ক্যান্সার যেভাবে শরীরের ক্ষতি করে, এমন কোনো সমস্যা আছে, যা একইভাবে মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটায়? উত্তরে আমি ডিপ্রেশনের কথা বলব, যা ধীরে ধীরে জীবনকে গ্রাস করে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, কোনো কিছু নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করে মনোঃকষ্টে ভোগাকে আমরা ডিপ্রেশন বলে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সংজ্ঞানুসারে, Low Interest, Low Energy এবং Low Mood ডিপ্রেশনের তিনটি বড় প্রতীক। Medical News Today এর একটি প্রতিবেদন বলছে, ডিপ্রেশন এমন একটি মারাত্মক সমস্যা, যা ধীরে ধীরে জীবনের একটা বড় অংশ দখল করে ফেলে। মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেকের মতে, ডিপ্রেশন হলো নিজের, পারিপার্শ্বিকতা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার মিলিত বহিঃপ্রকাশ। এটি বিভিন্ন ধরণের মানসিক এবং শারীরিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়িতে আপনার কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। এটি ২ দিন থেকে শুরু করে ২ মাস বা বছর খানেক পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
বিষন্নতার ধরণ
ডিপ্রেশনের বৈশিষ্ট্য, ঝুঁকি এবং চিকিৎসার উপর ভিত্তি করে ডিপ্রেশনকে কয়েকটা ভাগে বিভক্ত করা হয়। তো, চলুন, সংক্ষেপে ডিপ্রেশনের ক্ল্যাসিফিকেশন দেখে আসি।
- মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার: এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ক্রমাগত দুঃখের সম্মুখীন হন। তারা যে ক্রিয়াকলাপগুলি উপভোগ করত তার প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে।
- পার্সিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার: Dysthymia নামে খ্যাত এধরণের ডিপ্রেশন যেই প্রভাবগুলো ফেলে, তা দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এমন মানুষদের জীবনে ডিপ্রেশন কখনো এপিসোড আকারে আসতে পারে।
- পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন: জন্ম দেওয়ার পরে, অনেক মহিলার ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা হয়, যাকে কিছু মানুষ “বেবি ব্লুজ” বলে। সন্তান জন্মের পর যখন হরমোনের মাত্রা পুনরায় ঠিকঠাক হতে থাকে, তখন ডিপ্রেশন কাউকে ঘিরে ধরতে পারে। এধরণের সমস্যার কোনো একক কারণ নেই। এটি কয়েক মাস বা বছর খানেক পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
- সিজনাল ডিপ্রেশন: আগে এধরণের ডিপ্রেশনকে SAD বা Seasonal Affective Disorder বলা হতো। শীতকালে দিনের আলো হ্রাসের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র শীতকালীন দেশে বসবাসকারী লোকেরা এই অবস্থার দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকেন।
ডিপ্রেশনের কারণ
ডিপ্রেশন যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, আমরা কেন ডিপ্রেসড হই? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা ৪টি ফ্যাক্টরকে চিহ্নিত করতে পারিঃ
- বায়োকেমিকেল ফ্যাক্টর: মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের পার্থক্য ডিপ্রেশনের জন্য দায়ী। যেমন; সেরোটনিন, ডোপামিন, নরইপিনেফ্রিন, গাবা ইত্যাদি ইত্যাদি হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে সেরোটনিনের নিঃসরণ কমে যাওয়া। একারণেই বলা হয়, “Serotonin is happiness.”
- জেনেটিক্যাল ফ্যাক্টর: ডিপ্রেশন তৈরিতে বংশগতির একটা বড়-সড় প্রভাব রয়েছে। যেমন; যদি দু’টি অভিন্ন যমজ সন্তানের যেকোনো একজন ডিপ্রেশনের কবলে পড়ে, তবে অপরজনের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে গিয়ে ডিপ্রেসড হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৭০%। যদি কারও ফার্স্ট ডিগ্রী রিলেটিভদের মধ্যে ডিপ্রেসড রোগী থাকে, তবে ঐ ব্যক্তির ডিপ্রেসনে ভোগার সম্ভাবনা প্রায় ২০-৩০%।
- পার্সোনালিটি ফ্যাক্টর: কম আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ, যারা সহজেই মানসিক চাপে পড়ে, তাদের ডিপ্রেসড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই সাইক্রিয়াটিকরা সবসময় আপনাকে আত্মবিশ্বাসী এবং পজিটিভ-মাইন্ডেড হতে বলেন।
- পরিবেশগত ফ্যাক্টর: সহিংসতা, অবহেলা, অপব্যবহার দুর্যোগ বা দারিদ্র্যের ক্রমাগত এক্সপোজার কিছু কিছু মানুষকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয় এবং একটা সময়ে গিয়ে ঐ মানিষটা ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে।এধরণের মানুষেরা খুব দ্রুত মারাত্মক স্টেপে পৌঁছে যায়।
ডিপ্রেশনের লক্ষণ
American Psychiatric Association ডিপ্রেশনের লক্ষণ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে ১০টি মারাত্মক লক্ষণ চিহ্নিত বিষয় হলোঃ
- বেশি দুঃখবোধ করা কিংবা মেজাজ ঘন ঘন পরিবর্তিত হওয়া
- স্বাভাবিক কাজগুলো করতে গিয়ে মানসিক চাপের সম্মুখীন হওয়া
- কাজ করার শক্তি কমে যাওয়া কিন্তু ক্লান্তি বৃ্দ্ধি পাওয়া
- অন্যরা যেগুলো স্বাভাবিকভাবে উপভোগ করছে, সেগুলোতে আগ্রহ হারানো
- ঘুমে সমস্যা হওয়া: কম ঘুমানো অথবা বেশি ঘুমানো
- নিজেকে মূল্যহীন মনে হওয়া বা অপরাধী মনে করা
- যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ফলাফলের ভয়ে প্রচুর বিড়ম্বনার শিকার হওয়া
- বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপে পরিবর্তন আসা। যেমনঃ স্থির হয়ে বসতে না পারা, ধীর গতিতে চলাচল করা বা কথা বলা, হাত মুঠো করে থাকা, চলতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি
- গুরত্বপূর্ণ কাজগুলোতে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হওয়া
- ক্ষুধায় লক্ষণীয় পরিবর্তন আসা
তবে Medical News Today আরো ৩টি বিষয়ে উল্লেখ করেছেঃ
- আত্মহত্যা করার প্রবণতা, এটি ডিপ্রেশনের মারাত্মক স্টেপে গিয়ে প্রকাশিত হয়
- পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলা
- যৌন আকাঙ্খা হ্রাস পাওয়া
ডিপ্রেশনের প্রভাব
- ডিপ্রেসড রোগীর অবস্থা যত খারাপ হতে থাকে, ততই তার কাছে নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে ব্যর্থতা আর হতাশা নিজেকে পুরোপুরি ঘিরে ধরে
- বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যেমনঃ ওজন হ্রাস বা অস্বাভাবিক হারে বৃ্দ্ধি পাওয়া, যৌনশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি
- ডিপ্রেশনের প্রভাবে হার্ট দুর্বল হতে থাকে এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়
- চিন্তা-ভাবনায় অস্পষ্টতা দেখা যায় এবং রোগী এক ধরণের চাপা কষ্টে ভুগতে থাকে
- অত্যাধিক ডিপ্রেশনে ভুগে যারা আর নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, তারা ঝুঁকিপূর্ণ ও অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। যেমনঃ মাদক গ্রহণ, জুয়া খেলা কিংবা আত্মহত্যা করা
বিষন্নতা কি মানসিক রোগ?
বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের একটি প্রবন্ধে ড. তনয় লিখেছেন, “মানসিক রোগ মানেই ডিপ্রেশন নয়।” অনেক সময় আমরা মানসিক অবস্থার অবনতিকে ডিপ্রেশনের কারণ বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। কিন্তু, বাস্তবে সবসময় এমনটা নাও হতে পারে। যেমনঃ স্কিজোফ্রেনিয়া হলে Aolition দেখা দেয় অর্থাৎ যেকোনো কাজে মনোনিবেশ করার আগেই ইচ্ছা হারিয়ে ফেলা। আবার, insomnia হলে স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আপনি যদি খেলাল করে দেখেন, তবে বুঝতে পারবেন যে ডিপ্রেশনের প্রভাবেও এমন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। তাই যে কেউ মানসিক রোগকে বুঝতে না পেরে একে ডিপ্রেশন বলে ফেলে। এর ফল হয় মারাত্মক। অনেকাংশে সমস্যাটির সঠিক সমাধান করা সম্ভবপর হয় না এবং প্রকৃত চিকিৎসার অভাবে ঐ রোগী ভয়ঙ্কর মানসিক রোগকে নিয়েই জীবনযাপন করতে থাকে। ফলে একটা সময়ে গিয়ে তাকে শোচনীয় পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়।
বিষন্নতা নিয়ে কয়েকটি জরিপ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে সারা বিশ্বে প্রায় ২৬৪ মিলিয়ন মানুষ ডিপ্রেশনের শিকার। তারা আরও আশঙ্কা করছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। American Psychological Association এর প্রতিবেদন অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯% পুরুষ ডিপ্রেসড অবস্থায় জীবন কাটায়। ঢাকায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে শিশু-কিশোরদের ১৮% এর বেশি ডিপ্রেশনে ভুগছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি পরীক্ষণে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের যত মানুষ আত্নহত্যা করে, তাদের মধ্যে অর্ধেকই ২৫-৩০ বছর বয়সী, যারা ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। প্রায় ১.৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের প্রায় ১০% ছাত্র-ছাত্রী ভবিষ্যৎ নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছে। CDC বলছে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩.২% শিশুর মধ্যে ডিপ্রেশন কাজ করে বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এতোসব ভয়ঙ্কর জরিপের পরে কি আমাদেরকে ডিপ্রেশনকে অবহেলা করা উচিৎ?
ডিপ্রেশনের প্রতিকার ও চিকিৎসা
দীর্ঘমেয়াদী ডিপ্রেশন বেশিরভাগ সময়েই মারাত্মক পরিস্থিতি ডেকে আনে। তাই সঠিক চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় ৮০-৯০% রোগীই সুচিকিৎসার ফলে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসার প্রথম শর্ত হলো পর্যবেক্ষণ। একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের উচিৎ, ডিপ্রেসড রোগীকে ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করা। এরপর প্রয়োজনীয় থেরাপি বা পদক্ষেপ অবলম্বন করা। যেমনঃ মাইল্ড ডিপ্রেশনে ঔষধের প্রয়োজন হয় না, সাইকোথেরাপিই যথেষ্ঠ। অনেক সময় ঔষধের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ঔষধ মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু চিকিৎসাপদ্ধতি তখন পুরোপুরি বদলে যায়, যখন ডিপ্রেশন মারাত্মক স্টেপে চলে যায়। ঐসময়ে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট প্রয়োগ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এন্টিডিপ্রেসেন্ট ১-২ সপ্তাহের মধ্যে রোগীর অবস্থাকে ইম্প্রুভ করতে পারে। কিন্তু, ২-৩ মাসের মধ্যে এর পুরো ফলাফল নাও পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও আরো এক প্রকার থেরাপি রয়েছে, যেটা মূলত গুরুতর ডিপ্রেসড রোগীদের ক্ষেত্রে জরুরি। একে আমরা ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ECT) বলে থাকি। যাদের ক্ষেত্রে ঔষধ কিংবা সাইকোথেরাপি কোনো কাজে দিইনি, তাদের জন্য এটাই চূড়ান্ত থেরাপি। ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি মারাত্মক মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োগকৃত থেরাপি। ECT মস্তিষ্কে একটি সংক্ষিপ্ত বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা যোগ করে, যখন রোগী অ্যানেস্থেসিয়াতে থাকে। এটি সাধারণত প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের একটি দল দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখানে একজন সাইকিয়াট্রিক, একজন অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট এবং একজন নার্স বা সহকারী চিকিৎসক থাকে।
ডিপ্রেশন প্রতিকারের জন্য চিকিৎসার পাশাপাশি মনোবলও অত্যন্ত জরুরি। কারণ, মানসিক শক্তি যেকোনো মানসিক সমস্যাকে দূরীভূত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাই নিজেকে শক্ত করতে হবে এবং জীবনের প্রতিটি অংশের গুরুত্ব অনুধাবন করে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
উপসংহার
ডিপ্রেশন একটি মারাত্মক বিষয় হওয়ায় এটাকে অবহেলা করা উচিৎ নয়। আপন মানুষজনদের সাথে এই সমস্যার কথা শেয়ার করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটাই বিচক্ষণতার পরিচয়। দেখুন, নিকোটিন কিংবা আত্মহত্যা কখনোই ডিপ্রেশনের সমাধান হতে পারে না। রবার্ট হেনলেন বলেছেন, “আত্ম-সমালোচনার সবচেয়ে বাজে উপায় হলো আত্মহত্যা।” ফিল ডোনাহিউ একবার বলেছিলেন, “আত্মহত্যা একটি সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান।” আপনাকে মনে রাখতে হবে যে ডিপ্রেশন একটি রোগ, যা সুচিকিৎসা ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে দূরীভূত হতে পারে। তাই সবসময় বাস্তবমুখী চিন্তা-ভাবনা করুন এবং নিজের উপর আস্থা রাখুন। মন ভালো তো, শরীর ভালো!
Leave a Reply