এই মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া রয়েছে আরও অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কা, গ্রহাণু । তাদের কতগুলো সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি? এই বিশাল মহাজাগতিক রাজ্যে আমরা শুধুমাত্র একটি বালির দানার মত, যেখানে সমস্ত মরুভূমি এখনও আমাদের অজানা। জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫০০ টি উল্কা, এছাড়া প্রায় ৫,২৫,০০০ টি এস্টেরয়েড শনাক্ত করতে পেরেছেন।
কিন্তু ওউমুয়ামুয়া এদিক দিয়ে একেবারেই স্বতন্ত্র একটি অস্তিত্ব । লম্বাকৃতির এই মহাজাগতিক বস্তুটি হঠাৎ করেই ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত হয়, যখন এটি প্রচন্ড বেগে সূর্যকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিল। বৃহদাকৃতি এই বস্তুর গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে অনেক বিজ্ঞানীই বলেছেন, এটি আমাদের এই সৌরজগতের নয়। খুব সম্ভবত পার্শ্ববর্তী কোন নক্ষত্রমন্ডলী থেকে হঠাৎ করেই এটি আর্বিভূত হয়েছে। একে কোন উল্কা বা এস্টেরয়েড বলা যায় না, বরং কিছু কিছু জ্যোর্তিবিজ্ঞানী তো এটা বলে বসেছেন যে এটি কোন এলিয়েন মহাকাশযানও হতে পারে!
রবার্ট ওয়েরেক, ইউনির্ভাসিটি অব হাউয়াই এর জ্যোর্তিবিদ্যা বিভাগের গবেষক, অনেকটা আকষ্মিকভাবেই একদিন এটি আবিষ্কার করেন। ১৯ অক্টোবর ২০১৭ মাউই তে অবস্থিত প্যান স্টারস টেলিষ্কোপ ব্যবহার করে পৃথিবীর দিকে আগত অ্যাস্টেরয়েড গুলো পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎই তিনি নতুন একটি অ্যাষ্টেরয়েড আবিষ্কার করেন। কিন্তু সহসাই তার ভুল ভাঙ্গে। কারণ এই নতুন বস্তুটির কক্ষপথ সম্পূর্ন আলাদা, যেটি ৭.৮ ঘন্টায় একবার নিজ কক্ষপথ ঘুরে আসে। পরবর্তীতে আরও কিছুটা গবেষণা করবার পর ওয়েরেক এবং তার সহকর্মী মারকো মিচেলি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এই বস্তুটি আমাদের সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছে।
জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরে এমন ধরনের কিছুর খোঁজ করে এসেছেন। কারেন মেস যিনি এই ইন্সটিটিউটের একজন প্রতিথযশা জ্যোর্তিবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, “সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার এটাই যে আমরা এর আগে কখনও এমন ইন্টারস্টেলার কোন কিছুকে দেখিনি।”
এই মহাজাগতিক বস্তুটিকে ক্যাটাগরী করা হয় ১আই/২০১৭ ইউ১, যেখানে ১ মানে প্রথম আর আই মানে ইন্টারস্টেলার। পরবর্তীতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু এটি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে, তাই এর নামটি হাউয়াইয়ান হোক। প্রস্তাব করা হয় বস্তুটির নাম হোক ওউমুয়ামুয়া, নামাটির অর্থ “দূরবর্তী গ্রহের পথ প্রর্দশক”। নামটির উচ্চারণ অনেকটা এরকম, ওহ্ মোহা মোহা!
ওউমুয়ামুয়া দেখতে কেমন ছিল? আসলে যখন এটির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়, তখন পৃথিবীর অনেক দূর হতে এটি পৃথিবীকে অতিক্রম করছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়েও একে ছোট একটি বিন্দু ছাড়া আর কিছুর মনে হয়নি। অনেক বিজ্ঞানী বলেন আপনি যদি একটি সিগারকে মহাকাশে উড়তে দেখার ব্যাপারটা কল্পনা করে নিতে পারেন, ওউমুয়ামুয়া সম্পর্কে আপনি তাহলে সত্যিকারের একটি চিত্র পেয়ে যাবেন।
শক্তিশালী টেলিস্কোপ থেকে অন্তত এটা আন্দাজ করা গেছে, এটি তার প্রশস্ততার চেয়ে প্রায় ৭ গুণ লম্বা। খুব বেশি বড় হবেনা, এই ধরুন ৩০০০ ফুট লম্বা আর ৪০০ ফুট চওড়া।
ওউমুয়ামুয়া আসলে কি দিয়ে তৈরি, বিজ্ঞানারা এখন পর্যন্ত কোন সমাধানে আসতে পারেননি। কিছু তথ্য প্রমাণ এমনটাই বলে, এর ভূমিরুপ কিছুটা লালচে। লালচে রং এর হওয়ায় অনেকে ধূমকেতুর সাথে এর মিল খুঁজে পান, যা পাথর ও বরফ দিয়ে তৈরি। তবে এর কিন্তু ধূমকেতুর মত কোন লেজ নেই।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ওউমুয়ামুয়া লাইরা নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এসেছে এবং এর গতিপথ ছিল পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জ এর দিকে। তবে এর পথ এবং গতি কোনোটাই নিকটবর্তী কোন তারার সাথে মেলে না।
একদল জ্যোর্তিবিজ্ঞানী মনে করেন আজ থেকে এক মিলিয়ন বছর আগে ওউমুয়ামুয়া এইচআইপি৩৭৫৭ নামের একটি ছোট লাল তারার কাছাকাছি ছিল। হতে পারে সেখান থেকেই হয়ত এর উৎপত্তি হয়েছে।
সম্প্রতি হার্ভাডের জ্যোর্তিবিজ্ঞানী অ্যাভি লোয়েব একটি বির্তকিত ধারণা প্রকাশ করেন একটি সায়েন্টিফিক পেপারে। তার মতে ওউমুয়ামুয়ার অস্বাভাবিক আকৃতি এবং এর বিস্ময়কর গতি থেকে আর দশটি মহাজাগতিক বস্তু থেকে আলাদা করেছে। এমনকি হতে পারে না, এটা একটি লাইট সেইল, একটি এলিয়েন স্পেসক্রাফট যা সূর্যের আলোতে চলে ! তিনি অবশ্য এটা দাবী করেননি, শুধুমাত্র সম্ভবনার কথা বলেছেন।
যদিও ওউমুয়ামুয়া এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত এধরনের প্রথম অদ্ভুত মহাজাগতিক বস্তু, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ভাল করে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজলে মহাকাশে ট্রিলিয়নের মত এমন বস্তুর সন্ধান পাওয়া সম্ভব। তারা মনে করেন, এই ধরণের বস্তু প্রতিনিয়তই পৃথিবীর নিকট দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু দ্রুতগতি এবং অস্পষ্টতার কারণে আমরা সেগুলোকে বুঝতে পারি না। অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণার মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারবেন ওউমুয়ামুয়া আসলে কি ছিল। এমন কি হতে পারে না, সে ছিল আসলে কোন এলিয়েন স্পেসক্রাফট?
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply