ই উভাল নোয়া হারারির লেখা “স্যাপিয়েন্স” বইটায় পড়েছিলাম প্রায় ত্রিশ হাজার বছর পূর্বে হোমো স্যাপিয়েন্সরা একটি শৈল্পিক জাতি হিসেবে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বিস্তার করে। হোমো নিয়ান্ডার্থালেরা যদিও স্যাপিয়েন্সদের তুলনায় অধিক পেশিবহুল ছিল তারপরেও তারা স্যাপিয়েন্সদের সাথে প্রতিযোগীতায় টেকে নি। এর কারণ হিসেবে বলা যায় স্যাপিয়েন্সদের কল্পনা করতে পারার সামর্থ্য অর্জন। যার ফলে তারা শিখতে পেরেছিল নতুন নতুন রণ কৌশল। স্যাপিয়েন্সদের এই কল্পনা করতে পারার সক্ষমতাই তাদেরকে নিজদের আরো সংগঠিত এবং সমস্যা মোকাবেলা করার জন্যে যোগ্য করেছিল। তাদের এই কল্পনা করবার বিষয়টি সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগে তাদের বানানো শিল্পকলা গুলো দেখে। প্রায় ত্রিশ হাজার বছর পূর্বে স্টেডেউর গুহায় নির্মিত হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক শিল্পকর্ম “পিয়োজ” ( সিংহ মানব অথবা সিংহ মানবি)।

সম্প্রতি দক্ষিন এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫,০০০ বছর পূর্বের পুরোনো একটি গুহাচিত্রের সন্ধান মেলে যেটি ছিল মূলত একটি গড়ুবত শূকর এবং একটি মানুষের হাতের রূপরেখার চিত্র। পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ বোর্নিও এর পূর্বে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ সুলাওসিতে লেয়াং টেডংঞ্জ গুহায় সন্ধান মেলে।বুধবারে এ সম্পর্কিত মূল গবেষণাটি প্রাকাশিত হয় সায়ন্স এডভান্স পত্রিকায়। পাশ্চাত্য সভ্যতায় সবচাইতে প্রাচীন গুহা চিত্র বলতে লাসাক্সের চিত্রগুলো কে বিবেচনা করা যায়। লাসাক্স গুহাটি দক্ষিন পশ্চিম ফ্রান্সে অবস্থিত। এটি প্রাগৈতিহাসিক মানুষ এবং প্রাণীর চিত্রকর্মের জন্যে বিখ্যাত। লাসাক্স চিত্রকর্ম গুলো প্রায় ১৭০০০ বছর পূর্বের পুরোনো। কিন্তু সুলাওসিতে নতুন আবিষ্কৃত শূকরের চিত্রকলাটি অন্তত ৪৫,৫০০ব বছরের পুরোনো হবে। গবেষণা প্রবন্ধটির কো-অথর ম্যাক্সিম আবার্ট বলেন “চিত্রকর্মটির বয়স ন্যূনতম ৪৫,৫০০ বছর পূর্বে হতে

পারে। কিন্তু এর বয়স আরো বেশি ( প্রায় ৬০,০০০-৬৫,০০০) হতে পারে। তবে তার জন্যে আমাদের আরো প্রমাণ দরকার। গবেষকরা ৭০ বছর আগে থেকে সুলাওসি তে কাজ শুরু করেন। এ যাবত প্রায় তিনশোর মতো চিত্রকলা যুক্ত গুহা আবিষ্কার করেন। ২০১৯ এর শেষ এর দিকে আবার্ট এবং তার সহকর্মীরা সুলাওসিতে প্রায় ৪৩,৯০০ বছরের পুরোনো একটি শিকারের চিত্রকর্ম আবিষ্কার করেন। সুলাওসি তে মানব বসতির অনেক পুরোনো ইতিহাস রয়েছে। তবে ঠিক কবে সুলাওসি তে অঙ্গসংস্থানগত দিক থেকে আধুনিক মানুষেরা (অ্যানাটমিক্যাললি মডার্ন হিউম্যান) বসতি শুরু করে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। দক্ষিন এশিয়ার সমতল ভূমি সুন্দায় প্রায় ৭০-৬৩ হাজার বছর পূর্বে আধুনিক মানুষেরা সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে বলে জানা যায়। যদিও এই নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। শিলা চিত্রকর্মের সর্বপ্রথম সন্ধান মেলে ৭০ বছর আগে দ্বীপটির দক্ষিন পশ্চিম এর একটি উপদ্বীপে। প্রাচীন এই শিলা চিত্রকর্ম গুলোর বয়স নির্ধারন অনেকটাই চ্যালেঞ্জ এর ব্যাপার। কিন্তু সুলাওসি দ্বীপ এর গুহায় জমে থাকা চুনাপাথর এই কাজটি সহজ করে দিয়েছে। এই চুনাপাথর এর স্তুপ গুলো স্পেলোথেমস (গুহায় পাওয়া বিভিন্ন খনিজের জমাকৃত স্তুপ কে স্পেলোথেমস বলা হয়) গঠনকে ত্বরিত করে। সাধারণত শিলার উপর পানি প্রবাহ থেকে এই খনিজ গুলো অধঃক্ষিপ্ত হয়ে জমা হতে থাকে। স্ট্যালাকটিটস এবং স্ট্যালাগমিটস হল স্পেলোথেমস এর উদাহরণ। শিলার প্রাচীরে যে অংশটাতে চিত্রকর্মটি করা হয় সেখানেও স্তরে স্তরে কিছু পরিমাণ স্পেলোথেমস জমতে পারে।

ইউরেনিয়াম ডেটিং (ইউ ডেটিং) প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এর বয়স বের করার চেষ্টা করেন। স্পেলোথেমসে থাকা খনিজ এ ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম পরমানুর অনুপাত হিসেব করে কাজটি করা হয়। ইউ ডেটিং হচ্ছে এক ধরনের রেডিওমেট্রিক ডেটিং প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে ফসিল বা প্রাগৈতিহাসিক কোন চিত্রকর্মে থাকা ইউরেনিয়াম পরমানুর ক্ষয় এর হার হিসেব করা হয়। প্রতিটি তেজস্ক্রিয় পরমানুরই একটি নির্দিষ্ট ক্ষয় এর হার থাকে। যখন ইউরেনিয়াম ক্ষয় হতে থাকে তখন এটি পর্যায়ক্রমে কয়েকটি সিরিজ এ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। প্রথমে ইউরেনিয়াম ২৩৮ ইউরেনিয়াম ২৩৪ এ পরিণত হয় এবং ইউরেনিয়াম ২৩৪ থোরিয়াম ২৩০ এ রূপান্তরিত হয়। থোরিয়াম পরে রেডিয়াম আইসোটোপ এ রূপান্তরিত হয়। রেডিয়াম রূপান্তরিত হয় রেডন এ। এভাবে ধীরে ধীরে নিম্ন ভর বিশিষ্ট আইসোটোপ এ রূপান্তরিত হতে থাকে যতক্ষন না এটি স্থির আইসোটোপ লেড বা সীসায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এভাবে একটা ক্ষয় শিকল তৈরি হয়। প্রথম আইসোটোপ কে বলা হয় প্যারেন্ট বা মাতৃ আইসোটোপ আর যেগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোকে বলা হয় ডটার আইসোটোপ। ইউ সিরিজ ডেটিং প্রসেস ব্যবহার করা হয় স্ট্যালাগমিটিক ক্যালসাইট তৈরির বয়স নির্ধারন করতে।

পানির প্রবাহ হতে অধঃক্ষিপ্ত ক্যালসাইট ক্রিস্টাল(ক্যালসিয়াম কার্বনেটের স্ফটিক) জমে জমে স্ট্যালাগমাইট তৈরি হয়। স্ট্যালাগমিটিক ক্যালসাইট গুলো স্পেলোথেমস তৈরি করে। এই ক্যালসাইট ক্রিস্টাল গুলো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ইউরেনিয়াম ধারন করে। ইউরেনিয়াম পানিতে দ্রবীভূত হয়। সম্ভবত এই কারণেই ক্যালসাইটে ইউরেনিয়াম জমা হয়। কিন্তু থোরিয়াম পানিতে দ্রবীভূত হয় না। তাই স্পেলোথেমস এ থোরিয়াম পাবার কথা নয়। এর অর্থ হল যদি স্পেলোথেমস এ থোরিয়াম পাওয়া যায় তাহলে সেটা ইউরেনিয়াম এর ক্ষয় থেকে তৈরি হয়। থোরিয়াম নিজেও তেজস্ক্রিয়। তাই এটাও ক্ষয় হতে থাকে। এটি চলতে থাকে যতক্ষণ না থোরিয়াম এবং ইউরেনিয়াম এর অনুপাত সমান হচ্ছে। আর থোরিয়াম আর ইউরেনিয়াম এর অনুপাত থেকেই বের করা যায় কত সময় পূর্বে ক্যালসাইট ক্রিসটাল (ক্যালসিয়াম কার্বনেটের স্ফটিক) গঠিত হয়েছিল। থোরিয়াম এর অর্ধায়ু ( যে সময়ে এর অর্ধেক ক্ষয় প্রাপ্তি হয়) ৭৫,৭০০ বছর। এই তত্ত্ব কে ব্যবহার করেই ইউ ডেটিং করা হয়। এবং এভাবে বিভিন্ন ফসিল, প্রবাল প্রাচীর কিংবা সুলাওসি তে পাওয়া শিলা চিত্রকর্মের বয়স বের করা হয়। সুলাওসি দ্বীপ এ পাওয়া তিনটা গড়ুবত শূকর এবং মানুষের হাতের ছাপের গুহাচিত্রটি বাসরান বুরহান আবিষ্কার করেন যিনি কিনা গবেষণাটির একজন কো-অথর। ইউ ডেটিং করে তারা চিত্রকর্মটির বয়স হিসেব করেন ৪৫,৫০০ বছর।
ওটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এমেরিটাস প্রফেসর জেমস ও’কনেল বলেন,”সত্যিই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান”। নতুন এই গবেষণা সুলাওসি দ্বীপ এ কত সময় পূর্বে আধুনিক মানুষেরা এসেছিল তার ধারণা মেলবে। এই চিত্রকর্ম এটাও বলে যে প্রাচীন মানুষদের কাছে শূকর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে পল পেট্টিট, ডোরহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালেওলিথিক প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ, বলেন যে “যেহেতু আমাদের কাছে এখনো পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই তাই হতেও পারে এটি মানুষের অন্য কোনে প্রজাতি তৈরি করেছে”।
তথ্যসুত্রঃ ১। সায়নটিফিক এমেরিকান ডট কম। মূল গবেষণা পত্রঃ সায়ন্স এডভান্সেস পত্রিকা
Leave a Reply to Sujoy Kumar DasCancel reply