গ্রিক মিথোলজিতে কাইমেরা নামক এক দৈত্যের কথা উল্লেখ আছে যার শরীর ছিলো তিনটি প্রাণীর সমন্বয়ে গঠিত। মাথাটা ছিল সিংহের, শরীরের মধ্যাংশে ছিল ছাগলের মাথা ঠিক সিংহের মুখের বিপরীতে এর মুখ ঘোরানো এবং লেজ হিসেবে ছিল একটি সাপ। ভয়ংকর এই দৈত্য ছিল টাইফন এবং একিডনা নামক দুই দৈত্যের সন্তান। আর সেরবেরাস এবং হাইড্রা ছিল এর ভাই বোন। গ্রিক পুরাণের সেই কাইমেরা নামটি এখন ব্যবহৃত হয় একাধিক প্রাণীর শরীর এর কোনো অংশ নিয়ে গঠিত কোনো প্রাণীকে বোঝাতে। সেটি হতে পারে একই দেহে দুই সেট ক্রোমোজোম যার এক সেট ক্রোমোজোম হবে অন্য কারো কিংবা সেই ব্যক্তি এখনো পৃথিবীতেই নেই। কাইমেরাজম আমাদের মানুষের মাঝেও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন মানুষের দেহে দুইটি আলাদা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে কিংবা একজনের শরীরে দুই সেট আালাদা ক্রোমোজোম। যার এক সেট হতে পারে তার কোনো ভাই-বোনের যার কিনা জন্মই হয় নি!
বিজ্ঞানীরা এই প্রথম এমন এক কাইমেরা ভ্রুণ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন যা বানর আর মানুষের জনন কোষের সমন্বয়ে তৈরি। ১৫ই এপ্রিল সেল জার্নালে এমনই এক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গবেষণাদলটি বানরের ভ্রূণ এ মানুষের স্টেম কোষ যুক্ত করেন এবং সেগুলোর বিকাশ লক্ষ্য করেন। তারা খেয়াল করেন মানুষ এবং বানরের কোষ গুলো বিভাজিত হচ্ছে এবং নিষেকের ১৯ দিন পর্যন্ত তিনটি ভ্রূণ টিকে থাকে। প্রতিটি ভ্রূণেই মানুষের কোষ ছিল এবং সেগুলোর বিকাশ ছিল ভিন্ন ভিন্ন রকমের। ক্যালিফোর্নিয়া লা জুলার সল্ক ইন্সটিটিউট এর জীববিজ্ঞানী জুয়ান কার্লোস ইজপিসুয়া বেলমন্টে এমনটা জানান।
কেন এই ধরণের গবেষণাঃ
গবেষকরা মনে করছেন এই রকম মানুষ এবং অন্য কোন প্রাণীর কাইমেরা কোন ঔষধ এর ট্রায়াল মডেল হিসেবে বেশ উপযুক্ত হবে। এ ছাড়া এইসব মডেল এ মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি করা যাবে যা অঙ্গ প্রতিস্থাপন এ ব্যবহৃত হতে পারে। গবেষক দলটি জানায় তারাই প্রথম ২০১৯ সালে মানুষ এবং বানরের ভ্রূণ তৈরি করতে সফল হয়েছিলেন যা কিনা নিষেকের পর প্রায় ২০ দিন টিকে ছিল। এছাড়া ২০১৭ সালে তারা মানুষ ও অন্যান্য প্রানির সংকর ভ্রূণ যেমনঃ মানুষ ও শুঁকর এর ভ্রূণ, মানুষ ও ইঁদুরের সংকর ভ্রূণ এবং মানুষ ও গরুর সংকর ভ্রূণ তৈরি করতে সমর্থ হরেছিলেন।
কিন্তু নতুন এই গবেষণা কাজটি জীববিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে বিভক্ত করেছে। প্রশ্নগুলো বাস্তবিক ভাবেই নীতিগত দিক থেকে। কারণ এখানে মানুষের সাথে ব্যবহৃত অন্য প্রাণীটি (বানর) শ্রেণীবিন্যাসগত দিক দিয়ে মানুষের খুব কাছের একটি প্রাইমেট সদস্য। ইঁদুর কিংবা বীবর এর মতো মডেল হিসেবে এদের ব্যবহার অতটা স্বাধীন নয়। এখানে নীতিগত প্রশ্ন রয়েছে। এইরকম ননহিউম্যান প্রাইমেট সদস্যদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শক্ত রকমের নীতিগত প্রশ্নে বাঁধা। বার্সেলোনার পম্পেউ ফ্যাব্রা বিশ্ববিদ্যালয় এর জীববিজ্ঞানী আলফোনসো মার্টিনেজ আরিয়াস বলেন,
“ শুঁকর, গরু কিংবা ইঁদুর এর মতো প্রানী নিয়ে এরকম গবেষণা গুলো নীতিগত প্রশ্ন গুলো তৈরি করে না যেমনটা প্রাইমেট সদস্যদের নিয়ে করলে হয়”।
গবেষণার ব্যর্থতা সফলতাঃ
ভ্রুনের বিকাশের সময় দুইটা আলাদা প্রজাতির জীবের কোষ সমূহ কীভাবে একে অপরের সাথে খাপ খাওয়ায় সেটা বোঝা ছিল গবেষকদের কাছে গুরত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ইঁদুর এবং মানুষের সংকর ভ্রূণগুলো ছিল খুবই দুর্বল এবং ব্যবহার করার জন্যে অনুপযুক্ত। এই রকম সংকর ভ্রূণ গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা পোহাতে হয়। কারণ ইঁদুর আর মানুষ বিবর্তনীয় দিক থেকে অনেক দূরে। সুতরাং বলা যায় এদের কোষ গুলো পরস্পরের সাথে ভিন্ন উপায়ে খাপ খাওয়ায়। কিন্তু বানর এবং মানুষ উভয়ই প্রাইমেট বর্গের। এবং এরা বিবর্তনীয় দিক থেকে পরস্পরের বেশ নিকট সদস্য। তাই এদের কোষ গুলো কীভাবে পরস্পরের সাথে মানিয়ে নেয় এটা অপেক্ষাকৃত বোঝা সহজ। সেই সাথে ভবিষ্যতে ইঁদুর-মানুষ এর ভ্রূণ মডেল গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে দরকারি উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।
গবেষকরা সাইনোমোলগাস ( ম্যাকাকা ফ্যাসিকোলারিস ) বানর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু সংগ্রহ করেন এবং একটি কালচার মিডিয়ামে আবাদ করেন। নিষেকের ৬ দিন পরে তারা এরকম ১৩২ টি ভ্রুনে মানুষের প্লুরিপুট্যানট কোষ যুক্ত করেন। ভ্রূণগুলো মানুষ এবং বানরের কোষ সহ বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে ভ্রূণ এর সংখ্যা কমতে থাকে। নিষেকেরে ১১ দিন পর ৯১ টি ভ্রূণ টিকে ছিল। ১৭ দিনের মাথায় সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় ১২ তে এবং ১৯ দিন পর কেবল ৩ টি ভ্রূণ টিকে ছিল। হিউম্যান প্লুরিপুট্যানট কোষ বানরের ভ্রুনে টিকে থাকতে পারে
এবং বিকশিত হতে পারে এই গবেষণাটি তা প্রমাণ করে। তবে কোন কোষ গুলো কোন টিস্যু গঠন করেছে সেটা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় গবেষকরা। কিন্তু ভ্রূণ মডেল গুলো ব্যবহার করার জন্যে এই বিষয়টা বোঝা জরুরি।
ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত প্রাইমেট ভ্রূণের সাথে মানব কোষের সংমিশ্রণ ফলাফল সৃষ্ট সংকর জীবগুলির পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিছু কিছু লোক এর মতে এভাবে নৈতিক দিক দিয়ে অস্পষ্ট স্বত্ত্বা তৈরি হবে।
গবেষণার সীমাবদ্ধতাঃ
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর স্টেম সেল রিসার্চ (ISSCR) গবেষণাটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে ভাবছে। তবে তারা বর্তমানে এই ধরণের কাইমেরা নিয়ে গবেষণায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপান বিভিন্ন সময়ে এই ধরণের কাইমেরা নিয়ে সীমাবদ্ধ গবেষণা করেছে। তবে জাপান ২০১৯ সালে মানুষ এবং অন্য প্রাণীর কাইমেরা তৈরির গবেষণার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছে এবং গবেষণা চালিয়ে যাবার জন্যে অর্থায়ন করেছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এ ঘরানার গবেষণার ক্ষেত্রে অর্থায়ন করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ২০১৬ সালে তারা তা প্রত্যাহার করে। তবে ভ্রুণ গুলো গ্যাস্ট্রোলেশন ধাপ যখন স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হওয়া শুরু হয় সে পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে যাবার একটা সীমারেখা টেনে দেয়। এর চার বছর পরেও তারা এ ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। তারা বলছে তারা ISSCR এর এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে।
তথ্যসুত্রঃ নেচার ডট কম।
Leave a Reply