বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ঘটনার প্রচুর চিহ্ন থেকে যায়। আমাদের শরীরে এখনও প্রচুর চিহ্ন, উচ্ছিষ্ট রয়ে গেছে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের। এমন leftover যেমন রয়ে গিয়েছে আমাদের কোষের অভ্যন্তরের আণুবীক্ষণিক জগত জিনে, তেমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের সারা শরীরেও। আমাদের আজকের গল্পটা তেমনি এক লেফটওভারের। আজকের গল্পটা জীবের এলোপাথাড়ি নকশার। আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সৃষ্টি হওয়া ১২ জোড়া করোটিক স্নায়ুর একটি উল্লেখযোগ্য স্নায়ু হচ্ছে ভেগাস স্নায়ু। এটি মেডুলা অবলংগাটার পার্শ্বদেশ থেকে সৃষ্টি হয়ে প্রতিটি স্নায়ু চারটি শাখায় বিভক্ত হয়। এই ভেগাস স্নায়ুর একটা শাখা হচ্ছে ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ু। যার কাজ হচ্ছে স্বরযন্ত্রের পেশী সমূহ পরিচালনা করা। স্বরযন্ত্র পরিচালিত হয় সুপিরিয়র ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ু ও পূণরাবৃত্তি(recurrent) ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ুর মাধ্যমে। ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ুর উৎপত্তি স্থল থেকে স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংসের দূরত্ব কয়েক সেন্টিমিটার।
স্বরযন্ত্রের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সুপিরিয়র ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ু(উপরের চিত্র দ্রষ্টব্য), যেটি ভেগাস স্নায়ু হতে বেরিয়ে সোজা পথে চলে গেছে স্বরযন্ত্রে। আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে রেকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ু। আমাদের আজকের গল্পের প্রোটাগোনিস্ট হচ্ছে এই পুণরাবৃত্তিক বা রেকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ু। এই স্নায়ুর উৎপত্তি স্থল থেকে স্বরযন্ত্রের দূরত্ব কয়েক সেন্টিমিটার। কিন্তু, অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, এটি সোজাপথে না গিয়ে গলা বেয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে। নামতে নামতে হার্টের এওর্টিক আর্চের নীচ দিয়ে গিয়ে আবার ইউ টার্ন দিয়ে গলা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে স্বরযন্ত্রের নিম্নাংশে যুক্ত হয়। পৃথিবীর প্রায় সব টেট্রাপডের দেহেই এমন নজির আছে। জিরাফের ক্ষেত্রে এই অযথা ঘুরে আসার পথটা আরও দীর্ঘ। সেক্ষেত্রে জিরাফের RLN মাত্র চার ইঞ্চির পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অযথাই পাড়ি দিলো ১৫ ফুট(বা ৪.৬ মিটার) লম্বা দূরত্ব। (১)
জীবাশ্মবিদ ম্যাথিও ওয়েডেল দেখান, সরোপডদের RLN কে পাড়ি দিতে হয়েছিলো প্রায় ২৮ মিটার লম্বা দূরত্ব।(২)
এবার প্রশ্ন আসে, কেন RLN(রেকারেন্ট লরিঞ্জিয়াল নার্ভ) মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের পথ সোজাসুজি না গিয়ে এতো লম্বা পথ অযথাই ঘুরে আসলো?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে কোটি কোটি বছর আগে। ঠিক যখন আমাদের ,সব টেট্রাপডদের পূর্ব-পুরুষ ছিলো মাছ আকৃতির। সেই প্রিমিটিভ মাছের ব্যবচ্ছেদ করে এবার আমরা স্বাক্ষী হবো এক বিবর্তনীয় লিগ্যাসির।
মাছের হৃদপিন্ড দুই কক্ষ বিশিষ্ট। এটা ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টা নামক একটা কেন্দ্রীয় ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত করে। এই ভেন্ট্রাল এওর্টা থেকে ছয়টি রক্তনালী বেরিয়ে ছয়টি ফুলকার মধ্য দিয়ে গিয়ে যুক্ত হয় আরেকটি বড় ধমনীর সাথে, যার নাম ডর্সাল এওর্টা। ডর্সাল এওর্টার উপরেই অবস্থিত মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসা চারটি স্নায়ু। তন্মধ্যে চতুর্থ স্নায়ুটি হচ্ছে আমাদের আজকের প্রোটাগনিস্ট, রেকারেন্ট লরিঞ্জিয়াল স্নায়ু। এটি ডর্সাল এওর্টা্ ও ষষ্ঠ ফুলকার মধ্য দিয়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছে ষষ্ঠ ল্যারিংসের সাথে। প্রাচীন ল্যারিংস মূলত কাজ করতো একটা সাধারণ স্ফিংকটার হিসেবে । যেটা নিম্ন বায়ুপথকে বহির্গত কোনোকিছুর অনুপ্রবেশ থেকে রক্ষা করতো। আজকের দিনে সেই স্ফিংকটার টেট্রাপডদের স্বরযন্ত্র হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। (৩)
আমদের সেই পূর্বপুরুষ, মাছ-জাতীয় প্রাণির কোনো গলা ছিলো। তাই তার ভেগাস স্নায়ু থেকে RLN বেরিয়ে সোজাসুজি ল্যারিংসে যুক্ত হয়েছে। তাই তার গতিপথ ছিলো সোজা এবং তার দেহের জন্য যথার্থ। কিন্তু, বিবর্তনের ধারায় টেট্রাপডদের হৃদপিণ্ড নীচে চলে যাওয়া ও মস্তিষ্ক সহ ঘাড় উপরে চলে আসায় এই ল্যারিঞ্জিয়াল নার্ভকে হৃদপিণ্ড হয়ে ল্যারিংসে যুক্ত হতে অপচয় করতে হয় অনেক খানি পথ। এই অপচয় ও ত্রুটিপূর্ণ গঠন-ই নির্দেশ করে সব টেট্রাপডদের একক এনসেস্ট্রাল ইতিহাসকে। নির্দেশ করে এক আশ্চর্য-সুন্দর বাস্তবতাকে।(৪)
মার্কিন জীবাশ্মবিদ স্টিফেন জে গুলড এর ভাষ্যে,
“আপাত-অদ্ভুত সজ্জার হাস্যকর সমাধান হলো বিবর্তনের পথের নজির, যে পথ কোনো বুদ্ধিমান স্রষ্টা নেবেন না, কিন্তু (জীবের বিবর্তনীয়) ইতিহাসের দ্বারা সীমাবদ্ধ হবার কারণে যে পথ প্রাকৃতিক নির্বাচন নিতে বাধ্য থাকে।”
তথ্যসূত্রঃ
(১) Mammal Anatomy: An Illustrated Guide. Marshall Cavendish Corporation. 2010. page:74-75
(৪)Dawkins, Richard (2009). “11. History Written All Over Us”. The Greatest Show on Earth. New York: Free Press. Page:360-362
Leave a Reply