টিক টিক টিক! ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেকটা কাজে ঘড়ি দেখতে হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই ভার! কিন্তু ঘড়িতে আমরা যা দেখি তাই কি আসলে প্রকৃত সময়? আমাদের ঘড়িতে দেখা সময়ের সাথে আসলে কতটুকু মিল রয়েছে মহাবিশ্বের সময়ের? সময়কে আমরা যেভাবে ভাবি, সময় কি আসলেই তাই? নাকি শুধুই আমাদের চোখের ধাঁধা? সময়কে এমন একটি সার্বজনীন পটভূমি বলে মনে করা হয়, যার মধ্যে দিয়ে মহাবিশ্বের সমস্ত ঘটনাবলি এগিয়ে যায় এবং যা পর্যায়ক্রমে প্রবাহিত হয়, যার একটি ব্যাপ্তি রয়েছে। কিন্তু এক সেকেন্ড থেকে পরবর্তী সেকেন্ডে এগিয়ে যাওয়া – সময়ের প্রবাহ কি এতটাই সরল? সময় বাস্তব, সর্বদা বিরাজমান, শুধু সামনের দিকে বয়ে চলে, সময় নদীর মত ছুটে চলে, নির্দিষ্ট ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যায়, সময়ের বিচারে শুধু বর্তমান কালটাই আসল – সময়ের এই বৈশিষ্ট্যগুলো মহাবিশ্বের প্রকৃত বাস্তবতা নাকি মানবমস্তিষ্ক প্রসূত ধ্যান-ধারনা, তা নিয়ে চলছে নানান ধরণের গবেষণা।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এবং তখন থেকে সময় প্রবাহিত হয়ে আজকের দিনে এসে পৌঁছেছে। পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর এবং পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটে ৩,০০,০০০ বছর আগে যা মহাবিশ্বের বয়সের মাত্র ০.০০২%। এখন থেকে চার শতাব্দী আগে বিজ্ঞানী নিউটন স্থানকালকে অপরিবর্তনীয় ও ধ্রুবক বিবেচনা করেছিলেন। সময় বাহ্যিক কোনো কিছুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন না করে সব স্থানে সমানভাবে প্রবাহিত হয়- এমন ধারনাই তিনি দিয়েছিলেন। বিংশ শতকে এসে আইনেস্টাইন এই ধারণা পাল্টে দেন। আইনেস্টাইনের আপেক্ষিকতার ধারণা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন সময় পরিমাপযোগ্য। সময়ের গতি বাড়বে না কমবে তা নির্ভর করে মহাকর্ষ ও স্থানকালের ওপর।
তবে আইনেস্টাইনের সময়ের আপেক্ষিকতার বাস্তবায়ন বড় পরিসরে তখনই প্রভাব রাখবে, যখন আপনি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করবেন (কোনো বস্তুর আলোর গতিতে ভ্রমণ সম্ভব নয়) বা শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কাছে যাবেন। একটি স্পেসশিপে চড়ে যদি আপনি আলোর গতির প্রায় কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করেন, তাহলে আপনার গননা অনুযায়ী দেখবেন আপনি কয়েকদিনের মধ্যে কয়েক আলোকবর্ষ ভ্রমণ করে ফেলেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে দেখতে পাবেন ইতোমধ্যেই কয়েক হাজার বছর পার হয়ে গিয়েছে! তাত্ত্বিকভাবে আপনার অতীত ও ভবিষ্যতেও ভ্রমণ করা সম্ভব। তবে আইনেস্টাইন ও নিউটন কিন্তু সময় নিয়ে একটি ব্যাপারে একমত ছিলেন যে- সময় শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মানুষ এখনও মহাবিশ্বে এমন কোনো কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি, যা ইচ্ছামত সময়কে সামনে পিছনে সরাতে পারে। সবকিছুই শেষ পর্যন্ত সামনের দিকেই এগিয়ে যায়, কেবলমাত্র আলোর গতির কাছাকাছি ভ্রমণ করলে বা শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্রের কাছে গেলে সময়ের গতি প্রভাবিত হয়, আপেক্ষিকভাবে ধীর হয়। কিন্তু কেন সময় শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যায়?
ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বের সবকিছুই শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে যেতে চায় অর্থাৎ অল্প এন্ট্রপি থেকে অধিক এন্ট্রপির দিকে যায়। যেমন বিগ ব্যাঙের পর সবকিছু সাধারণভাবে শুরু হয়ে এলোমেলোভাবে বিন্যস্ত গ্যালাক্সি ও অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তু বর্তমান সময়ে এসেছে। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন এই প্রক্রিয়াকে ‘অ্যারো অফ টাইম’ বা ‘সময়ের তীর’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষ্যমতে সময় প্রতিসম নয়, “আমরা যদি সময়ের তীর অনুসরণ করি তাহলে আমরা এই বিশ্বে আরও আরও এলোমেলো উপাদান খুঁজে পাব এর মানে তীরটি ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে, আর যদি এলোমেলো উপাদানগুলো কমতে থাকে তাহলে তীরটি নির্দেশ করবে অতিতের দিকে।” আরেকটি তত্ত্ব হল সময় প্রবাহের সাথে সাথে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়। যেহেতু মহাবিশ্ব প্রসারিত হয় এটি সাথে সময়কেও টেনে নেয়, কারণ স্থান-কাল পরস্পর সংযুক্ত। কিন্তু যদি এমন হয় যে মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে আবার সংকোচন শুরু করল, তখন সময় বিপরীত দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করবে! পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এমনই যে সময়ের উল্টোদিকেও চলতে পারে অর্থাৎ মহাবিশ্বের কার্যক্রম যদি বিপরীতমুখি হয়েও যায়, তবু সূত্রগুলো পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য। যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, সময়ের তীরটি শুধু সামনেই এগিয়ে যাওয়ার কোন বাস্তব কারণ নেই। তাই সময়ের প্রকৃত তীর আসলে কেমন তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের রয়েছে মহাসংশয়।
একটি ব্লক ইউনিভার্স চিন্তা করুন যা আইনেস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র দ্বারা সমর্থিত, যেখানে একটি চার-মাত্রিক স্পেস-টাইম কাঠামো রয়েছে যার মধ্যে সময় আর স্থানের কোনো বাহ্যিক পার্থক্য নেই, যেখানে প্রতিটি ঘটনার নিজস্ব স্থানাঙ্ক বা অবস্থান রয়েছে। সেখানে কোনো ক্রিয়ার কাল নেই, প্রত্যেক বিন্দুতে সময় সমান ফলে সেখানে ভবিষ্যত ও অতীতের অস্তিত্ব বর্তমানের চেয়ে কম সত্য নয়।
এখন আসি চার-মাত্রিক স্পেস-টাইম বলতে কি বোঝায়? শূন্যে ভাসমান যেকোনো বস্তুর অবস্থান বর্ণনা করতে তিনটি স্থানাঙ্ক প্রয়োজন- x, y, z (সাধারনভাবে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা) অক্ষ। কিন্তু দুটি ভিন্ন বস্তুর তিনটি অক্ষের মধ্যে অবস্থান একেবারে এক হলেও বস্তু দুটি সমপাতিত নাও হতে পারে। ধরুন আপনি যে চেয়ারটিতে এখন বসে আছেন তার অবস্থান x, y, z অক্ষ দ্বারা পুরোপুরি নির্ণয় করা গেলেও আপনার এই বসে থাকা সময়ের সাপেক্ষে নির্ভরশীল। অর্থাৎ আপনি ঠিক এই মুহূর্তে চেয়ারটিতে বসে আছেন, কিন্তু গতকালকে ঠিক একই সময়ে, এক ঘন্টা আগে এখানে বসে ছিলেন না কিংবা এখন থেকে এক সপ্তাহ পরে, এক বছর পরে, দশ বছর পরে হয়ত একই সময়ে এখানে বসে থাকবেন না। তাই স্পেস-টাইমে কোনো ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা করতে x, y, z অক্ষের পাশাপাশি সময় (t) অক্ষেরও প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ ঘটনাটি কখন ঘটেছিল তাও জানা প্রয়োজন। সময়ের যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাতে যদি সময়কে চতুর্থ মাত্রা হিসাবে বিবেচনা না করা হয়, তাহলে আইনেস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বৈধতা থাকে না এবং স্পেস-টাইম দিয়ে মহাবিশ্বকে বর্ণনা করার সুযোগও থাকে না। সময় আসলে মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সময়ের সামনের দিকে এগিয়ে চলে রৈখিক ধারণাটি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সাথে অতপ্রতভাবে জড়িত। অধিকাংশ পদার্থবিদের মতে, তাপগতিবিদ্যার এই দ্বিতীয় সূত্র পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অলঙ্ঘনীয় নিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর সময় যদি মহাবিশ্বের প্রকৃত বা বাস্তব উপাদান না হয়, তাহলে তাপগতিবিদ্যার এই প্রয়োজনীয় সূত্রটি অর্থহীন হয়ে যাবে। আইনেস্টাইন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করেছেন, সময় কোনো পরম পরিমাণ নয়। বরং স্থান ও কাল একত্রিত হয়ে স্থান-কাল নামক বাহ্যিক পরিমাণ গঠন করে। গানিতিকভাবে স্থান-কাল দিয়ে আমরা বিভিন্ন ভৌত প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কীভাবে একে ওপরের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় তা নির্ণয় করতে পারি।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির একজন তাত্ত্বিক কসমোলজিস্ট আন্ড্রেয়াস অ্যালব্রেক্ট (Andreas Albrecht) বলেন, “”সময় হল একটি বাহ্যিক প্যারামিটার – ক্লাসিকাল গতির সমীকরণে এটা স্বাধীন প্যারামিটার। আমরা ছোটবেলায় ঘড়ি দেখে সময় বলতে বুঝি, তার গুরুত্ব পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়নে বলতে গেলে অনুপস্থিত মনে হতে পারে – যতক্ষন না আপনি আপেক্ষিকতা শিখতে আসেন। আপেক্ষিকতার সারমর্ম হল যে পরম সময় বলতে কিছু নেই, পরম স্থান বলতেও কিছু নেই। সবকিছুই আপেক্ষিক। আপনি যখন মহাবিশ্বের প্রক্ষাপটে সময় নিয়ে আলোচনা করতে চান, তখন আসলে আপনাকে মহাবিশ্বের একটি অংশকে আলাদা করে নিতে হয় এবং এটির সময়কে আপনার ঘড়ি হিসেবে নির্দির্ষ্ট করতে হয়। আর তখন আপনার আলোচিত সময়ের প্রবাহ নিহিত থাকে শুধুমাত্র মহাবিশ্বের ঐ নির্ধারিত বিচ্ছিন্ন অংশ এবং আপনি যেটিকে ঘড়ি বলছেন – এ দুইয়ের সম্পর্কের মাঝে।”
অনেক বিজ্ঞানী অনেক ধরনের মতামত, অনুকল্প এবং তত্ত্ব দিয়েছেন “সময়” নিয়ে। তবে আজও সময়ের প্রকৃত সত্য বের করতে গিয়ে করতে গিয়ে আমরা জড়িয়ে পড়ি রহস্যের ধূম্রজালে!
তথ্যসূত্র:
- “The Illusion of Time: What’s Real?” – space.com
- “Does Time Really Exist?” – thoughtco.com
Leave a Reply