[একমেবাদ্বিতীয়ম্ সংযোজন – ২য় কিস্তি]
সুকেন্দ্রীক-কোষের কিছু অংশ এক সময় অন্তঃমিথোজীবী স্বাধীন অণুজীব হিসেবে ছিলো যারা পরবর্তীতে অন্য কোষের মধ্যে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে নেয় – রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্ট্যানটিন মেরেস্কোস্কি ১৯০৫ সালে সর্বপ্রথম এ ধারণা দেন। তিনি ভেবেছিলেন নিউক্লিয়াস এভাবে গড়ে উঠেছে, আর সৌরালোক থেকে উদ্ভিদকোষকে শক্তি জোগানো ক্লোরোপ্লাস্টের উদ্ভবও একইভাবে। অন্তঃমিথোজীবির তালিকায় প্রথমে মাইটোকন্ড্রিয়া বাদ গেলেও ১৯২৩ সালে আমেরিকান শরীরবিদ ইভান ওয়ালিন একে যুক্ত করেন।
ধারাবাহিকের সূচী: ধারাবাহিকের সূচী: কিস্তি ১. প্রাণের প্রথম একশ কোটি বছর কেন একঘেয়ে ছিলো? কিস্তি ২. সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব কেন অসম্ভব-সম্ভাবনা ছিলো? কিস্তি ৩. প্রাককেন্দ্রিক জিনেরা সুকেন্দ্রিক জিনোমে কিভাবে কর্মবিভাজন করলো? কিস্তি ৪. মাইটোকন্ড্রিয়াহীন সুকেন্দ্রিকদের হুমকি সামলানো গেলো কিভাবে? কিস্তি ৫. কোষের শক্তি কোথেকে আসে? কিস্তি ৬. কেন সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব গবেষণায় অনিশ্চয়তা নিশ্চিত?
দশকের পর দশক ধরে এসব ভাবনা উপেক্ষিত ছিলো, যতক্ষণ না আমেরিকান জীববিজ্ঞানী লিন মার্গুলিস ১৯৬৭ সালে তাদের পুনর্জাগরিত করেন। একটি বৈপ্লবিক নিবন্ধে তিনি বলেন মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট একসময় মুক্ত-ব্যক্টেরিয়া ছিলো যাদেরকে অন্য একটি প্রাচীন অণুজীব পরপর গিলে ফেলেছে। মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে ধারণকৃত জিনোম দেখতে ব্যক্টেরিয়া জিনোমের মতো মনে হওয়ার এটাই কারণ। মাগুলিস বললেন যে অন্তঃমিথোজীবিতা কোন পাগলামী বা উদ্ভট ধারণা নয় – বরং সুকেন্দ্রীকদের আগমণ-সংগীতে বাজানো স্থায়ী সুর, যা বার বার ফিরে আসবে।
সেই বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটি জীবকোষবিদ্যা, জৈবরসায়ন, ভূতত্ত্ব, জিনতত্ত্ব ও জীবাশ্মবিদ্যার ক্ষেত্রে বিশেষ নৈপূণ্যের সাথে উপস্থাপিত একটি প্রস্তাবনা ছিলো। সেই নিবন্ধের উপসংহার ছিলো তৎকালীন জীববিজ্ঞানের ভাবনা-গন্ডীর বাইরে। সে সময় বেশিরভাগ মানুষ ভাবতো যে মাইটোকন্ড্রিয়া কোষের অন্য অংশ থেকে বিবর্তিত। জার্মানির হেনরিখ হেইন ইউনিভার্সিটির বিল মার্টিন বলেন,
“অন্তঃমিথোজীবিতা ছিলো নিষিদ্ধ। আপনাকে কোন লুকোনো কুঠুরিতে গিয়ে নিজের কানে এ কথা ফিসফিস করতে হবে; ভাবনাটা আরেকবার ফিরে আসার আগেই।”
বিল মার্টিন, হেনরিখ হেইন ইউনিভার্সিটি
মার্গুইলিসের মতামত তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হলেও তিনি সমান-তেজে সেগুলো প্রতিরোধ করেছেন। বেশ দ্রুতই তিনি উপযুক্ত প্রমাণের সমর্থন পেলেন। বংশগতির গবেষণায় দেখা গেল মাইটোকন্ড্রিয়ার ডি.এন.এ. মুক্ত-ব্যক্টেরিয়ার ডি.এন.এ.-র মতো একই রকমের। সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ কোষে অনুপ্রবিষ্ট হওয়া সমবায়ী যে প্রাচীন ব্যক্টেরিয়ারই উত্তরপুরুষ তা নিয়ে বর্তমানে খুব কম বিজ্ঞানীই সন্দেহ পোষণ করেন। তবে সেই আদিম-সংযোজনের সময়কাল, অংশগ্রহণকারীদের প্রকৃতি, আর সুকেন্দ্রিক-কোষের উদ্ভবে সংযোজনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে এখনো উত্তপ্ত বিতর্ক চলে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সুকেন্দ্রিক কোষের উদ্ভব নিয়ে নতুন নতুন তত্ত্ব পুরানোগুলো পরীক্ষিত হওয়ার চেয়ে দ্রুতগতিতে তৈরি হচ্ছে। বেশিরভাগ বয়ানকেই দুইটি শিবিরে ভাগ করা যায়।
প্রথম শিবিরকে বলা যায় “ক্রম-উদ্ভব” দল – যারা দাবী করেন যে প্রাককেন্দ্রীকরা ক্রমেই তাদের আকার বৃদ্ধি করেছে, নিউক্লিয়াস ও অন্যান্য কোষ গলাধঃকরণের মতো বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। এভাবেই প্রাক-সুকেন্দ্রিকরা মাইটোকন্ড্রিয়া অর্জন করেছে, কারণ তারা নিয়মিতই ব্যক্টেরিয়া গ্রাস করতো। এই কাহিনী ধীরগতির, চাঞ্চল্যহীন এবং ধরনের দিক দিয়ে ধ্রুপদী ডারউইনিয়। মাইটোকন্ড্রিয়া অর্জন হলো এই দীর্ঘ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কেবল একটি মাত্র ধাপ। মার্গুইলিস জীবনের শেষ পর্যন্ত এই কাহিনীতেই ধারণাটিই সমর্থন করতেন। অন্যপক্ষকে বলা যায় “হঠাৎ-উদ্ভব” শিবির। এটি পূর্বোক্ত মতামতকে নাকচ করে দিয়ে বলে যে নাটকীয়ভাবে দু’টি প্রাককেন্দ্রিক কোষের হঠাৎ-সংযোজনের মাধ্যমে সুকেন্দ্রিকরা উৎপন্ন হয়েছে। বহুকাল আগে একটি ব্যক্টেরিয়া ছিলো। আর ছিলো প্রাককেন্দ্রিকদের আরেক কুলীন বংশ: আর্কিয়া (আর্কিয়া নিয়ে বিস্তারিত থাকছে পরে)। এই দুই অণুজীব বাইরে থেকে দেখতে এক রকম হলেও প্রাণ-রসায়নের দিক দিয়ে একেবারেই ভিন্ন, যেমন উইন্ডোজ ও ম্যাক তাদের অপারেটিং সিস্টেমের দিক দিয়ে ভিন্ন। এরা সংযোজিত হওয়ার মাধ্যমে গড়ে তুললো সুকেন্দ্রিকদের প্রারম্ভ। বিল মার্টিন ও মিকলোস মুলার এই ভাবনার প্রথমিক রূপ এগিয়ে নিয়ে যান ১৯৯৮ সালে। তারা একে ডাকা শুরু করলেন হাইড্রোজনে অনুকল্প নামে। এ নামের কারণ হলো একটি প্রাচীন আর্কিয়া: যা তাদের অনেক উত্তরসূরীদের মতোই হাইড্রোজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত করে মিথেন বানানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি সংগ্রহ করে । সে আর্কিয়া উপজাত হিসেবে হাইড্রোজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করা একটি ব্যক্টেরিয়ার সাথে অংশীদারী শুরু করলো, যে উপজাত পূর্বোক্ত আকিয়া শক্তি তৈরির জন্য ব্যবহার করতে পারে। সময়ের সাথে সাথে তারা অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়লো আর। ঐ ব্যক্টেরিয়া পরিণত হলো মাইটোকন্ড্রিয়ায়।
এই অনুকল্পের অনেকগুলো ভিন্ন পাঠ আছে, যারা মিলনের কারণ ও ঐ মিলনে যে আর্কিয়া এবং ব্যক্টেরিয়া অংশ নিয়েছিলো তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে আলাদা যুক্তি প্রয়োগ করে। কিন্তু সকলেই ক্রম-উদ্ভব শিবির থেকে আলাদা একটি বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে একাট্টা বলে — সকলেই বলে যে পোষক কোষটি ছিলো অকৃত্রিম প্রাককেন্দ্রিক। তা ছিলো আগাগোড়া আর্কিয়া। এটা আকারে বড়ো ছিলো না। এর কোন নিউক্লিয়াসও ছিলো না। এটা সুকেন্দ্রিক হওয়ার রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছিলো না। তবে হঠাৎ করে একটি ব্যক্টেরিয়াকে নিজের সাথে যুক্ত করে আর্কিয়া বিবর্তনের নতুন পথে চলা শুরু করে। মার্টিন বলেন, “উদ্ভাবনগুলো পরে এসেছিলো।” (মানে সুকেন্দ্রিক কোষের বর্ধিত আকার কিংবা বড় জিনোমের মতো দারুণ সব বৈশিষ্ট্যগুলো পরে এসেছিলো — অনুবাদক)। এই পার্থক্য খুব গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে পারে না। হঠাৎ-উদ্ভব মত অনুযায়ী প্রথম দিকের সুকেন্দ্রিকদের ক্রমান্বয়ে অর্জিত অনেকগুলো অভিযোজনের মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়া একটি উদাহরণ নয়। লেন বলেন, “মাইটোকন্ড্রিয়া অর্জন করাই ছিলো সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব। দুইটি একই ঘটনা।” যদি তাই হয়, তাহলে সুকেন্দ্রিকদের অভ্যুত্থান বিবর্তনীয় রূপান্তরের ক্ষেত্রে চোখ, কিংবা সালোকসংশ্লেষণ কিংবা প্রাণীদের সাগর থেকে ভূমিতে ওঠার ধারাবাহিক পরিবর্তনের তুলনায় মূলগতভাবে একেবারেই ভিন্ন। বলতে গেলে একেবারেই অবিশ্বাস্য-অসম্ভব সাথে করে ঘটা আকস্মিক-অপ্রত্যাশিত ঘটনা, যা পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভবের ১০০ কোটি বছর কেটে যাওয়ার পর ঘটেছে মাত্র একবার, যার পরবর্তী ২০০ কোটি বছরে আর কোন পুনরাবৃত্তি ঘটে নি। লেন বলেন, “এটি দারুণ মজার ও উত্তেজক সম্ভাবনা। এটি হয়তো প্রকৃত ঘটনা নাও হতে পারে, কিন্তু খুবই সুন্দর।”
[এড ইয়ং এর Unique Merger প্রবন্ধের অনুবাদ। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে]
Leave a Reply