর কথা আমরা ভাবতে পারতাম না। তাই যেভাবেই জীবন নামক উপন্যাস রচিত হয় সেভাবেই উপভোগ করতে হয় আমাদের। সে দুঃখ কিংবা সুখকর। কিন্তু অণুজীববিদ এমানুয়েল শারপেনটিয়ার, প্রাণরসায়নবিদ জেনিফার ডাওডনা নামের দুই মহারথী এ অসম্ভব কে সম্ভব করেছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ গতবছর রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। তারা ক্রিসপার/ক্যাস ৯ নামক এক ধরনের জেনেটিক সিসর বা জৈবিক কাঁচি উদ্ভাবন করেন যা দিয়ে জীবের জিনোমে ইচ্ছেমত পরিবর্তন করা যায়।
কোন জীবের ক্রোমোজোমে থাকা সকল জিন কে একত্রে জিনোম বলা হয়। একটি জীবের সকল প্রকার বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত হয় জিন দিয়ে। জিন হচ্ছে জীবের ডিএনএ এর কিছু নির্দিষ্ট অংশ যা থেকে প্রোটিন সংশ্লেষিত হয়। আর প্রোটিনই জীবনের সকল প্রকার জৈবিক কার্যাবলী নিয়ন্ত্রন করে। তাই জিন কে বলা হয় জীবনের ভাষা। জিন প্রকৌশল বিদ্যায় জীবের জিন এ পরিবর্তন আনার মাধ্যমে কোন জীবে নতুন কোন বৈশিষ্ট্য যেমন খরা-সহিষ্ণু উদ্ভিদজাত তৈরি কিংবা লবণ সহিষ্ণু উদ্ভিদজাত তৈরি ইত্যাদি সম্ভব হয়। ক্রিসপার/ক্যাস ৯ প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। এর মাধ্যমে শুধু জিন এ পরিবর্তনই নয় বরং জিনের কোড গুলোকেই সাজানো সম্ভব নতুন করে। সেই সাথে ইচ্ছেমতো যেসকল জিন বিভিন্ন বংশগত রোগ সৃষ্টির জন্যে দায়ী সেসব জিন কে কেটে বাদ দেওয়াও সম্ভব।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট এর অণুজীববিজ্ঞানী এমানুয়েল শারপেনটিয়ার মূলত কাজ শুরু করেন স্ট্রেপ্টোকক্কাস পাইয়োজেনস নামক ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে। এই ব্যক্টেরিয়াকে মাংস খাদক নামে ডাকা হয় কারণ এগুলো পোষক দেহের টিস্যু কোষকে পঁচিয়ে ফেলতে পারে। শারপেনটিয়ার জানতে চাচ্ছিলেন কীভাবে এই ব্যাক্টেরিয়া এন্টিবায়োটিক এর প্রতি প্রতিরোধ তৈরি করে। তার এই প্রচেষ্টা থেকেই জৈবিক কাঁচি উদ্ভাবনের যাত্রা শুরু।
অপরদিকে হাওয়াই এ জন্মগ্রহন করা প্রাণরসায়নবিদ জেনিফার ডাওডনা শৈশবকাল থেকেই প্রচন্ড কৌতুহলি ছিলেন। একদিন তাঁর বাবার আনা জেমস ওয়াটসন ক্রিক এর লেখা ‘দ্যা ডাবল হেলিক্স’ বইটি তার বিছানায় দেখতে পান। আর সেদিনই প্রথম সে ডিএনএ সম্বন্ধে প্রথম ধারনা লাভ করেন এবং জানলেন বিজ্ঞান সত্য বই আর কিছুই নয়। যাই হোক যখন তিনি বিজ্ঞানের রহস্য সমাধানে নিয়োজিত হলেন তখন তার গবেষণার বিষয় ছিল আরএনএ। অনেক আগেই গবেষকরা জানতে পারেন ছোট ছোট কতগুলো আরএনএ অণু জীবের কোষের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নবিদ জেনিফার ডাওডনা গবেষণা শুরু করেন কীভাবে আরএনএ অণু জীবের কোষের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রন করতে পারে। পরবর্তীতে ডাওডনা তার একজন সহকারী অনুজীববিজ্ঞানীর কাছে জানতে পারেন বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াসহ কিছু আর্কিয়ায় ডিএনএ তে এমন কিছু বেস সিকোয়েন্স পাওয়া যায় যেগুলো কিনা কিছু দূরুত্ব পরপর পুনরায় উপস্থিত হয়। এই বেস সিকোয়েন্সগুলোকে বলা হয় পেলেনড্রমিক রিপিটিটিভ সিকোয়েন্স। তবে এই সিকোয়েন্সগুলোর মাঝে কিছু ভিন্ন রকমের সিকোয়েন্স থাকে যেগুলো কিনা অনন্য। বিষয়টি অনেকটা একই বই এর দুটো ভিন্ন লাইনে একই শব্দের বারবার পুনরাবৃত্তির মতো। এই ধরনের রিপিটিটিভ বেস সিকোয়েন্স গুলোকে একত্রে ক্লাস্টারড রেগোলারলি ইন্টারস্পেইসড শর্ট পেলেনড্রমিক রিপিটিটিভ সিকোয়েন্স সংক্ষেপে ক্রিসপার (CRISPR) বলা হয়। এই সিকোয়েন্সগুলো ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের ডিএনএ কাটতে ব্যবহার করে। আর এর মাঝের অন্যন্য সিকোয়েন্সগুলো ভাইরাল অ্যাটাক কে স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়।
ডাওডনা পরবর্তীতে গবেষণায় জানতে পারেন এই ক্রিসপার সিকোয়েন্স গুলো ভাইরাল ডিএনএ কাটার জন্যে কিছু প্রোটিন ব্যবহার করে যেগুলোকে ক্যাস (CAS) প্রোটিন (ক্রিসপার অ্যাসোসিয়েটেড প্রোটিন) বলা হয়। এই প্রোটিন গুলো ডিএনএ সুতাকে নির্দিষ্ট জায়গায় কাটতে পারে। তাই এগুলোকে জৈব কাঁচি বলা হয়। এই ক্রিসপার/ক্যাস সিস্টেম দুই ধরনের: ক্লাস-১ এবং ক্লাস-২। ক্লাস-১ এ ক্লাস-২ এর তুলনায় ক্যাস প্রোটিন বেশি দরকার হয়।
অপরদিকে বার্লিন এ গবেষণারত অবস্থায় শারপেনটিয়ার স্ট্রেপ্টোকক্কাস পাইয়োনেজ ব্যাক্টেরিয়ায় কিছু আরএনএ সিকোয়েন্স এর সন্ধান পান যেগুলো ক্রিসপার সিকোয়েন্স এর মতোই। সেই সাথে এক ধরনের ছোট আরএনএ সিকোয়েন্স পান যেগুলোকে ট্র্যাকর আরএনএ (tracr RNA) বলা হয়। এই আরএনএ ক্রিসপার আরএনএ সিকোয়েন্স গুলোকে সক্রিয় করতে ব্যবহৃত হয়। শারপেনটিয়ার এর পাওয়া ক্রিসপার/ক্যাস সিস্টেম ক্লাস-২ ধরনের। এই সিস্টেমটি ক্যাস-৯ প্রোটিন ব্যবহার করে। তাই এই সিস্টেমকে ক্রিসপার/ক্যাস-৯ সিস্টেম বলা হয়। শারপেনটিয়ার তার আবিষ্কৃত এই ক্রিসপার/ক্যাস-৯ সিস্টেম এর ব্যাপারে জেনিফার ডাওডনার সাথে আলোচনা করতে পুয়ের্তো রিকন ক্যাফে তে দেখা করেন।তারা শারপেনটিয়ারের আবিষ্কৃত পদ্ধতিকে ইন ভিট্রু প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করতে গিয়ে জানতে পারেন ট্র্যাকর আরএনএ গুলো ক্রিসপার/ক্যাস-৯ সিস্টেম কে নির্দিষ্ট স্থানে কাটতে সহায়তা করে। এগুলো মূলত সিস্টেমটিকে ডিএনএ এর নির্দিষ্ট জায়গা চিনিয়ে দিতে সহায়তা করে।
পরবর্তীতে তারা ক্রিসপার আরএনএ এবং ট্র্যাকর আরএনএ কে একীভূত করে একটি আরএনএ অণু তৈরি করেন যেগুলোকে গাইড আরএনএ (guide RNA) নাম দেয়া হয়। একই সময়ে তারা এমন পরিকল্পনার কথা ভাবলেন যাতে গাইড আরএনএ আগে থেকে নির্ধারন করা ডিএনএ সিকোয়েন্স কাটতে পারে। সে জন্যে তারা একটি ডিএনএ সুতার পাঁচটি জায়গা নির্বাচন করেন এবং গাইড আরএনএ তেও ওই পাঁচটি সিকোয়েন্সের অনুরূপ সিকোয়েন্স যুক্ত করেন। তারপর দেখা গেল গাইড আরএনএ ডিএনএ অণুর ঠিক ওই পাঁচটি জায়গাতেই কাটে।
শারপেনটিয়ার এবং ডাওডনার আবিষ্কৃত ক্রিসপার/ক্যাস-৯ পদ্ধতিটি সত্যিই দারুণ। জিন প্রকৌশলের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগ এর সূচনা করেছে। এর মাধ্যমে ডিএনএ অণুতে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন আনা যাবে। ডিএনএ অণুতে জেনেটিক কোডগুলো নতুন করে লেখা যাবে। ইচ্ছে মতো ফল্ট জিন গুলো কেটে বাদ দেয়া যাবে। যেসব দুরারোগ্য বংশগত রোগের কোনো সমাধান চিকিৎসা বিজ্ঞানে ছিল না অদূর ভবিষ্যতে সেসব রোগও নিরাময় করা সম্ভপর হবে। ক্যান্সার,মাসকুলার ডিসট্রফি, সিকল সেল অ্যানেমিয়া, বেটা থ্যালাসেমিয়ার মতো ব্যাধিগুলোর সমাধানও হয়ত মেলবে মানুষের কাছে। জীবনের উপন্যাস এবার নতুন করে লেখার সময় এসেছে।
তথ্যসূত্রঃ ”দ্যা নোবেল প্রাইজ” ওয়েব পেইজ।
Leave a Reply