প্রিয় পাঠক, হ্যারি পটারের সেই বিখ্যাত জাদুর আলখাল্লার কথা মনে আছে? যা গায়ে চড়ালে সে এক নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে যেতো চোখের সামনে থেকে। বাস্তবে এমন কোন জিনিসের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত নেই। কিন্তু তারপরেও মানুষের অদৃশ্য হবার আকাঙ্ক্ষা বিন্দুমাত্র কমে নি। আমরা সকলেই জীবনের কোন এক সময়ে এসে একবারের জন্য হলেও ভেবেছি যে, কিছুটা সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে নেহাত মন্দ হতো না। হয়তো কখনও ছেলেবেলাতে বাবা মায়ের বকুনি খেয়ে অভিমান করে, না হয় কৈশোরে বন্ধুদের সাথে দস্যিপনা করার বাসনায় আমাদের অদৃশ্য হওয়ার ইচ্ছার সূত্রপাত। অবশ্য দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে বা পাওনাদারদের ফাঁকি দিতে অনেকে বড় হয়েও অদৃশ্য হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন বৈ কি!
মানুষের মনের গহীনের এই স্বপ্ন পূরণে বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই চেষ্টা করছেন। চলছে নিরন্তর গবেষণা। এরই মাঝে ২০০৬ সালে নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের কাছে থেকে আসে এক চমকপ্রদ ঘোষণা। তারা প্রথমবারের মতন একটি কার্যকরী অদৃশ্য হওয়ার যন্ত্র আবিষ্কারের দাবি করেন। প্রিয় পাঠক, আগেই লাফিয়ে উঠবেন না যেন। কারণ তাদের আবিষ্কৃত যন্ত্রটি কাজ করে শুধুমাত্র ছোট বস্তুর জন্য এবং শুধুমাত্র মাইক্রোওয়েভের বিপরীতে। অর্থাৎ, দৃশ্যমান আলোর বিপরীতে কাজ না করার কারণে আমরা কোন বস্তুকে হঠাৎ করে চোখের সামনে থেকে নাই করে ফেলতে পারবো না। বরং সেই বস্তুটিকে যদি কোন চলন্ত ওভেনের মধ্যে রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, বস্তুটি মোটেও গরম হচ্ছে না। অর্থাৎ, মাইক্রোওয়েভের প্রভাব থেকে কোন ছোট বস্তুকে সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেলতে পারবে আমাদের আলোচ্য যন্ত্রটি। হতাশ হবেন না প্রিয় পাঠক। অদৃশ্য হবার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কারটি। হয়তো এর মাধ্যমেই এক সময় খুঁজে পাওয়া যাবে সকল তরঙ্গের বিপরীতে অদৃশ্য হবার রাস্তা।
চলুন আলো বাঁকাই
অদৃশ্য হওয়া বলতে আসলে কি বোঝায়? এটা বুঝতে হলে আমরা কোন বস্তুকে কীভাবে দেখতে পাই সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার পণ্ডিতরা ধারণা করতেন যে, আমাদের চোখ থেকে আলো নির্গত হয়। সেই আলো কোন বস্তুতে গিয়ে ধাক্কা খেলে আমরা তখন সেটিকে দেখতে পাই। আজকের আধুনিক যুগে এসে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে, গ্রিকদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং সত্যটা পুরোপুরি উল্টো। কোন আলোক উৎস (যেমনঃ সূর্য) থেকে নির্গত হওয়া আলো এসে কোন বস্তুর উপরে পড়ার পর তিনটি ঘটনা ঘটতে পারে। কিছু পরিমাণ আলো বস্তু কর্তৃক শোষিত হয়, কিছু আলো প্রতিসারিত হয় এবং বাকি অংশ হয় প্রতিফলিত। এই প্রতিফলিত হওয়া আলোক রশ্মি যদি আমাদের চোখে প্রবেশ করে, তাহলেই আমরা সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই।
তো প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন যে, যদি আমরা কোন বস্তুকে অদৃশ্য করতে চাই, তাহলে অবশ্যই সেটিকে আলোর সংস্পর্শে আসতে দেয়া যাবে না। তাই অদৃশ্যকারক যন্ত্রের এমন সামর্থ্য থাকতে হবে যেন তা আলোকে বিশেষভাবে বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। অর্থাৎ, যে বস্তুকে অদৃশ্য করতে হবে সেটির দিকে আসা আলোর গতিপথকে এমনভাবে বাঁকিয়ে ফেলা হবে যেন বস্তুটির একপাশ দিয়ে আসা আলো ঘুরে অন্য পাশে দিয়ে চলে যায়। অনেকটা নিচের ছবির মতন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/05/image-3.png?resize=536%2C213&ssl=1)
প্রতিসরণেই সমাধান?
প্রিয় পাঠক, আলোর বেঁকে যাওয়া কিন্তু মোটেও অদ্ভুতুড়ে বা ব্যতিক্রমী কোন ঘটনা নয়। বরং আমরা চারপাশে আলোর বেঁকে যাওয়ার অনেক প্রাকৃতিক উদাহরণ অহরহ দেখতে পাই। অবশ্য সেগুলো আলোর প্রতিসরণ নামেই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। যখন আলো মাধ্যমে পরিবর্তন করে তখনই ঘটে প্রতিসরণ। যদি আলো হালকা বা কম ঘন মাধ্যম থেকে অন্য ঘন মাধ্যমের দিকে যায়, তাহলে আলো অভিলম্বের দিকে বেঁকে যায়। অন্যদিকে, ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমের দিকে আলো গেলে ঘটে উল্টো ঘটনা। অর্থাৎ, আলো দিক পরিবর্তন করে অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়। আলোর প্রতিসরণের কারণে খালি হাতে মাছ ধরা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। কারণ খালি চোখে পানির ভেতরে মাছকে যেখানে দেখতে পাওয়া যায়, মাছের প্রকৃত অবস্থান আসলে সেখানে নয়। খানিকটা দূরে। মাধ্যম পরিবর্তনের ফলে আলোর বেঁকে যাওয়ার দরুন এমনটা হয়। যাই হোক, আমরা কি মাছটিকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করতে আলোর এই মূলনীতি ব্যবহার করতে পারি?
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/05/image-4.png?resize=596%2C335&ssl=1)
আলো কোন মাধ্যমে কতটুকু বেঁকে যাবে সেটি মূলত নির্ভর করে সেই মাধ্যমের প্রতিসরণাঙ্কের উপরে। শূন্য মাধ্যমের প্রতিসরণাঙ্কের মান ১। বাতাসের প্রতিসরণাঙ্কের মান শূন্য মাধ্যমের চেয়ে খুব সামান্য পরিমাণ বেশি। তাই হিসাবের সুবিধার জন্য এর মানও এক ধরে নেয়া হয়। পানির প্রতিসরণাঙ্কের মান ১.৩৩, কাঁচের ১.৫ ইত্যাদি। যে মাধ্যমের প্রতিসরণাঙ্কের মান যত বেশি, সে মাধ্যমে আলোর বক্রতার মান তত বেশি। পৃথিবীর মোটামুটি সকল স্বাভাবিক বস্তুর প্রতিসরণাঙ্কের মান ১ এর চেয়ে বেশি। কিন্তু আমরা যদি আলোর প্রতিসরণ ব্যবহার করে কোন বস্তুকে অদৃশ্য করতে চাই, তাহলে আমাদের এমন বিশেষ বস্তু খুঁজে বের করতে হবে, যার প্রতিসরণাঙ্কের মান বিশেষ ক্ষেত্রে নিদেনপক্ষে ১ এর চেয়ে কম। এমনকি শূন্যের চেয়েও কম, অর্থাৎ, ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্ক।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/05/image-5.png?resize=541%2C498&ssl=1)
একের চেয়ে কম অথবা ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্ক বিশিষ্ট পদার্থের বেশ অদ্ভুত ধরণের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকার কথা। যেমনঃ যদি প্রতিসরণাঙ্কের মান শূন্য থেকে এক এর মধ্যে হয়, তাহলে আলো যে শুধুমাত্র বেঁকে যাবে তা নয়। বরং সেটি সর্বজন স্বীকৃত গতিবেগের সীমার (প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার) চেয়েও বেশি বেগে চলবে। আর যে সব পদার্থের প্রতিসরণাঙ্কের মান ঋণাত্মক হবে, সেগুলোতে আলো চলবে উল্টো দিকে! এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে কোন বস্তুকে কি আসলেই অদৃশ্য করা সম্ভব হবে?
মেটা-ম্যাটেরিয়াল
শুনতে অসম্ভব মনে হলেও ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এক ধরণের পদার্থ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যাদের প্রতিসরণাঙ্কের মান শূন্য থেকে এক এর মধ্যে। আর তারা সেটি করেছেন সর্বোচ্চ গতিসীমা মেনেই। কিভাবে তারা এই অসাধ্য সাধন করলেন? আসলে কোন বস্তু কেমন আলোকীয় বৈশিষ্ট্য (Optical property) প্রদর্শন করবে, সেটি শুধুমাত্র এর পরমাণুর ধরণের (Chemistry) উপরে নির্ভর করে না। পরমাণুর সজ্জার (Structure) উপরেও নির্ভর করে। ঠিক এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা একটি রিং তৈরি করেন যা কিনা ছোট ছোট কপারের টুকরার কাঠামোর সমন্বয়ে গঠিত। যখন নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বা কম্পাঙ্কের তরঙ্গ (আলোসহ যে কোন তড়িতচৌম্বক বিকিরণ) সেই কাঠামোতে আঘাত করবে তখন কাঠামো থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বিকিরিত হতে থাকে। অনেকটা অ্যান্টেনার মতন। প্রচুর সংখ্যক বিকিরণ উৎপন্ন হয় এদের মাধ্যমে। উৎপন্ন বিকিরণগুলোর মধ্যে ক্রমাগত ধ্বংসাত্মক এবং গঠনমূলক ব্যতিচার সংঘটিত হবে। যার ফলাফলস্বরূপ মূল তরঙ্গের দিক পরিবর্তিত হবে। এমনভাবে এই ঘটনা ঘটে যেন মনে হয় যে প্রতিসরণাঙ্কের মান এক এর নিচে নেমে গিয়েছে। যেই বিশেষ ধরণের পদার্থের এমন ঘটনা ঘটে, তাদের নাম দেয়া হয়েছে মেটাম্যাটেরিয়্যাল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/05/image-6.png?resize=581%2C365&ssl=1)
তড়িতচৌম্বক তরঙ্গের ব্যতিচার পুরোপুরি নির্ভর করে এদের কম্পাঙ্কের উপরে। এই কারণে উপরে বর্নিত নীতিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা ক্লোকিং ডিভাইস বিশেষ কয়েকটি কম্পাঙ্কের তরঙ্গের জন্য কাজ করে। ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সফলভাবে মাইক্রোওয়েভের জন্য একে ব্যবহার করতে পেরেছেন। মাইক্রোওয়েভকে যদি উপরে দেখানো রিঙের দিকে সঞ্চালিত করা হয়, তাহলে সেটি এমনভাবে একপাশে দিয়ে প্রবেশ করে রিঙের অন্য পাশে চলে যাবে যে মনে হবে সেখানে কোন রিঙের অস্তিত্বই নেই। রিঙের কেন্দ্রের কাছের ফাঁকা জায়গাতে যদি ছোট কোন বস্তু রাখা হয়, তাহলে সেটি মাইক্রোওয়েভের বিপরীতে সম্পূর্ণ লুকায়িত অবস্থায় থাকবে। সোজা বাংলায় অদৃশ্য হয়ে যাবে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/05/image-7.png?resize=553%2C417&ssl=1)
প্রিয় পাঠক, বলুন তো, এই মূলনীতি কি অন্যান্য সাধারন তরঙ্গের বেলায় প্রয়োগ করা যাবে? অবশ্যই যাবে। মাত্র কয়েক বছর আগে ডিউক ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক একটি যন্ত্র তৈরি করেন যা কিনা কোন বস্তুকে শব্দ তরঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখতে পারে। অর্থাৎ, এই যন্ত্র ব্যবহার করে কেউ যদি কোন আলখাল্লা বানিয়ে তার ভেতর ঢুকে বসে থাকে, তাহলে তিনি বাইরের কোন শব্দ শুনতে পাবেন না। শব্দ তরঙ্গ তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। এভাবে করে রাডারকে খুব সহজেই ফাঁকি দেয়া সম্ভব।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/05/image-8.png?resize=590%2C393&ssl=1)
বিগত কয়েক দশকে অদৃশ্য হওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার পালে ব্যাপক হাওয়া লেগেছে। যার মূলে রয়েছে মেটা-ম্যাটেরিয়ালের আবিষ্কার। হয়তো খুব শীঘ্রই আমরা পরিপূর্ণ ক্লোকিং ডিভাইস পেতে যাচ্ছি। জার্মানির বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে এমন এক ধরণের মেটা-ম্যাটেরিয়্যাল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যা কিনা দৃশ্যমান আলোর জন্য ঋণাত্মক প্রতিসরণাঙ্ক বিশিষ্ট। তাই হ্যারি পটারের জাদুর আলখাল্লার মতন ক্লোকিং ডিভাইস হয়তো আর খুব বেশি দূরে নেই।
তথ্যসুত্র:
Leave a Reply