রক্ত আমাদের শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি এক ধরণের ক্ষারীয়, ঈষৎ লবণাক্ত ও লাল বর্ণের তরল যোজক টিস্যু। মানুষের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। এই যেমন ধরুন আপনার যেকোন একজন আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার বললেন রোগীকে বাঁচাতে হলে রক্তের প্রয়োজন। রোগীর রক্তের গ্রুপ অমুক। এখন রক্ত নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু রক্তের প্রয়োজন হলেই কি যে কেউ রক্ত দিতে পারে? অবশ্যই না। বরং তার জন্য রক্তের গ্রুপের মিল থাকতে হয়। গ্রহীতার রক্তের গ্রুপের সাথে মিল থাকতে হয় দাতার রক্তের গ্রুপের।
কখনো কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলেই ছোটাছুটি করতে দেখা যায় তাদের পরিবার কিংবা আত্মীয় স্বজনদের অনেককে। তখন কিন্তু রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করে উপযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ কিংবা উপযুক্ত ব্যক্তিকে রক্ত প্রদান করা দরকার। তাই চলুন জেনে আসি সে সম্পর্কে। প্রথমেই আমাদের জেনে নিতে হবে অ্যান্টিজেন কি। এটি হল এক ধরণের অণু যা লোহিত রক্তকণিকায় থাকে। আর অ্যান্টিবডি হল এক ধরণের ইমিউন সিস্টেমের প্রোটিন উপাদান যা রক্তে সঞ্চালিত হয়। এ উপাদানটি রক্তরসে থাকে।
এই অ্যান্টিজেন আর অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানুষের রক্তকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা যায়। যেমন : গ্রুপ A, গ্রুপ B, গ্রুপ AB, গ্রুপ O। কার্ল লেন্ডেস্টেইনার সর্বপ্রথম রক্তের এমন গ্রুপিং করেন।
ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি আছে। যেমন-
গ্রুপ A : এ শ্রেণির রক্তে A অ্যান্টিজেন ও b অ্যান্টিবডি থাকে।
গ্রুপ B : এ শ্রেণির রক্তে B অ্যান্টিজেন ও a অ্যান্টিবডি থাকে।
গ্রুপ AB : এ শ্রেণির রক্তে A ও B অ্যান্টিজেন থাকে কিন্তু কোনো অ্যান্টিবডি থাকে না।
গ্রুপ O : এ শ্রেণির রক্তে কোনো অ্যান্টিজেন থাকে না কিন্তু a ও b অ্যান্টিবডি থাকে।
রক্তের রেসার্স ফ্যাক্টর :
পূর্বোক্ত আলোচনার পর পর অনেকে হয়তো বলবে, শুধু গ্রুপ না মিললেই বুঝি রক্ত দেওয়া যাবে না। কিন্তু এটি সঠিক নয়। বরং রেসার্স ফ্যাক্টরও মিলতে হবে। এখন অনেকেই হয়ত বলবেন যে, এই রেসার্স ফ্যাক্টর আবার কি? আসলে রেসার্স ফ্যাক্টর (সংক্ষেপে আর.এইচ ফ্যাক্টর) হল এক ধরণের প্রোটিন যা লোহিত রক্তকণিকা কোষের পৃষ্ঠে পাওয়া যায়। অর্থাৎ আপনার শরীরে এই প্রোটিন থাকলে আপনি আর.এইচ পজিটিভ (+) আর না থাকলে আপনি আর.এইচ নেগেটিভ (-) । ১৯৪০ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার এবং উইনার সর্বপ্রথম এই ফ্যাক্টর লক্ষ করেন। রেসার্স ফ্যাক্টর না মিললেও অসুবিধায় পড়তে হয় রোগীদের। আর তাইতো এর প্রয়োজনীয়তা অনেক।
এখন রেসার্স ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নিলে তো আমাদের কাজ আরো বেড়ে গেল। গ্রুপগুলো তো দ্বিগুণ হয়ে গেল, তাই না?
(O-), (O+), (B+), (B-), (A+), (A-), (AB+), (AB-)
রক্তদান কিংবা গ্রহণের ক্ষেত্রে যা জানা জরুরি:
কে কোন গ্রুপকে রক্ত দিতে পারবে এবার সে আলোচনায় আসা যাক। এক্ষেত্রে আমি ৪টি নিয়মের কথা বলব যা রক্ত দিতে বা রক্ত নিতে গেলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। যেমন :
১. কথায় বলে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। অর্থাৎ আগে নিজেকে বাঁচাই তারপর অন্যদের। রক্তের গ্রুপের ক্ষেত্রেও একই কথা। নিজের গ্রুপের রক্ত নিজেদের গ্রুপের অন্তর্গত যেকোন রোগীকে দেওয়া যাবে। অর্থাৎ একই রক্তের গ্রুপভুক্ত তাদের সমজাতীয়দের বাঁচাতে রক্ত দিতে পারবে। সে হিসেবে (A+) এর রক্ত (A+) কে দেওয়া যাবে। একইভাবে (B-) এর রক্ত (B-) কেও দেয়া যাবে। আবার (B-) একই গ্রুপ হতে রক্ত নিতে পারবে।
২. রেসার্স ফ্যাক্টরবিহীন গ্রুপ রেসার্স ফ্যাক্টরযুক্ত গ্রুপকে দেয়া যাবে কিন্তু ফ্যাক্টরযুক্ত রক্ত ফ্যাক্টরবিহীন গ্রুপের কাউকে দেয়া যাবে না। অর্থাৎ (B-) এর রক্ত (B+) কে দেওয়া যাবে। কিন্তু (A+ ) এর রক্ত কে (A-) দেওয়া যাবে না।
৩. O কে বলা যায় রক্তের গ্রুপের হাজী মোহাম্মদ মহসীন। অর্থাৎ O সবাইকে দিতে পারে। আবার আমরা জেনেছি যে, রেসার্স ফ্যাক্টরবিহীন গ্রুপের রক্ত সবাইকে দেয়া যাবে। তাহলে কথা কি দাঁড়ালো : (O-) হলো এদের মধ্যে সেরা দাতা। মানে (O-) (O-), (O+), (B+), (B-), (A+), (A-), (AB+), (AB-) এদর সবাইকে রক্ত দিতে পারবে। কিন্তু (O+) শুধুমাত্র (O+), (A+), (B+), (AB+) এদের রক্ত দিতে পারবে।
৪. AB গ্রুপবিশিষ্ট ব্যক্তি কাওকেই রক্ত দান করতে পারে না। অর্থাৎ সবার কাছ থেকে গ্রহণ করে। এ গ্রুপকে আমরা স্বার্থপর গ্রুপ বলতে পারি। আর এই ক্ষেত্রেও কিন্তু রেসার্স ফ্যাক্টরকে ভুললে চলবে না! আমরা জেনেছি যে, পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নেগেটিভ থেকেও নেয়া যাবে আবার পজিটিভ থেকে তো নেওয়া যাবেই। কিন্তু নেগেটিভ গ্রুপের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেওয়া যাবে না। আবার (AB+) যেহেতু সবার থেকেই নিতে পছন্দ করে। তাই (AB+) সবার কাছ থেকে নিতে পারবে যা (AB-) পারবে না।
নিচের ছবিটা আরো ভাল করে দেখলে বুঝতে পারবেনঃ
আশা করি, এরপর থেকে আপনাদের রক্তের গ্রুপ মনে রাখার ক্ষেত্রে আর কোন ধরণের সমস্যায় পড়তে হবে না। সবসময় উপরোক্ত ৪টি নিয়ম মনে রাখবেন এবং সে অনুসারে রক্ত দেওয়া-নেওয়া করবেন। হয়তো দেখা গেল কোন এক সময় দুর্ঘটনায় পড়া আপনার কোন এক বন্ধুর মা-বাবা বা আত্মীয় স্বজনের রক্তের দরকার হল তখন আপনি তাদের পাশে দাঁড়ালেন এবং রক্তের গ্রুপিং এর ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। এভাবে কিন্তু আপনি মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন।
তথ্যসুত্রঃ
Leave a Reply