মানুষ সহ পৃথিবীর সকল উদ্ভিদ প্রাণীর জীবনের ভাষা কয়েকটা নির্দিষ্ট অক্ষরে লেখা। ডিএনএ-র A, G, C, T, U – এই পাঁচ অক্ষরের কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। এরা প্রত্যেকে এক একটি নিউক্লিওটাইড। কেউ কেউ পিউরিন বেস নিউক্লিওটাইড (A,G), কেউ কেউ পাইরিমিডিন বেস নিউক্লিওটাইড (C,T,U)। নিউক্লিওটাইড শব্দটা খুব কঠিন লাগলে সহজ কথায় এরা প্রত্যেকে একেকটি রাসায়নিক যৌগ। আর জীবনের জন্য একেকটি অক্ষর। প্রত্যেকেটা নিউক্লিওটাইডের গঠনও নির্দিষ্ট। ডিএনএ এর গঠন চার অক্ষরে লেখা- অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) এবং থায়ামিন (T) । অন্যদিকে আরএনএ এর গঠনও চারটা অক্ষরে লেখা, শুধু থায়ামিনের পরিবর্তে ইউরাসিল (U) উপস্থিত থাকে। পৃথিবীর তাবৎ জীবের মধ্যে, ভাইরাসের মধ্যে গরু খোঁজা করে আপনি এই কয়েকটা অক্ষরে লেখা ভাষাই খুঁজে পাচ্ছেন শুধু। হঠাৎ একদিন ঘটলো বিপত্তি।
কেউ যদি আপনার সামনে এসে এখন Apple বানান লিখতে গিয়ে লিখে Zpple , তো কেমন লাগবে? অদ্ভুতুড়ে, না? তেমনই কিছুর সম্মুখীন হন গবেষকরা ১৯৭৭ সালে। তারা একটি সায়ানোফাজ ভাইরাসের (অর্থাৎ যে ভাইরাস সায়ানোব্যক্টেরিয়াকে পোষক হিসেবে আক্রমণ করে) জিনোম বিশ্লেষণ করে দেখেন তাদের জিনোম সিকোয়েন্সে Apple এর জায়গায় Zpple লেখা। অর্থাৎ তাদের জিনোমে A এর পরিবর্তে Z উপস্থিত। এই দিন অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন এক ধরণের নিউক্লিওটাইডের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই Z নিউক্লিওটাইডের গঠন অ্যাডিনিন থেকে আলাদা। Z নিউক্লিওটাইডের নামকরণ করলে কিছুটা এমন: ২-অ্যামিনোঅ্যডিনিন। এটি একটি পিউরিন বেস নিউক্লিওটাইড।
জিনোম সিকোয়েন্সে এই নিউক্লিওটাইডের উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের কপালে ছোটোখাটো চিন্তার দাগ হয়ে ছিলো কয়েকদশক। এ নিয়ে গবেষণা আরও চলে। সম্প্রতি, উমম সম্প্রতি বলতে ২০২১ এরই এপ্রিল মাসের ত্রিশ তারিখে একটা খবর প্রকাশিত হয়। Z নিউক্লিওটাইড নিয়ে ফ্রান্স ও চীনের তিনটা পৃথক রিসার্চ টিমের গবেষণার ফলাফল জানানো হয়েছে বিশ্ববাসীকে। কী জানলাম এসব গবেষণা থেকে আমরা Z নিউক্লিওটাইডের ব্যাপারে?
১) PurZ এবং PurB নামক দুইটা প্রোটিন এই Z নিউক্লিওটাইড তৈরী করে।
২) আগেই বলেছি, প্রথম Z নিউক্লিওটাইড শনাক্ত করা হয়েছিলো সায়ানোফাজ ভাইরাসে। তো সায়ানোফাজ একধরনের ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাস। ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাস তারা যারা ব্যাক্টেরিয়ার শরীরে প্রবেশ করে, নিজের ডিএনএ কে ব্যাক্টেরিয়ার ডিএনএ-র সাহায্যে রেপ্লিকেট করে নিজের বংশবিস্তার করে। সায়ানোফাজ ভাইরাস এই কাজে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া পোষক হিসেবে ব্যবহার করে।
৩) তো ব্যাক্টেরিয়ার দেহে ভাইরাসের ডিএনএ-র যখন রেপ্লিকেশন অর্থাৎ অনুলিপিকরণ শুরু হয়, তখন ঐ PurZ এবং PurB প্রোটিন দুইটা প্রিকার্সার (বা প্রাথমিক) Z মলিকিউল সিন্থেসিস করে মানে তৈরী করে এবং এই অণুটাকেই Z নিউক্লিওটাইডে রূপান্তরিত করে। বেশ কয়েক ধাপে এই রূপান্তর ঘটে। এরপর অন্যান্য প্রোটিন এই নিউক্লিওটাইডকে আরও মডিফাই করে ভাইরাল ডিএনএ-র সাথে সংযুক্ত হওয়ার উপযোগী করে।
৪) DpoZ নামে এক প্রকার ডিএনএ-পলিমারেজ এনজাইম আছে। এটি রেপ্লিকেশনের সময় ঠিক নতুন ডিএনএ’র যেখানে যেখানে A নিউক্লিওটাইড হওয়ার কথা ঠিক সেখানে সেখানে Z নিউক্লিওটাইড বসায়ে দেয়।
৫) আগে মনে করা হতো জিনোমে Z নিউক্লিওটাইড খুবই দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু গত কয়েক দশকে মোটামুটি ২০০ টির বেশি ব্যাক্টেরিফাজ ভাইরাসে এই নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে।
৬) এই জিনোমের বেশ কিছু সুবিধা এবং সম্ভাবনার কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৮০ সালেই দেখা যায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রায় অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় Z নিউক্লিওটাইড আছে এমন ভাইরাস অধিক উপযোগী। ফলে ধারণা করা হচ্ছে বহু বছর আগে উত্তপ্ত গরম পৃথিবীতে ভাইরাসের টিকে থাকতে এই জিনোম কিছুটা সুবিধা দিয়েছিলো। ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাসের ডিএনএ যখন ব্যাক্টেরিয়ার দেহে প্রবেশ করে তখন কিছু প্রোটিন এটাকে ধ্বংসের চেষ্টা করে, ব্যাক্টেরিয়ার আত্মরক্ষার জন্য, সেই প্রোটিনগুলোকে Z নিউক্লিওটাইডবিশিষ্ট ভাইরাল ডিএনএ সহজে প্রতিরোধ করতে পারে। আবার এই নিউক্লিওটাইড ডিএনএ সূত্রকদ্বয়ের একটির সাথে আরেকটির সংযোগ নির্ভুল হতেও সহায়তা করে।
৭) Z নিউক্লিওটাইড সমৃদ্ধ ডিএনএ বেশি স্থিতিশীল হয় তার কারণ হাইড্রোজেন বন্ধন। সাধারণ ডিএনএ তে A ও T দুইটি হাইড্রোজেন বন্ধনী এবং G ও C তিনটি হাইড্রোজেন বন্ধনী দ্বারা সংযুক্ত থাকে। কিন্তু A এর জায়গায় Z নিউক্লিওটাইড থাকলে T এর সাথে তিনটা হাইড্রোজেন বন্ধনী দ্বারা এটি যুক্ত হয়। ফলে ডিএনএ বেশি স্থিতিস্থাপক হয়। এটা খুব উত্তপ্ত, প্রতিকূল পরিবেশে ডিএনএ কে টিকে থাকতে সুবিধা দিয়েছে।
৮) ভাইরাস ছাড়া তুলনামূলক উন্নত প্রজাতিতে এই নিউক্লিওটাইডের সহজে দেখা মিলছে না তার কারণ এটা বর্তমান পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এতটা উপযুক্ত না। ডিএনএকে প্রতিমুহূর্তে রেপ্লিকেশন, ট্রান্সক্রিপশন, ট্রান্সলেশনের মতো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যার জন্য আবার সাধারণ ডিএনএ (A অক্ষরের) বেশি উপযোগী। এজন্য প্রাণের শুরুতে Z নিউক্লিওটাইডের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও আজকের উন্নত প্রজাতিগুলোতে এই নিউক্লিওটাইড খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। তবে কিছু কিছু অবশিষ্ট অস্তিত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এবার আসি এই Z নিউক্লিওটাইডের বিবর্তনের ইতিহাসে। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় PurZ নামক প্রোটিনটির উৎপত্তি শতাব্দী প্রাচীন আর্কিয়াদের PurA প্রোটিন থেকে। PurZ এর বিবর্তনীয় ইতিহাস জানার পর প্রশ্ন উঠে-
Z নিউক্লিওটাইড তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন কী ব্যাক্টেরিয়ার দেহে উৎপন্ন হয়েছিলো যার ফলে পরবর্তীতে ভাইরাসে Z নিউক্লিওটাইডের সৃষ্টি হয় এবং এটা অভিযোজিত হয়ে টিকে যায়? নাকী শুরুর দিকের প্রাণগুলোতে এই ঘটনা অহরহ ছিলো?
দেখা গেছে PurZ প্রোটিন এবং DpoZ প্রোটিন প্রায়শঃই একইসাথে বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হচ্ছে। এর অর্থ Z জিনোমও খুব সম্ভবত সেই ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীর প্রাণের মাঝেও অস্তিত্বমান ছিলো। এর সাথে আরেকটা সম্ভাবনা উঠে আসে ১৯৬৯ সালে এন্টার্কটিকায় হওয়া উল্কাপাতের ঘটনা থেকে। ঐ উল্কাপাত থেকে Z নিউক্লিওটাইড সহ কিছু স্টান্ডার্ড, ননস্টান্ডার্ড নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে যা Z নিউক্লিওটাইডের পৃথিবীর বাইরে থেকে আসার একটা সম্ভাবনাও তুলে ধরে।
যাহোক, এত এত সম্ভাবনার গল্প এই গবেষণায় অংশ নেওয়া একজন বিজ্ঞানীর উক্তি তুলে ধরে শেষ করি।
“The phages Carrying this Z-genome could be considered as a different form of life”
Pierre Alexandre Kaminski
তথ্যসূত্র:
১. Some viruses have a mysterious ‘Z’ genome , লাইভসায়েন্স।
Leave a Reply