[একমেবাদ্বিতীয়ম্ সংযোজন – ৩য়+৪র্থ কিস্তি]
বিভিন্ন জীবের জিন সিকোয়েন্স করে (ডি.এন.এ. নিউক্লিওসাইড ক্ষার অণু দিয়ে পর পর কি লেখা আছে তার পাঠোদ্ধার করে) তাদের পারস্পারিক তুলনা করার ভাবনা ১৯৭৭ সালে অণুজীববিজ্ঞানী কার্ল উজের মাথায় আসে। এখন আধুনিক জীববিজ্ঞানে এটা নিত্যদিনের কাজ, তবে সেই সময় বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রজাতির মাঝে বিবর্তনীয় সম্পর্ক আন্দাজ করার জন্য বাহ্যিক-দৈহিক বৈশিষ্ট্যের উপরেই ভরসা করতেন। ওই সময়ে বিভিন্ন জিনের তুলনা করা ছিলো নতুন ধরনের দুঃসাহসিক কাজ। এ তুলনা সুকেন্দ্রিক-কোষীদের মতো জটিল প্রাণ কিভাবে এলো তা বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ধারাবাহিকের সূচী: ধারাবাহিকের সূচী: কিস্তি ১. প্রাণের প্রথম একশ কোটি বছর কেন একঘেয়ে ছিলো? কিস্তি ২. সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব কেন অসম্ভব-সম্ভাবনা ছিলো? কিস্তি ৩. প্রাককেন্দ্রিক জিনেরা সুকেন্দ্রিক জিনোমে কিভাবে কর্মবিভাজন করলো? কিস্তি ৪. মাইটোকন্ড্রিয়াহীন সুকেন্দ্রিকদের হুমকি সামলানো গেলো কিভাবে? কিস্তি ৫. কোষের শক্তি কোথেকে আসে? কিস্তি ৬. কেন সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব গবেষণায় অনিশ্চয়তা নিশ্চিত?
কার্ল উজ তাঁর গবেষণার মনোযোগ নিবন্ধ করলেন 16s রাইবোজোমাল আর.এন.এ. জিন লক্ষ্য করে। এটি এমন একটি জিন যা বিভিন্ন প্রোটিন নির্মাণে মৌলিক ভূমিকা রাখে আর একে সকল জীবের মধ্যেই পাওয়া যায়। উজ যুক্তি দিলেন বিভিন্ন জীব নতুন নতুন প্রজাতিতে ভাগ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের রাইবোজোমাল আর.এন.এ. জিন সিকোয়েন্সের সংস্করণও ক্রমশঃ বিসদৃশ হয়ে যেতে থাকবে। সুতরাং বিভিন্ন প্রাককেন্দ্রীক ও সুকেন্দ্রীক কোষী জীবের 16s রাইবোজোমাল আর.এন.এ. সিকোয়েন্স তুলনা করলে জীবনবৃক্ষের ডালপালার অন্তর্নিহিত সজ্জা-বিন্যাসও প্রকাশিত হবে। জীবন-বৃক্ষের বহুল আকাঙ্ক্ষিত সজ্জা উন্মোচিত হয়েছিলো — কিন্তু সে সজ্জার নকশা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করে নি।
উজের জীবন-বৃক্ষে ব্যক্টেরিয়া আর সুকেন্দ্রীকরা ডালপালার আলাদা গুচ্ছে বিভক্ত দেখায়। কিন্তু অন্য কিছু প্রাককেন্দ্রিক-কোষীর তৃতীয় একটি অভাবনীয় গুচ্ছ দেখা যায় উজের জীবন-বৃক্ষে, যাদের খুব উষ্ণ তাপমাত্রার প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বিজ্ঞানীরা সংগ্রহ করেছিলেন। সকলেই ভাবতেন, এরা হয়তো কোন অভূতপূর্ব-ধরনের ব্যক্টেরিয়া। কিন্তু কার্ল উজের জীবন-বৃক্ষ এদেরকে প্রাণের তৃতীয় অঞ্চল বলে ঘোষণা করলো। ঘটনাটা তুলনা করা যায় একটা ম্যাপের সাথে: সকলেই পৃথিবীর ম্যাপের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, হঠাৎ কার্ল উজ এসে সবিনয়ে ম্যাপ উল্টিয়ে দেখালেন এর ভাঁজে আরো এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল লুকিয়ে ছিলো! কার্ল উজের ঐতিহাসিক তিন-অঞ্চল জীবন-বৃক্ষে সুকেন্দ্রিক ও আর্কিয়ারা পাশাপাশি অবস্থান করে তারা সহোদর দল। উভয় দল একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে, যে সাধারণ পূর্বপুরুষ পৃথিবীর ইতিহাসের একেবারে প্রথমে ব্যক্টেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে যখন আধুনিক বংশগতিবিদ্যা পূর্ণ গতিতে ছোটা শুরু করলো, বিজ্ঞানীরা সুকেন্দ্রিক-কোষী জীবদের বিভিন্ন জিন সিকোয়েন্সিং করা শুরু করলেন, তখন জীবন-বৃক্ষের এই পরিপাটি চিত্র আরো পাক-খেয়ে যেতে লাগলো।
কিছু কিছু সুকেন্দ্রিক জিন দেখা গেলো অনুরূপ প্রাককেন্দ্রিক জিনের সাথে নিকট আত্মীয়তায় সম্পর্কিত; কিন্তু অন্য জিন দেখা গেল ব্যক্টেরিয়ার অনুরূপ জিনের সাথে বেশি মিলে যায়। কেন্দ্রীক কোষীদের দলটা হয়ে পড়লো একটা বিভ্রান্তিকর জগাখিচুড়ী, আর প্রতিটি নতুন জিন সিকোয়েন্সের সাথে সাথে অন্য দুই দলের সাথে তাদের বিবর্তনীয় সম্পর্কটা দোল খাওয়া আরম্ভ করলো। ২০০৪ সালে জেমস লেক এই গবেষণা-যজ্ঞের নিয়মে কিছু পরিবর্তন আনলেন। কেবল একটি জিন না দেখে সহকর্মী মারিয়া রিভেরার সাথে দুইটি সুকেন্দ্রীক, তিনটি ব্যক্টেরিয়া ও তিনটি আর্কিয়ার পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স তুলনা করলেন। তাদের বিশ্লেষণ দুই ধরনের ভিন্ন কোষের সংযোজন ঘটার ধারণাকেই সমর্থন করলো: তারা সিদ্ধান্ত দিলেন যে পৃথিবীর সকল জীবের সাধারণ পূর্বপুরুষ প্রথমে ব্যক্টেরিয়া ও আর্কিয়াতে ভাগ হয়ে যায়, যারা স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হওয়া শুরু করে, আর পরবর্তীতে এ দুই দলের দুই সদস্য হঠাৎ করে পরস্পর সংযোজিত হয়। এর ফলে তৈরি হয় প্রথম সুকেন্দ্রিক-কোষী। এ ঘটনার ফলে আমরা জীবন-বৃক্ষের জায়গায় পেলাম জীবন-বলয়। এর আগে জীবনের মাত্র দুইটি অঞ্চল ছিলো। আর পরে জীবনের অঞ্চল বেড়ে দাঁড়ালো তিনটি।
কেবলমাত্র সাতটি প্রজাতি নিয়ে কাজ করার জন্য রিভেরা ও লেককে পরবর্তীতে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়। তবে কেউই সম্ভবত বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী জেমস ম্যাকাইরেনির বিরুদ্ধে এরকম সমালোচনা করার সাহস পাবেন না। ২০০৭ সালে তিনি ১৬৮ প্রাককেন্দ্রিক ও ১৭ সুকেন্দ্রিক কোষী জীবের ৫,৭০০টি জিন নিয়ে একটা বিশাল জীবন-বৃক্ষ তৈরি করেন। তিনিও একই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন; সুকেন্দ্রিক-কোষীরা মিশ্র জীব; তারা গঠিত হয়েছে কোন ব্যক্টেরিয়া ও আর্কিয়ার সমবায়ী মিথজীবিতার প্রাচীন সম্পর্কের মাধ্যমে। এ দুই অংশীদারের জিনগুলি যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এমন নয়। তাদের আচরণ অনেকটা নিউ ইয়র্ক শহরে আগত এশিয়ান ও ল্যাটিনো জাতির অভিবাসীদের মতো যারা একই শহরে থাকলেও আলাদা পাড়ায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বিষয়টা হলো, বেশিরভাগ সময়েই তারা স্বজাতিভূক্ত জিনের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে: আর্কিয়া হতে আসা জিন অন্যান্য আর্কিয়া-জিনের সাথে, আর ব্যক্টেরিয়া থেকে আসা জিন ব্যক্টেরিয়া-জিনের সাথে।
ম্যাকইনারনি বলেন,
“খেলার মাঠে আপনার দুই দল আছে, দলগুলো একে অন্যের সাথে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে খেলছে, কারণটা হলো আসলে তারা একে অন্যের সাথে ভিন্ন ভিন্ন সময় কাটিয়েছে।”
এ দুই উৎসের জিন ভিন্ন ধরনের কাজ করে। আর্কিয়া হতে আসা জিন সাধারণত ডিএনএ অনুলিপি করা সহ ডিএনএ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। ব্যক্টেরিয়া হতে আসা জিনেরা খাদ্য ভেঙে পুষ্টি সংগ্রহ সহ অণুজীবের অন্যান্য নিত্যদিনের দিকগুলোর সাথে বেশি জড়িত। যদিও ব্যক্টেরিয়া হতে আসা জিনের সংখ্যা আর্কিয়া-উৎস এমন জিনের চাইতে প্রায় চারগুণ হলেও আর্কিয়া-উৎসের জিনগুলোকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কারণ এরা ব্যক্টেরিয়া হতে আসা জিনের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ সক্রিয়। তারা এমনসব প্রোটিন তৈরি করে যা সংশ্লিষ্ট কোষে তুলনামূলক কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যদি এই জিনদের ভুল করে কেটে বাদ দেয়া হয় জিনোম থেকে তাহলে পোষক কোষ সাধারণত ধ্বংস হয়ে যায়। গত চার বছর ধরে ম্যাকইনারনি বার বার একই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন, ইস্ট, মানুষ সহ অন্য ডজনখানেক সুকেন্দ্রিক কোষী জীবের ক্ষেত্রে।
“হঠাৎ-উদ্ভব” অনুকল্প আমলে নিলে কোন কিছুই খাপছাড়া মনে হয় না। যখন সেই প্রাচীন অংশীদাররা মিশে গেল, তখন অভিবাসী ব্যক্টেরিয়ার জিনগুলোকে স্থানীয় আর্কিয়-জিনের যৌথ যোগাযোগের মাঝে একীভূত হতেই হবে, যে জিনগুলি। ইতিমধ্যে অগণিত প্রজন্ম ধরে একসাথে বিবর্তিত হচ্ছিলো। দুই দল জিন একীভুত হয়েছিলো, আর যদিও অনেকগুলো আর্কিয়া-জিন স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তবে কিছু অভিজাত জিন বেদখল করা যায় নি। বরং দুইশ কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হওয়ার পরেও এই যৌথ যোগাযোগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়ে গেছে; সংখ্যায় কম হলেও এরা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
মাইটোকন্ড্রিয়াহীন সুকেন্দ্রিকদের হুমকি সামলানো গেলো কিভাবে?
হঠাৎ-উদ্ভব অনুকল্পের একটি মৌলিক দাবী হলো সকল সুকেন্দ্রীক কোষে অবশ্যই মাইটোকন্ড্রিয়া থাকবে। কোন ব্যত্যয় ঘটলে এই অনুকল্পের জন্য সেটি হবে মারাত্মক। আর ১৯৮০-র দশকে এরকম ব্যতিক্রম অঢেল সংখ্যক দেখা গেল।
আপনি যদি পৃথিবীর ভুল জায়গায় গিয়ে ভুল গ্লাসে পানি খান তাহলে আপনার অন্ত্রে জিয়ারডিয়া (Giardia) পরজীবি বাসা বানিয়ে ফেলতে পারে। ফলে এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার পেটে বিষম খিচুনী ধরতে পারে আর হতে পারে তীব্র উদরাময় (ডাইরিয়া)। রোগ সৃষ্টির বাইরেও জিয়ারডিয়ার খুব কিম্ভুতকিমাকার শারীরসংস্থান রয়েছে। জিয়ারডিয়ার আকৃতি অশ্রুবিন্দুর মতো, এর চারটি লেজের মতো ফিলামেন্ট আছে, আর এর নিউক্লিয়াসের সংখ্যা দুইটি। এটা পরিস্থার যে জিয়ারডিয়া একটি সুকেন্দ্রিক কোষ।
কিন্তু এর কোন মাইটোকন্ড্রিয়া নেই।
আরও অন্তত হাজারখানেক সুকেন্দ্রিক কোষ রয়েছে যাদের কোন মাইটোকন্ড্রিয়া নেই। একসময় তাদেরকে ডাকা হতো আর্কিজোয়ানস নামে। তাদের নিরুদ্দেশ পাওয়ার-হাউজ হয়ে পড়ে সুকেন্দ্রিক-কোষ-উৎপত্তি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এদের দেখে মনে হতে লাগলো এরা প্রাককেন্দ্রিক থেকে আদিম সুকেন্দ্রিক হতে যাওয়া একটি সময়ের জীবন্ত পর্যায়। এরা সেই সময়ের নিদর্শন যখন আদিম সুকেন্দ্রিক কোষ মাইটোকন্ড্রিয়া অর্জন করে নি। এই অবশিষ্টাংশদের উপস্থিতি সাক্ষ্য দেয় যে মাইটোকন্ড্রিয়া সুকেন্দ্রিক কোষ উদ্ভবের পরের অর্জন। ফলাফল – ‘হঠাৎ-উদ্ভব’ অনুকল্পের “গল্প” গলাধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার হুমকি।
এ ধাক্কা সামলানো গেল ১৯৯০-র দশকে, যখন বিজ্ঞানীরা ক্রমেই বুঝতে পারলেন যে জিয়ারডিয়ার মতো বিদঘুটে সুকেন্দ্রীকদের এমন সব জিন আছে যাদের সচরাচর মাইটোকন্ড্রিয়াতেই খুঁজে পাওয়া যায়। তার মানে এসব আর্কিজোয়ানের একসময় অবশ্যই মাইটোকন্ড্রিয়া ছিলো যারা পরবর্তীতে হারিয়ে গেছে কিংবা অন্যান্য কোষীয় প্রকোষ্ঠে পরিণত হয়েছে। এরা সুকেন্দ্রীক কোষের আদিপর্যায় নয় যারা এখনো মাইটোকন্ড্রিয়া অর্জন করে নি, বরং আপাত-অবক্ষয়ের ফলে মাইটোকন্ড্রিয়া হারিয়ে ফেলা অত্যাধুনিক-সুকেন্দ্রীক কোষ — অনেকটা ফিতাকৃতি ও অন্যান্য পরজীবির মতো যারা প্রায়ই বিভিন্ন জটিল অঙ্গানু হারিয়ে ফেলে, পরজীবি-জীবনে অভ্যস্থ হওয়ার পর ঐসব অঙ্গানুর আর কোন প্রয়োজন নেই বলে। এই ধাক্কা-সামলানো নিয়ে ম্যাকইনারনি বলেন, “মাইটোকন্ড্রিয়া-বিহীন কোন আদিম-সুকেন্দ্রীক কোষ খুঁজে পাওয়া এখনো বাকি আছে; আর আমরা ইতিমধ্যে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ফেলেছি।” আর্কিজোয়ানের রহস্য উন্মোচনের পর নতুন প্রাণশক্তিতে ‘হঠাৎ-উদ্ভব’ অনুকল্প পুনরায় তার অবস্থানে ফিরে এলো। মার্টিন বলেন,
“আমরা বলেছিলাম সকল সুকেন্দ্রীক কোষেরই মাইটোকন্ড্রিয়া থাকবে। তখন সবাই এজন্যে হাসাহাসি করেছিলো, কিন্তু এখন এটা পাঠ্যপুস্তকের অংশ। সুতরাং আমি বিজয় ঘোষণা করছি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক ছাড়া আর কেউই তা দিচ্ছে না আমাকে।”
[এড ইয়ং এর Unique Merger প্রবন্ধের অনুবাদ। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে]
Leave a Reply