আচ্ছা, তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, “বলো তো, তুমি কবে মৃত্যুবরণ করবে?” – উত্তরে তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বলবে, “এটা আবার কি রকম বিচিত্র প্রশ্ন!” আবার, কেউ কেউ ধার্মিক হয়ে বলবে যে, “সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই মৃত্যুর দিন বলতে পারেনা, এমনকি ধারণাও করতে পারে না”। কিন্তু, এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যার সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে তিনি নিজের মৃত্যুর দিন ধারণা করেছিলেন, এমনকি তা কাকতালীয়ভাবে মিলেও গিয়েছিল। তোমরা হয়তো ভাবছো যে, তিনি হয়তো বা কোন মহান ঋষি অথবা জ্যোতিষী, কিন্তু তিনি আসলে কোনো ঋষি কিংবা জ্যোতিষী নন বরং একজন মস্ত বড় গণিতবিদ। শুধু গণিতবিদ বললেও ভুল হবে, তিনি একধারে গণিতবিদ, পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিদ। চলো প্রথমে জানা যাক সেই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে।
তিনি হলেন আব্রাহাম ডি ময়ভার (Abraham de Moivre)। তিনি ১৬৬৭ সালের ২৬শে মে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন ফরাসি গণিতবিদ হলেও তিনি পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন। বিভিন্ন বড় বড় বিজ্ঞানীরা ছিলেন তাঁর বন্ধু। এক সময়কার রাজকীয় গ্রিনিচ মান-মন্দিরের প্রধান এডমন্ড হ্যালিরও বন্ধু ছিলেন তিনি। এমনকি বাদ যায়নি বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনও। তাঁর অবদান মূলত গণিতে। অবশ্য তিনি জীবনের একটা সময় বিজ্ঞান চর্চা করে কাটিয়েছিলেন। তাঁর “ডি ময়ভারের উপপাদ্য” ত্রিকোণমিতিতে জটিল সংখ্যার আলোচনায় একটি পরিচিত উপপাদ্য। তবে তাঁর আগেই তিনি সম্ভাবনার উপর দুইটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রকাশ করেন। ১৭১৮ সালে সম্ভাব্যতা তত্ত্বের উপর প্রকাশিত “The Doctrine of Chances” বইয়ে তিনি বহু সমস্যা পর্যবেক্ষণ করেন এবং কিছু নীতি আবিষ্কার করেন, যেমন স্বাধীন ঘটনা এবং গুণনবিধির ধারণা।
তাঁর এই বইটিই ছিল সম্ভাব্যতা তত্ত্বের দ্বিতীয় (কারো কারো মতে প্রথম) পাঠ্য বই। তিনি এই বইয়ে ‘নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন’, ‘বাইনোমিয়াল ডিস্ট্রিবিউশন’, ‘সেন্ট্রাল লিমিট থিওরি’-ও আলোচনা করেন। আবার তিনিই সর্বপ্রথম ফিবোনাচ্চি রাশিমালার বাইনেট’স ফর্মুলা (Binet’s formula) আবিষ্কার করেন, যেটি দ্বারা ফিবোনাচ্চি রাশিমালার যে কোনো পদ অর্থাৎ n-তম পদ বের করা যায়। পরবর্তীতে, তিনি স্টার্লিং-এর সূত্র আবিষ্কার করেন এবং সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি হিসাবে পরিমিত ঘটনাসংখ্যা বক্ররেখার ব্যবহার করেন। গণিতবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি। মূলত গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান সবখানেই সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি।
এই হলো তার কর্মজীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
চলো, এবার জানা যাক তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত সেই গল্প সম্বন্ধে।
তিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতেও গভীরভাবে গণিত চর্চায় মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সম্ভাব্যতা নিয়ে পড়াশোনা করে গিয়েছেন। মৃত্যুর পরেও তাঁর গণিতের উপর লেখা কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ দিককার সময়ে তিনি প্রচুর ঘুমকাতুরে হয়ে পড়েন। প্রয়োজনীয় ঘুমের পরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুমাতেন। প্রচলিত আছে, তিনি একদিন খেয়াল করলেন তিনি আগের থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং প্রতিদিন আগের দিনের থেকে ঠিক ১৫ মিনিট করে বেশি ঘুমাচ্ছেন। গণিতপাগল ডি ময়ভার হিসাব করলেন এভাবে যে, ১৫ মিনিট করে বাড়তে বাড়তে ১৭৫৪ সালের ২৭ নভেম্বর তার ঘুমের পরিমাণ হবে ২৪ ঘন্টা। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করলেন যে, ওই দিনই তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। এরপর, ঠিক ১৭৫৪ সালের ২৭ নভেম্বর-ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু, ডি ময়ভার কি আসলেই তার মৃত্যুদিবস নিয়ে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন?
এমন দাবি বারবারই এসেছে যে, ময়ভার সত্যি সত্যিই তার মৃত্যুর দিন গণনা করতে পেরেছিলেন এবং তা প্রমাণ করার জন্যে যথেষ্ট প্রমাণাদিও আছে। কিন্তু আসলে তা নয়! প্রকৃতপক্ষে, ১৯৩৪ সালে হেলেন এম. ওয়াকার ডি ময়ভরের জীবনী নিয়ে একটা লেখা প্রকাশ করেন স্ক্রিপটা ম্যাথমেটিকা ভলিউম II-তে। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেনঃ
ডি মোইভার সম্পর্কে অনেকেই বলেন যে, তিনি সর্বদা সংখ্যার সিরিজ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, প্রতিদিন তার আগের দিনের চেয়ে ১৫ মিনিট বেশি ঘুমের প্রয়োজন হবে এবং এভাবে মোট ২৪ ঘন্টা পৌঁছলে তার মৃত্যু ঘটবে। এইরকম একটা অতিরঞ্জিত গল্প কয়েকজন লেখকের দ্বারা বেশ ভালো মতনই সাধারণের কাছে পৌঁছেছে। বাস্তবে এই গল্পের কিছুটা সত্য হলেও, গণিতের হিসাবে ডি মোভারের নিজের মৃত্যু সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীর বিবৃতিটি সম্পূর্ণরূপে অপ্রাসঙ্গিক এবং এ সম্পর্কিত তখনকার কোন লিখিত বিবরণও পাওয়া যায় নি।
গল্পের সত্যতা এইটুকু যে, জীবনের শেষ দিকে ময়ভার ক্রমেই শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। তিনি দৈনিক ২০ ঘন্টার বেশি ঘুমাতেন এবং তার অবস্থা ক্রমেই বেগতিক হচ্ছিল। তবে তার নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করার গল্পের কোন নির্ভরযোগ্য উৎস নেই। সুতরাং গল্পটি অতিরঞ্জিতই বলা চলে।
তো, সবাইকে গাণিতিক শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকে এখানেই বিদায় নিচ্ছি। জয়তু গণিত।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply