গেম অব জিনোমস
মূল: কার্ল জিমার
অনুবাদ: আরাফাত রহমান
[আগের অধ্যায় | সূচীপত্র | পরের অধ্যায়]
খন্ড-১, অধ্যায়-২
নিজের জিনোম সিকোয়েন্স করবো। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছুদিন পর আমি বোস্টনের এক হাসপাতালে আবিষ্কার করি। একজন বংশগতি-বিশেষজ্ঞ আমার মুখে আকুপাকু করে কিছু খুঁজছিলেন।
ড. রবার্ট গ্রিন বললেন, “আমি আসলে তোমার চেহারায় কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে কি না সেটা খুঁজছি, যা থেকে তোমার বংশগতির রোগ থাকলে তার ইঙ্গিত দেবে। যেমন ধরো চোখের আকৃতি, তোমার কান নিম্নমুখি কি না, কানের গঠনের জটিলতা ইত্যাদি।”
ড. গ্রিন তারপর আমাকে তার ব্রিগহাম ও মহিলা হাসপাতালের অফিসে এদিক-ওদিক হাঁটতে বললেন। ওয়েস্টমিনিস্টারে প্রতিবছর একটি বিখ্যাত কুকুর-প্রদর্শনী হয়। সেখানে নানা জাতের শৌখিন কুকুর নিয়ে বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করেন মালিকেরা। আমার নিজেকে তখন সেই প্রদর্শনীর একটি পিচ্চি টেরিয়ার কুকুর মনে হচ্ছিলো। অবশ্য গ্রিন পরে বোঝালেন যে বংশগতির কিছু লুকানো বংশব্যাধি মানুষের হাঁটার ধরনেও বিশেষ ছাপ ফেলে।
আমার হাঁটার ভঙ্গি দেখার সময়ে ড. গ্রিন বললেন, “ভবিষ্যতে হয়তো চিকিৎসকরা এগুলোকে অপ্রয়োজনীয় সতর্কতা বলবেন। সমস্যা হলো কিভাবে আমরা জিনোম সিকোয়েন্সিং করবো তার সুনির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড নেই। এজন্য আমি এভাবে তোমার জিনোম সিকোয়েন্সিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
কোন বংশগতিবিজ্ঞানীকে আমি আগে কখনো তাৎক্ষণিক-প্রবর্তিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখি নি। তবে নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার জিনোম-গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মানব-প্রজাতির ইতিহাসে আমরা আগে কখনো নিজেদের ডিএনএ-লিখন দেখতে পাই নি। বিজ্ঞানীরা এখনো বোঝার চেষ্টা করছেন জিনোম কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। আর ড. গ্রিন হলেন সেসব চিকিৎসকের একজন যারা স্বাস্থ্য-চিকিৎসায় জিনোম ব্যবহারের নিয়ম-নীতি ঠিক করার চেষ্টা করছেন।
এর এক মাস আগে ড. গ্রীন আমাকে ইল্যুমিনা কোম্পানির একটি শিক্ষামূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে জিনোম সিকোয়েন্স করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইল্যুমিনা হলো ডিএনএ-সিকোয়েন্সিং করার ক্ষেত্রে শীর্ঘে থাকা কোম্পানি। এর জন্য আমার একদফার শারিরীক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তারপর ড. গ্রিন আমার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। এ নমুনা বোস্টন থেকে স্যান দিয়েগো শহরে পাঠানো হয়। রক্তের নমুনা থেকে ইল্যুমিনা আমার জিনোম সিকোয়েন্স করে। এছাড়া ইল্যুমিনার পক্ষ থেকে একটি সেমিনারেও অংশ নেই আমি। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিতে ৩,১০০ মার্কিন ডলার খরচ হয়।
ইল্যুমিনার দলটি আমার রক্তকোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে। তবে ইল্যুমিনার প্রযুক্তি বই পড়ার মতো করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারে না। প্রথমত, ডিএনএ এতোই বড় যে এভাবে পড়তে গেলে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া কোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহের সময় ডিএনএ ভেঙে যেতে পারে।
এর বদলে ইল্যুমিনা এমন কিছু করলো যা কিছুটা অদ্ভূত। ডিএনএকে অজস্র ছোট ছোট টুকরা ভাঙা হয়। তারপর এসব টুকরার অজস্র অনুলিপি তৈরি করা হয়। এসব ছোট-দৈর্ঘ্যের অনুলিপি পড়া হয়। তারপর সব টুকরাকে জোড়া লাগিয়ে পূর্ণ জিনোম কেমন ছিলো তার সমাধার করা হয়।
এক্ষেত্রে ইল্যুমিনা মূলত ডিএনএ-র নিজের অনুলিপি তৈরির বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে। প্রথমে দ্বিসূত্রক ডিএনএকে দুইটি সূত্রে আলাদা করা হয়। তারপর প্রতিটি সূত্রের বিপরীতে নুতন একটি পরিপূরক সূত্র তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ার সৌন্দর্য হলো এর সারল্যে। ডিএনএ-র একটি বেস কেবলমাত্র অন্য একটি বেসের সাথে জোড়-বাঁধতে পারে: A-র সাথে T এবং C-র সাতে G। আমার ডিএনএর পাঠোদ্ধার করতে ইল্যুমিনা মূলত এই রসায়নটিই অনুকরণ করে।
প্রথমে ইল্যুমিনার বিশেষজ্ঞ দলটি আমার ডিএনএ-কে ছোট ছোট টুকরায় ভেঙে ফেলে। প্রতিটি টুকরার দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৪০ বেস। তারপর প্রতিটি টুকরারর অজস্র অনুলিপি করা হয়। উদ্দেশ্য যাতে প্রতিটি টুকরাকে অনেকবার সিকোয়েন্সিং করা যায়। টুকরোগুলোকে এরপর তারা একটা ছোট চিপে যুক্ত করে রাসায়নিক মিশ্রণে প্লাবিত করে।
রাসায়নিক মিশ্রণে অজস্র বেস মুক্তভাবে থাকে। একে একে এসব বেস ডিএনএ-টুকরাগুলোর সাথে যুক্ত হয়। এর মাধ্যমে প্রতিটি ডিএনএ টুকরার বিপরীত সূত্রক তৈরি হয়। যখনই একটি মুক্ত বেস কোন ডিএনএ-টুকরায় যুক্ত হয়, ইল্যুমিনার সূক্ষ্ম যন্ত্র ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করে রাখে। সিকোয়েন্স মেশিনের সাথে যুক্ত কম্পিউটার প্রতিটি সংযুক্তি-ঘটনা থেকে মূল ডিএনএ-সূত্রকের সিকোয়েন্স পাঠোদ্ধার করে ফেলে।
ইল্যুমিনার গবেষকদল তারপর আমার ডিএনএ সিকোয়েন্সের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বারো হাজার ব্যাধির জন্য আমার ঝুঁকি কতটুকু তা বোঝার চেষ্টা করেন। এসব ব্যধির মধ্যে আছে ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো জানাশুনা রোগ থেকে শুরু করে শারুবিসম-নামক অজ্ঞাতপ্রায় রোগ (শারুবিসম রোগে মুখের চোয়াল সিস্ট দিয়ে ভরে যায়)।
আমার ডিএনএ সিকোয়েন্সে তাদের এই অনুসন্ধান শুরু হলে আমি বেশ চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। আমার পঞ্চাশতম জন্মদিন ঘনিয়ে আসছে। যদিও আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালো, তবুও পরবর্তী কয়েক দশকে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে তা আমাকে ভাবায়। আমার দাদার বয়স চল্লিশের ঘরে থাকতেই হৃদরোগে মারা যান। দাদী এর দশ বছর পর ক্যন্সারে মারা যান। অন্যদিকে আমার নানা বেঁচে ছিলেন ৮৮ বছর পর্যন্ত, আর নানী গত গ্রীষ্মে নব্বইতম জন্মদিন উদযাপন করলেন। এজন্য মাঝে মাঝে আমি ভাবি যে বংশগতির লটারিতে আমি আসলে কেমন করলাম?
বোস্টনে ড. গ্রিনের সাথে সাক্ষাতের কয়েক সপ্তাহ পরে আমি হাসপাতাল থেকে একটা ফোন পাই। তারা ইল্যুমিনার কাছ থেকে ফলাফল সংগ্রহ করেছে। ফোন করেছিলেন শেইলা সুটি, হাসপাতালের একজন কাউন্সেলর। তিনি জানালেন আমার রিপোর্টে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। রিপোর্টটা নাকি বেশ নিরীহ।
ইলুমিনার মতে আমি হয়তো কিছু কিছু ঔষুধে ভালোভাবে সাড়া দেব না। কিন্তু তারা এমন কোন প্রমাণ পায় নি যে আমি কোন বংশব্যাধিতে আক্রান্ত। তবে আমি দুইটি বংশব্যধির জন্য বাহক। তারমানে আমার একটি মিউটেশন আছে যা আমার বাচ্চাকাচ্চাদের রোগাক্রান্ত করে দিতে পারে — যদি আমার স্ত্রী থেকেও তারা একই মিউটেশন পায়। যেহেতু এসব রোগ আমাদের সন্তান ছোট থাকতেই ধরার পড়ার কথা, সেহেতু আমার পরিবারের জন্য সেগুলো দুশ্চিন্তার কিছু নয়।
ব্যাস। এটুকুই।
সুটির সাথে কথা হওয়ার পর আমার উদ্বেগ আর থাকে না। তেমন কোন দু:সংবাদ নেই। কিন্তু কিছু সময় যাওয়ার পর পুরো অভিজ্ঞতাটি আমার জিনোমকে বিরক্তিকর একটা বিষয় বানিয়ে ফেললো। আমার মনে হলো কোথাও নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে। প্রতিটি মানুষের জিনোম অসীম-আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত — যদি গভীরভাবে তা বিশ্লেষণ করা হয়।
নিজের জিনোম সিকেয়েন্স করার অনেক আগে থেকেই এ ব্যপারে আমার আগ্রহ ছিলো। কয়েক বছর আগে সান্তা ক্রুজে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জিন-গবেষক দম্পত্তির সাথে আমি মধ্যাহ্নভোজে কথা বলছিলাম এ বিষয়ে। তারা হলেন বেথ শ্যাপিরো ও এড গ্রিন। মনে পড়লো শ্যাপিরো বলেছিলেন, “জানো তোমার একদিন কি করা উচিত? তোমার নিজের জিনোম সিকোয়েন্স করা উচিত। তারপর কি জানো কি করা উচিত? তোমার জিনোম সিকোয়েন্সের BAM ফাইল সংগ্রহ করা উচিত। যদি সেটা করতে পারো, তাহলে আমাদের মতো গবেষকদের তুমি ফাইলটা দিতে পারো। তাহলে তুমি বুঝবে আসলে তোমার জিনোমে কি হচ্ছে।”
BAM ফাইল কি তা আমি জানতাম না। আমার এই না জানা স্বীকার করার কোন সহসও ছিলো না তখন। কিন্তু এখন, সেই কথোপকথনের কয়েক বছর পরে, BAM ফাইল কি তা বের করার সময় হয়েছে।
প্রচ্ছদ ছবি: Molly Ferguson, মূল সিরিজ থেকে নেয়া।
[আগের অধ্যায় | সূচীপত্র | পরের অধ্যায়]
Leave a Reply