মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্ল্যাকহোল: প্রথমবারের মতো তোলা হলো ছবি

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের নিজস্ব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র, Sagittarius A* নামক অতি-ভারী (super massive) ব্ল্যাকহোলের প্রথম চিত্র উন্মোচন করেছেন। অস্পষ্ট ছবিটি ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের (EHT) সাহায্যে তোলা হয়েছে। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ হলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আটটি সিনক্রোনাইজড রেডিও টেলিস্কোপের একটি সংগ্রহ।

এটি মূলত ব্ল্যাক হোলের সাথে সম্পর্কিত রেডিও উৎসগুলি পর্যবেক্ষণ করতে পর্যবেক্ষণকারীদের একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক, যারা সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। এই প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়েছিল।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা Sgr A* এর ছবি প্রকাশ করেছেন, সূর্যের চেয়ে চার মিলিয়ন গুণ ভারী এবং পৃথিবী থেকে ২৭,০০০ আলোকবর্ষ দূরে।

এটি ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি নয়।  এর আগে একই গ্রুপ ২০১৯ সালে ৫৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে মেসিয়ার 87 (M87) গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে তোলা ব্ল্যাক হোলের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছিলো। মিল্কিওয়ে ব্ল্যাক হোল প্রায় ২৭,০০০ আলোকবর্ষ দূরে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় সকল ছায়াপথের কেন্দ্রে বিশালাকার ব্ল্যাক হোল রয়েছে। ব্ল্যাকহোল থেকে  আলো এবং পদার্থ পালাতে পারে না। তাই এদের ছবি তোলা অত্যন্ত কঠিন। মিল্কিওয়ে ব্ল্যাকহোল ধনু এবং বৃশ্চিক নক্ষত্রপুঞ্জের সীমানার কাছে অবস্থিত। একে Sagittarius A* (সংক্ষেপে Sgr A*) বলা হয়।

নতুন ছবিটি ব্ল্যাকহোলের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা বাঁকানো আলো ক্যাপচার করে। ব্ল্যাকহোলটির ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় চার মিলিয়ন গুণ বেশি।

M87 ও Sgr A* ব্ল্যাকহোলের প্রথম দুটি ছবি, পাশাপাশি।

ছবিতে অন্ধকারকে ঘিরে একটি উজ্জ্বল বলয় দেখা যায়। ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গরম গ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা আলো আমাদের কাছে উজ্জ্বল বলয় হিসাবে দেখা যাচ্ছে৷

মিল্কিওয়ে মূলত একটি সর্পিল গ্যালাক্সি যাতে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন তারা রয়েছে। উপরে বা নীচে থেকে দেখলে এটি একটি ঘূর্ণায়মান পিনহুইলের মতো। আমাদের সূর্য এখানে একটি সর্পিল বাহুতে অবস্থিত।

গবেষকরা বলেছেন যে Sgr A*-এর ছবি আগে তোলা মেসিয়ার M87 ব্ল্যাকহোলের তুলনায় আমাদের সৌরজগতের অনেক কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও ছবি তোলা কঠিন ছিল। Sgr A* এর ঘটনা-দিগন্তের ব্যাস সূর্যের প্রায় ১৭ গুণ, যার অর্থ Sgr A* সূর্যের চারপাশে বুধের কক্ষপথের সমান বড়। বিপরীতে, M87 এর ঘটনা-দিগন্তের ব্যাস আমাদের সৌরজগতের পুরোটাই জুড়ে থাকবে। Sgr A* এম-৮৭ এর ব্ল্যাক হোলের চেয়ে হাজার গুণ কম বৃহদায়তন, কিন্তু যেহেতু এটি আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সিতে রয়েছে এটি অনেক কাছাকাছি এবং আকাশে একে সামান্য বড় দেখা উচিত।

EHT জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ড. সারা ইসাউন বলেন, “প্রাপ্ত চিত্র থেকে, আমরা Sagittarius A* ছায়ার আকার পরিমাপ করতে পেরেছি যা প্রায় ৫২ মাইক্রোআর্কসেকেন্ড। এটি পৃথিবী থেকে দেখা চাঁদের পৃষ্ঠে একটি ডোনাটের আকারের প্রায়।”

তবে Sgr A*-এর ছোট শারীরিক আকারের অর্থ হল M87 এর তুলনায় Sgr A* প্রায় হাজার গুণ দ্রুত পরিবর্তিত হয়। আমাদের Sgr A* দেখার জন্য আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সির অগোছালো ডিস্কের মধ্য দিয়ে দেখতে হবে, যা চিত্রটিকে ঝাপসা এবং বিকৃত করে। ব্ল্যাক হোল টি পৃথিবীর দিকে মুখ করে রয়েছে। জেট হিসাবে ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্র থেকে কিছু বের হচ্ছে কিনা তা সনাক্ত করা অসম্ভব করে তোলে।

আটাকামা লার্জ মিলিমিটার/ সাব মিলিমিটার এ্যারে থেকে মিল্কিওয়ে এবং এর কেন্দ্রীয় ব্ল্যাক হোলের দৃশ্যমান অবস্থান।

এই গবেষণার উপাত্ত ২০১৭ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগে প্রক্রিয়াকরণ এবং পরিমার্জিত করতে এতটা  সময় নিয়েছে৷ 

Sgr A* এর চারপাশের গ্যাস মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সির তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে চলে। এর ফলস্বরূপ উজ্জ্বলতা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। যার ফলে একটি অস্পষ্ট ছবি ক্যাপচার করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে “একটি কুকুরছানা দ্রুত তার লেজ তাড়া করার একটি পরিষ্কার ছবি তোলার চেষ্টা করার” সাথে তুলনা করেছেন।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. জিরি ইউনসি, বলেছেন “আমাদের ফলাফলগুলি আজ পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ যে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি ব্ল্যাকহোল রয়েছে। এই ব্ল্যাকহোল হল সেই আঠা যা গ্যালাক্সিকে একসাথে ধরে রাখে। এটি আমাদের বোঝার চাবিকাঠি যে কীভাবে মিল্কিওয়ে তৈরি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে বিবর্তিত হবে”।

অতি ভারী ব্ল্যাকহোলের গঠনক্রিয়া। সূত্রঃ টেলিগ্রাফ

তিনি আরো বলেন “এই চিত্রটি তৈরি করা পাঁচ বছর ধরে শত শত বিজ্ঞানীদের একটি স্মৃতিময় প্রচেষ্টার ফলাফল। এটি বিশেষত চ্যালেঞ্জিং ছিল কারণ পৃথিবী এবং গ্যালাকটিক কেন্দ্রের মধ্যে তারা, ধূলিকণা এবং গ্যাসের কুয়াশা, সেইসাথে Sgr A* থেকে আলোর প্যাটার্ন কয়েক মিনিটের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। এই কাজটি ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।”

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 475-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 911 other subscribers