এলিয়েনরা আসলে দেখতে কেমন?

এলিয়েন শব্দটির সাথে কম বেশি আমরা সবাই পরিচিত। তবে ঘাপলাটি হল অন্য যায়গায়।  ইংরেজি এলিয়েন শব্দটির বাংলা মানে করলে দাড়ায় ভীনদেশী কোন মানুষ, বহিরাগত কিংবা পরদেশী। তবে অবস্থাটা এখন এমন দাড়িয়েছে, এলিয়েন শব্দটি আমাদের সামনে এলেই চোখের সামনে কিংবা কল্পনায় ভেসে উঠে কিম্ভূতকিমাকার কোন এক প্রাণীর প্রতিবিম্ব! 

এমনটা ঘটবার একটা বড় কারণ, টেলিভিশন চালু করলেই হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো আমাদর নানা ধরনের এলিয়েনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাদের অস্বাভাবিক বড় মাথা, বড় বড় দুটো সবুজ চোখ, কারো আবার কিলবিল করছে শূড়ের মত কতগুলো হাত পা, এমন সব কিম্ভুত চেহারার এলিয়েন। আসলে সত্যিই কি বর্হিজাগতিক প্রাণগুলো এমনই অদ্ভূত চেহারার ? এই চলচ্চিত্র এবং সায়েন্স ফিকশনগুলোর কারণে মানুষর মনে এলিয়েনের ব্যাপারে বেশ বড় একটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। 

হলিউডের চলচিত্রগুলো এলিয়েনের এই রুপটাই সাধারণত বেশি দেখানো হয়েছে।

সায়েন্স ফিকশনে বিভিন্ন সময় এলিয়েনকে বিভিন্ন ভাবে দেখানো হয়েছে। ১৯৩৯ সালের জুলাইয়ে লেখক এ ই ভ্যানভট, দ্য আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্স ফিকশন বইতে দ্য ব্লাক ডেস্ট্রয়ার নামে একটি গল্প লেখেন। সেখানে তিনি আমাদের সিউরল নামে এক এলিয়েনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যার ছিল কাঁধের গোড়া থেকে উৎপন্ন অসংখ্য ধারালো টেন্টাকল যুক্ত থাবা। 

১৮৯৭ সালে প্রকাশিত এইচ. জি. ওয়েলস এর সেই জগৎখ্যাত সায়েন্স ফিকশন, দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস এর কথা তো বোধহয় আপনারা সকলেই জানেন। এখানে দেখানো হয় মার্শিয়ান বা মঙ্গলবাসীরা তাদের সিলিন্ডার আকৃতির মহাকাশযান নিয়ে লন্ডনের উপকেন্দ্রে অবতরণ করেছে। তাদের চেহারা ছিল ভয়ানক, ধূসর রঙের বিশালাকৃতির এক একটি মাংসপিন্ডের মত। ভালুকের সমান আকার, যেন সেটি আলোতে ভেজা চামড়ার মত চকচক করছিল। কুতঁকুতে চোখগুলোর নিচের ওই মুখটা ছিল আরো বিভৎস। সেই মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।

এইচ জি ওয়েলসের সেই বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন, দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস এর প্রচ্ছদ।

মঙ্গলবাসীরা তাদের তিন পা বিশিষ্ট যুদ্ধাস্ত্র এবং মরণঘাতী তাপরশ্মি দিয়ে পৃথিবীর বুকে আক্রমণ শুরু করে। উদ্বাস্তুরা প্রাণ বাঁচাতে শহর ছেড়ে সমুদ্রের উপকূলে পালাতে শুরু করল। গল্পটিতে আমরা জানতে পারি, সেই অপার্থিব মঙ্গলবাসীদের ছিল ১৬ টি টেন্টাকল যুক্ত মাথা। তাদের প্রধান খাদ্য কি ছিল আন্দাজ করে বলতে পারবেন?  মানুষের তাজা রক্ত! ব্যাপারটা চিন্তা করতে গিয়েই আমার শরীরটা কেমন জানি গুলিয়ে উঠল!

একটু আগে আমরা যে বিখ্যাত এলিয়েন চরিত্র সিউরলের বর্ণনা পড়ছিলাম, এমন অসংখ্য রুপে বিভিন্ন বইতে এলিয়েনের বর্ণনা রয়েছে। যেমন, কোন বইতে এলিয়েনকে বর্ণনা করা হয়েছে বিড়ালের মত। কোথাও আবার পাখির মত। কোন কোন বইতে আবার টিকটিকির মত দেখতে এলিয়েনের বর্ণনাও পাওয়া যায়।ল্যারী নিভেনের  রিং ওয়ার্ড সিরিজে কেজিন নামে একটি এলিয়েন চরিত্র রয়েছে যা দেখতে অনেকটা বাঘের মত।

অনেক সময় গল্পে এলিয়েনের রুপায়নে দেখা যায় মিথোলজিতে বর্ণিত নানা ধরনের চরিত্রের প্রভাব। গল্পে প্রচলিত আতংকের উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রে মিথোলজি একটি সমৃদ্ধ এবং মনস্তাত্ত্বিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাচীন সংস্কৃতিতে দেবতাকে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীদের অদ্ভুত সংমিশ্রণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

যেমন ধরুন, মিশরে দেবতা আনুবিসকে বর্ণনা করা হয়েছে শিয়ালের মাথাওয়ালা এক মনুষ্যকৃতির প্রাণীর সাথে। এভাবে অনেক সময় এলিয়েনের বর্ণনা দিতে গিয়ে একটি ডানাওয়ালা সিংহের মাথায় মানুষের মাথা জুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক যুগের সায়েন্স ফিকশন লেখকরা এভাবেই তাদের গল্পের চরিত্রগুলো সৃষ্টি করতেন। এমনকি ৫০ এর দশকে হলিউডের সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রগুলোতেও এমনটা দেখা যায়।

মিশরীয় প্রাচীন দেবতা আনুবিস, যার মুখটি ছিল দেখতে শেয়ালের মত।

সেটি প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেক বলেন, “এই মহাবিশ্বের ছায়াপথে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন তারকারাজি রয়েছে এবং এদের মধ্যে প্রায় দশ শতাংশ বয়স এবং গঠনের দিক থেকে সূর্যের মতই। সেই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, আমাদের এই মহাবিশ্বে ৪০ বিলিয়ন তারকাপুঞ্জে জীবনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব।

বিজ্ঞানী ফ্রাংক ড্রেক কতৃর্ক প্রতিষ্ঠিত সেটি ( SETI) ইন্সটিটিউট, যেখানে মহাকাশ থেকে আগত বিভিন্ন সিগন্যাল এবং এলিয়েন নিয়ে গবেষণা করা হয়।

বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানী কার্ল সাগান সব সময় একটি কথা বলতেন। সেটি হল এই মহাবিশ্বে যদি শুধুমাত্র আমরাই থেকে থাকি, তা হবে এই মহাবিশ্বের ভয়াবহ অপচয়! এই এলিয়েন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এস্ট্রোবায়োলজি নামে বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখার সৃষ্টি হয়েছে। বহির্জাগতিক প্রাণ কেমন হতে পারে এবং কিভাবে তাদের বিকাশ ঘটতে পারে, সেই বিষয়ে এখানে আলোচনা করা হয়। 

কসমস, কন্ট্যাক্ট, ড্রাগনস অব ইডেন সহ অসংখ্য বেস্টসেলার বইয়ের লেখক মহান জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান।

প্রাগৈতিহসিক পৃথিবীতে অণু পরমাণু আগ্নেয়গিরি বা সাগরতলের প্রচন্ড তাপে দগ্ধ হয়ে জীবনের সৃষ্টি করেছিল। মহাশুন্যে ভাসমান বায়বীয় মেঘ এবং উল্কাতে যে প্রাটিনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা বিভিন্ন জটিল জৈব কণা যেমন ফরমালডিহাইড, অ্যালকোহল এবং অ্যামিনা অ্যাসিড এর বিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে বর্হিজাগতিক জীবের অস্তিত্ব বা বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমাদের হলিউড টিভির পর্দায় যা দেখায়, সেটি এবং বাস্তবতা যে এক নয়, এটি আমাদের বুঝতে হবে। 

বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের কন্ট্যাক্ট নামের উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করা হয় এলিয়েন নিয়ে হলিউডের অন্যতম আলোচিত চলচিত্র, কন্ট্যাক্ট। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী জোডি ফস্টার।

পৃথিবীতে আমরা যেভাবে অক্সিজেন গ্রহন করে বেঁচে আছি, হ্যাবিটেবল জোনের গ্রহগুলোতে প্রাণ থেকে থাকলে তারাও যে আমাদের মত একই ভাবে অক্সিজেন গ্রহণ করে জীবনধারণ করবে, এমনটা ভাবার কিন্তু কোন যৌক্তিকতা নেই। দেখা যাবে তাদের গ্রহতে কোন অক্সিজেন নেই। রয়েছে হাইড্রোজেন, মিথেন, সালফার বা এমন অনেক জানা অজানা মৌল বা যৌগ। হয়ত এসব উপাদান ব্যবহার করেই তারা জীবনধারণ করে চলেছে। আমাদের পৃথিবীর এই কার্বন ভিত্তিক সভ্যতা কয়েক মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে। এলিয়েনদের ইকোসিস্টেম হয়ত এই কার্বনের বদলে সিলিকন বা সালফার, বা এমন কোন অজানা মৌল ভিত্তিক। যে কারণে তারা হয়ত দেখতে আমাদের চেনা জানা প্রাণ বা প্রাণীর বাহ্যিক রুপ থেকে আলাদা হতে পারে। 

আমরা চলচিত্র, সায়েন্স ফিকশন, ভিডিও গেমে এলিয়েনদের যে রূপ দেখি,আসলেই কি তারা এমন দেখতে? মোটেও ব্যাপারটি এমন নয়। যদি কোন এলিয়েন  আসলেই থেকে থাকে, তারা তো প্রকৃতপক্ষে খুবই অপরিণত জীবসত্ত্বা, অ্যামিবার মত এককোষী প্রাণীও হতে পারে? কি, পারে না? 

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের  কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী নিক্কু মধুসূদন এবং তার সহকর্মীরা নতুন শ্রেনীর হ্যাবিটেবল প্লানেটের সন্ধান পেয়েছেন। তারা ধারণা করছেন, সেখানে পৃথিবীর সাগরের মত সাগরও থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যে আমাদের পৃথিবীর পানির সাগরের মত হবে, এমনটা ভাববার কোন কারণ নেই। মধুসূদন এবং তার সহকর্মীরা পৃথিবীর বাইরের এই জগৎ এর নাম দিয়েছেন, হাইসিয়ান। হাইড্রোজেন এবং ওশান বা সমুদ্র, এই দুইটি শব্দের সমন্বয়ে এই হাইসিয়ান শব্দটির জন্ম। তারা বলেন এই জগতের রেডিয়াস পৃথিবীর প্রায় ২.৬ গুণ, যা দশ গুণ পর্যন্ত বেশি হতে পারে। এটা পূর্বের যেকোন বসবাসের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত গ্রহের তুলনায় আসলেই বেশ বড়। 

বিজ্ঞানীরা এমন অসংখ্য এক্সোপ্লানেট সম্প্রতি আবিস্কার করেছেন, যেগুলোতে প্রাণের বিস্তারের সম্ভাব্য পরিবেশ থাকতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।

বিজ্ঞানীরা এই হাইসিয়ান হ্যাবিটেবল জোন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, প্যারেন্ট স্টার বা অভিভাবক তারা থেকে এদের এই দুরত্বের কারণেই এই অঞ্চলে তরল পানি পাবার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। এই সব গ্রহে আসলেই প্রাণের অস্তিত্ব থাকবার সম্ভবনা আছে কিনা, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। তারা কি আদৌও কোন বায়োসিগনেচার দেখাতে সক্ষম? মধুসূদন এবং তার দল এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে চলেছেন। পৃথিবীতে আমরা বায়োসিগনেচার বলতে মূলত অক্সিজেন, মিথেন বা ওজোনকে বুঝি,যারা কোন না কোন ভাবে প্রাণ এবং প্রাণীর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু হাইসিয়ান জগতে এই উপাদানগুলো যে প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়, তার সাথে প্রাণের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। মূলত অজৈব প্রক্রিয়ায় এখানে এই যৌগগুলো তৈরি হয়। তাই তাদের এই হাইসিয়ান জগৎ এর জন্য বায়োসিগনেচার হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

হয়ত বিভিন্ন এক্সোপ্লানেটে এমন নতুন প্রজাতির কোন প্রাণের সম্ভাবনা রয়েছে। 

আমরা এমন একটি সর্বাধিক আলোচিত এক্সোপ্লানেট হিসেবে কে ২-১৮ বি (K 2-18b) এর কথা বলতে পারি। এটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বড়। গ্রহটি আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি লাল বামনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বর্তমানে শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহটির খুটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই কে ২-১৮ বি এবং অন্যান্য হাইসিয়ান জগৎ যদি বায়োসিগনেচারের কোন ধরনের চিহ্ন দেখায়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের ভেতরেই হয়ত মহাবিশ্বের অন্যত্র প্রথম জীবনের লক্ষণ আমরা খুঁজে পেতে পারি।

শুধু আমাদের কেন, যারা বর্হিজাগতিক প্রাণ নিয়ে গবেষণা করছেন, এই এলিয়েনের আকার, আকৃতি, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় তাদেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এই বিষয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক টাইমস এবং নিউজউইকে  ৯-১০ বার কভার স্টোরিও করেছে। এনসিয়েন্ট অ্যার্ষ্ট্রানোট থিওরিস্টরা অবশ্য এলিয়েন নিয়ে অন্য রকম ধারণা পোষণ করেন, যার পুরোটাই  তাদের মস্তিস্কপ্রসূত। বাস্তবতার সাথে তার মিল একবারে নেই বললেই চলে। এলিয়েনকে তারা আবার বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ করেন, যাদের মধ্যে গ্রে, রেপটালিয়ান প্রভূতি অন্যতম। গ্রে রা বেশ লম্বা হয়, গায়ের রং ধূসর এবং কিছুটা হিংস্র প্রকৃতির। অন্যদিকে রেপটালিয়ানদের মুখ, চোখ, গড়ন অনেকটা সরিসৃপের মত, তারা নাকি প্রয়োজন পড়লেই দ্রুত শেপ শিফটিং বা দেহের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে! আসলেই কি সেটি বাস্তবে সম্ভব ? 

শিল্পীর কল্পনায় কাল্পনিক গ্রে এলিয়েনের গ্রাফিক্যাল প্রেজেন্টেশন।

এনশিয়েন্ট অ্যার্ষ্ট্রানোট থিওরি হল এমন এক ধরনের সূডোসাইন্স বা অপবিজ্ঞান, যা এলিয়েন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে  আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে। যদিও বিষয়টা বেশ মজার, হাস্যকর তো বটেই। এই অপবিজ্ঞান বলে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই বর্হিজাগতিক সত্ত্বা বহুবার এই পৃথিবীতে এসেছে এবং তারা মানুষের সাথে নানাভাবে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এই থিওরির মতে এলিয়েন ও মানবজাতির এই সুপ্রাচীন যোগাযোগ বর্তমান সময়ের সংস্কৃতি, প্রযুক্তিতে ব্যপক প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান সময়ে এই গুলগল্পের থিওরি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যারা এই জনপ্রিয়তার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন তাদের ভেতরে এরিক ভন দানিকন,জাকারিয়া সিচিন, ডেভিড হ্যাচার চাইল্ডরস অন্যতম। তবে আবারও বলছি, এই থিউরি তার পিলে চমকানো সব তথ্যের জন্য জনপ্রিয় হলেও ব্যপারটা আগাগোড়াই কিন্তু হাস্যকর। 

এই বিতর্কিত মতবাদকে সবচেয়ে সফল ভাবে সাধারণ মানুষের  মাঝে উপস্থাপন করেন এরিক ভন দানিকেন। তিনি একজন সুইস লেখক, তার অসংখ্য বইগুলোতে তিনি তার একটাই দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, বর্হিজাগতিক এনটিটির প্রভাব মানুষর সংস্কৃতির উপর বেশ ভালোভাবেই রয়েছে। 

এনসিয়েন্ট এস্ট্রোনাট থিওরির অন্যতম রূপকার, বির্তকিত সুইস লেখক এরিক ভন দানিকেন।

প্রাথমিক জীবনে তিনি হোটেল ম্যানেজারি শুরু করেন। পরবর্তীতে হঠাৎই তার এনশিয়েন্ট অ্যার্ষ্ট্রানোট থিউরির নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু, বলিভিয়া সহ মিশর ভ্রমণ করেন, এলিয়েন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করবার জন্য। এই মতবাদের উপর ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়, তার সেই কালজয়ী সর্বাধিক বিক্রীত গ্রন্ধ, চ্যারিয়টস অফ দ্যা গড। বের হবার সাথে সাথে বইটি হটকেকের মত বিক্রি হতে শুরু করে। পৃথিবীর অনেকগুলো ভাষায় বইটির অনুবাদ হয়। তৎকালীন বাংলায় বই সেই সত্তরের দশকে লোকায়ত প্রকাশনী, কলকাতা থেকে বইটি অনুবাদ করেন শ্রী অজিত দত্ত। তিনি বইটির বাংলা নাম দেন, দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ। 

 সত্তরের দশকে প্রকাশিত এরিক ভন দানিকেনের সেই বেস্টসেলার, চ্যারিওটস অব দ্য গড। বইটি বাংলা সহ পৃথিবী অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে

বাঙ্গালী তৎকালীন পাঠক সমাজ বইটি লুফে নেয়, বইটির এলিয়েনের আবির্ভাব ও উপস্থিতি নিয়ে বির্তকিত আলোচনাগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। তার অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে রিটার্ন টু দ্যা স্টারস, গড ফ্রম আউটার স্পেস, দ্যা গোল্ড অফ গডস, ইন সার্চ অফ এনসিয়েন্ট গডস, একর্ডিং টু দ্যা ইভিডেন্স, সাইনস অফ দ্যা গড উল্লেখযোগ্য। বইগুলোর বাংলা অনুবাদ এখন বেশ দুর্লভ। সেই সত্তরের দশকের বইগুলো খুব একটা পুনর্মুদ্রণ হয় না। মাঝে মধ্যে পুরনো বইয়ের দোকানে তাদের দুই একটার সন্ধান পাওয়া যায়। আমি অনেক কষ্টে অনেক পুরনো বইয়ের দোকান ঘুরে উনার সবগুলো বই যোগাড় করতে পেরেছি। 

তবে একটা কথা এখানে না বললেই নয়। এলিয়েন নিয়ে আমার প্রথম আগ্রহ জন্ম নেয় সেই ক্লাস সিক্সে একটি বই পড়ে। পুরনো বইয়ের দোকানে তখন সেবা প্রকাশনী থেকে সেই আশির দশকে প্রকাশিত একটি পুরনো বইয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম। আমাদের শৈশবের জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ, তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান এলিয়েন নিয়ে লিখেছিলেন দারুণ একটি বই, ভীনগ্রহের মানুষ! বইটি দারুণ সব তথ্যে ঠাসা ছিল, কয়েকটি লাইন পড়ে আমার মুখ বিশ্বয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। তখনকার সেই ইন্টারনেটবিহীন, তথ্যের অপ্রতুলতার যুগে ক্লাস সিক্সের একটি বাচ্চার কাছে এমন একটি মুখরোচক বই দারুণ সব ভাবনা চিন্তার দিক উন্মোচন করবে, সেটা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, শ্রদ্ধেয় রকিব হাসান দানিকেনের সেই চ্যারিয়টস অব দ্যা গড অবলম্বনে এই বইটি লিখেছিলেন।  

সেবা প্রকাশনী থেকে আশির দশকে প্রকাশিত হয়েছিল ভীনগ্রহের মানুষ নামের দুটি বেস্টসেলার নন-ফিকশন। লেখক ছিলেন রকিব হাসান। পরবর্তীতে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বই দুটি দানিকেনের বিভিন্ন বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা

এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বির্তক কখনো দানিকেনের পিছু ছাড়েনি। তার এই এনশিয়েন্ট অ্যার্ষ্ট্রানোট থিউরি মূলধারার বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে পারেননি, সবসময় তারা এই উদ্ঘট তত্ত্বের সমালাচনা করেছেন। তারা দানিকেনের যুক্তিগুলোর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি দানিকেন নিজেও তার অনেক বক্তব্যের কোন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। আমাদের দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও নাকি দানিকেনের একটি সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে তাকে তার বইগুলোর ব্যাপারে এমন কিছু প্রশ্ন করেছিলেন, যা তাকে রীতিমতো বিব্রত করেছিল।

আমাদের এই পৃথিবী বড় বিচিত্র একটি জায়গা তাইনা? আমরা এখন পর্যন্ত কতটুকুই বা এর অব্যাখ্যাত রহস্যগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছি ? বিজ্ঞানের কাজ হল এমন সব রহস্যের সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে পাগলাটে দানিকেনের এই আজগুবি যুক্তিগুলোর দুই একটিও যদি সত্যি হয়ে যায়, আপনি কি অবাক হবেন?

সহায়ক তথ্যপঞ্জী ::::::

উইকিপিডিয়া, গুডরিডস. কম, নাসা.কম, সায়েন্টিফিক আমেরিকান,, IMDb প্রভৃতি অবলম্বনে।

লেখাটি 1,178-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 905 other subscribers