মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের আবিষ্কার হলো যেভাবে

১৯৭৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেলটা যায় আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন এর হাতে। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউণ্ড আবিষ্কারের জন্যে তাঁরা এই সম্মান পায়। আলোক বর্ণালীর ১.৯ মিমি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অংশের নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউণ্ড বা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। এর এমন নামকরণের পেছনে কারণ হচ্ছে, এই বিকিরণ এর জন্ম হয়েছিল আজ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে ঘটা মহাবিস্ফোরণ এর সময়। মহাবিশ্বের শুরু থেকে ঘটে যাওয়া মহাজাগতিক ঘটনা সমূহ সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করে এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপে চোখ রেখে আজ থেকে  বিলিয়ন বছর আগের অতীতের তরুণ মহাবিশ্বকে দেখতে পান। দেখতে পান সেই তরুণ মহাবিশ্বে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনা গুলো। কখন পরমাণু গঠিত হয়েছে, কখন ইলেকট্রন, প্রোটন এর জন্ম এসব তথ্য বিলিয়ন বছরের অতীত থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে নিয়ে আসে এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউণ্ড।  

কসমিক মাইক্রোওয়েভ সম্পর্কে ১৯৪৮ সালের দিকে প্রথম ভবিষ্যৎবানী করেন রালফ আলফার এবং রবার্ট হারম্যান। তারও আগে রাশিয়ান বিখ্যাত পদার্থবিদ জর্জ গ্যামো এ বিষয় নিয়ে কাজ করেছিলেন। কিন্তু তখনও কসমিক মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কৃত হয় নি।

যুক্তরাষ্ট্রের এটিঅ্যান্ডটি কোম্পানির একটা গবেষণা শাখা হচ্ছে বেল ল্যাবরেটরিজ। সেখানে ১৯৬৪ সালের দিকে কাজ করতেন আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন। রেডিও তরঙ্গ নিয়ে কাজ করার জন্যে বিশাল এক অ্যান্টেনা আকাশের দিকে তাক করেছিলেন তাঁরা। আলোক বর্ণালীর দীর্ঘতম তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ হচ্ছে রেডিও ওয়েভ। বলে রাখা ভালো যে, মহাকাশে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের আলোক বিকিরিত হচ্ছে। এসব আলোক তরঙ্গের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্ক।  ৩৮০ থেকে ৭৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ সমূহকে আমরা খালি চোখে দেখি। এদেরকে দৃশ্যমান তরঙ্গ বলে। আর বাকি গুলো আমরা দেখি না।

পেনজিয়াস এবং উইলসনের তাক করা শিং এর মতন অ্যান্টেনা।

 

মজার বিষয় হচ্ছে পেনজিয়াস এবং উইলসনের অ্যান্টেনা তে রেডিও তরঙ্গ ধরা দিচ্ছিল না। সেখানে ধরা দিচ্ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরণের তরঙ্গ। এর নাম মাইক্রোওয়েভ। অ্যান্টেনা যেদিকেই তাক করা হচ্ছে না কেনো প্রতি ক্ষেত্রেই মাইক্রোওয়েভ আলো ধরা দিচ্ছে। এই দুই বিজ্ঞানী ব্যস্ত হয়ে এই তরঙ্গ গুলোর উৎস খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু এই মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের উৎস তাদের কাছে রহস্যই হয়ে রইল। তাঁরা ভাবলেন অ্যান্টেনা তে কোন সমস্যা হলো কিনা। সেজন্যে ডিটেক্টরটিতে ভালোমতন খোজাখোজি করা শুরু করলেন। তখন তাঁরা খেয়াল করলেন এর ভেতরে বাসা বেঁধেছে কবুতরের ঝাঁক। অ্যান্টেনা ঢেকে আছে কবুতরের মলে। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই এই দুই বিজ্ঞানির মনে সন্দেহ জাগল, রহস্যময় এই মাইক্রোওয়েভ এর কারণ এই কবুতরের মল কিনা! 

Differential Microwave Radiometer দিয়ে তোলা কসমিক মাইক্রোওয়েভ এর ছবি।

অ্যান্টেনা থেকে কবুতরের মল পরিষ্কার করা হল। এবারো অ্যান্টেনায় ধরা দিচ্ছে সেই মাইক্রোওয়েভ। কিন্তু এবার আগেরবার থেকে কিছুটা কম। বোঝা গেলো রহস্যময় এই মাইক্রোওয়েভ এর কারণ আসলে কবুতরের মল না। তবে এর ব্যাখ্যা তখনো ছিল না এই দুই বিজ্ঞানীর কাছে। ঐদিকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড পরিমাপের জন্যে কাজ করছিলেন রবার্ট ডিক এর নেতৃত্বে একদল পদার্থবিদ। পেনজিয়াস এবং উইলসনের কাজ সম্পর্কে অবগত হলেন সেই গবেষক দল। তাঁরা বেশ নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছিলেন যে পেনজিয়াস এবং উইলসনের অ্যান্টেনাতে ধরা দেয়া রহস্যময় মাইক্রোওয়েভ গুলো কোথা থেকে আসছে। প্রিন্সটন এর এই গবেষক দল পেনজিয়াস এবং উইলসন এর সাথে একটা মিটিং এ বসলেন। তাঁরা জানালেন এক বড় আবিষ্কার করে বসে আছেন এই দুই বিজ্ঞানী। আসলে অনিচ্ছাকৃতভাবে আদিম মহাবিশ্বে তৈরি হওয়া মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ রশ্মিকে ধরতে পেরেছেন তাঁরা।

বিগ ব্যাং এর পক্ষে একটা জোরালো প্রমাণ হল এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ। বিগ ব্যাং এর শুরুর দিকে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল এবং মহাবিশ্ব দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল। তখন বিকিরিত ফোটন গুলো অনেক দূর অতিক্রম করতে পারত না কারণ এদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ইলেকট্রন।     

বিগ ব্যাং এর পক্ষে একটা জোরালো প্রমাণ হল এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ। বিগ ব্যাং এর শুরুর দিকে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল এবং মহাবিশ্ব দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল। তখন বিকিরিত ফোটন গুলো অনেক দূর অতিক্রম করতে পারত না কারণ এদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ইলেকট্রন। মহাবিশ্বের উত্তপ্ত অবস্থার দরুন তখনো ইলেকট্রন গুলো নিউক্লিয়াস এর চারপাশে থেকে পরমাণু গঠন করে নি। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে এর তাপমাত্রাও ক্রমেই কমে আসছিল। ক্রমশ ঠাণ্ডা হচ্ছিল মহাবিশ্ব। এভাবে ৩,৮০,০০০ বছর পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা পরমাণু গঠনের জন্যে যথেষ্ট কমে এসেছিল। তখন ইলেকট্রন গুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে স্থায়ী কক্ষপথে অবস্থান করে পরমাণু গঠন করে। ফলত ইলেকট্রনেরা আর ফোটন এর পথে বাধা হয়ে রইল না। ফোটন গুলো বাধাহীন ভাবে ছুটতে থাকল। তবে মহাবিশ্ব প্রসারণের সাথে সাথে ফোটন গুলোও ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকল। এদের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকল এবং কম্পাঙ্ক কমতে থাকল। এতে করে ক্রমেই ফোটন এর শুক্তি কমে আসছিল। আর এভাবেই ফোটন গুলো ধীরে ধীরে নিম্নশক্তির কসমিক মাইক্রোওয়েভ এ পরিণত হল। আদিম মহাবিশ্ব থেকে আসা অবশিষ্ট এই আলো মহাবিস্ফোরণ এর মহাকাব্য নিয়ে হাজির হয় বিজ্ঞানীদের কাছে।

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 236-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers