ওরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলে হর্সহেড নেবুলা এবং ফ্লেম নেবুলা হল অপেশাদার পর্যবেক্ষকদের প্রিয় টেলিস্কোপিক লক্ষ্য।
মহাকাশে বিভিন্ন আকৃতির নীহারিকা আছে। এরকম একটি নীহারিকা হলো অশ্বশির। দেখতে অনেকটা ঘোড়ার মাথার মত, যার কারনে এই নামকরণ। এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত যতগুলো নীহারিকা আছে তার মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। হর্সহেড নেবুলা হল সবচেয়ে আইকনিক গভীর-আকাশের বস্তুগুলির মধ্যে একটি।
এই নীহারিকাটি প্রথম কে আবিস্কার করেছিলেন তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে।
২৭ শে জুলাই, ১৯১৩-এর রাতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ই.ই.বার্নার্ড খেয়াল করলেন করলেন যে দক্ষিণ উইসকনসিনের ইয়ার্কস অবজারভেটরির উপরে আকাশ স্ফটিক স্বচ্ছ এবং বায়ু স্থির — রাতের আকাশ দেখার জন্য একটি নিখুঁত দিন।
তিনি সাথে সাথে বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিসরণ দূরবীনকে কালপুরুষ নক্ষত্রমন্ডলের দিকে তাক করেন। সেখানে তিনি কয়েক দশক আগে তার ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের সময় একটা রহস্যময় বস্তুর আভাস লক্ষ্য করেছিলেন। তখন থেকেই বহুবার এই বস্তুটির ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চাচ্ছিলেন তিনি।
অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পূর্বে এলাকাটির ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু বস্তুটির অস্পষ্ট প্রকৃতি – এবং আদৌ সেখানে কিছুর অস্তিত্ব আছে কি না নিয়ে বিতর্ক লেগেই ছিলো। সে রাতে তিনি লক্ষ্য করেন একটি কালো অন্ধকার আকৃতি উজ্জ্বল পটভূমির আকাশের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। বস্তুটি দেখতে ধুলোময় কিন্তু রাতের আকাশের চেয়ে খুব কম উজ্জ্বল। “এই বস্তুটি তার প্রাপ্য মনোযোগ পায়নি” বার্নার্ড পরে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি মহাকাশীয় বস্তুর একটি ছবিও ধারণ করতে পেরেছিলেন, যা আজও মহাকাশ ভক্তদের কাছে স্বীকৃত।
হর্সহেড নেবুলা, বার্নার্ড 33 নামেও পরিচিত। এর সঙ্গী, ফ্লেইম নেবুলা, ওরিয়ন (কালপুরুষ) তারামন্ডলীর কোমরের তিনটি নক্ষত্রের বাম দিকের নক্ষত্র আলনিতাক (Alnitak) এর পূর্বে অবস্থিত। এটি আলনিতাকের এত কাছাকাছি যে আলনিকাতের উপস্থিতি এটিকে দেখতে কঠিন করে তোলে।
পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ১৩,০০ আলোক বর্ষ (৪০০ পারসেক)। নীহারিকাটির ব্যাস ১৩ আলোকবর্ষ (৪ পারসেক) এবং মোট ভর প্রায় ২৫০ সৌর ভর।
হর্সহেড হল নীহারিকার একটি অন্ধকার অঞ্চল। এটি একটি আয়নিত-হাইড্রোজেন অঞ্চল। ধুলো আয়নিত মেঘের অংশ থেকে আলো শোষণ করে। এই কালো মেঘের একটি অংশের আকৃতি কিছুটা ঘোড়ার মাথার মতো।
এই অন্ধকার মেঘের স্বাক্ষর আকৃতিটি কেবল দৃশ্যমান। কারণ এর আকৃতিটি এর পিছনের উজ্জ্বল নীহারিকা থেকে আলোকে অস্পষ্ট করে। ঘোড়ার চোয়াল বিশিষ্ট আকারটি কাছাকাছি একটি নক্ষত্রের তীব্র বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট।
হর্সহেড নেবুলা হল ওরিয়ন মলিকুলার ক্লাউড কমপ্লেক্সের একটি অংশ মাত্র। এই নক্ষত্র গঠনকারী অঞ্চলটি শত শত আলোকবর্ষ জুড়ে বিস্তৃত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে এই নাক্ষত্রিক নার্সারি ইতিমধ্যেই তরুণ নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছে। এর চারিত্রিক আকৃতি এবং উজ্জ্বল গোলাপী রং হর্সহেড নেবুলাকে বহু বছর ধরে একটি লোভনীয় টেলিস্কোপিক লক্ষ্যে পরিণত করেছে।
কিন্তু এর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, এর গ্যাসীয় মেঘ আসলে খুব ক্ষীণ। এটি মাত্র ৬.৮ মাত্রায় জ্বলে। কিন্তু যেহেতু হর্সহেড নীহারিকা সনাক্ত করা খুব কঠিন, অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের পর্যবেক্ষণ দক্ষতার জন্য এটি ব্যবহার করেন। এই কারণেই যখন আংশিকভাবে এই গ্যাসীয় মেঘটি প্রথম দেখা গিয়েছিল, তখন এর বিখ্যাত আকৃতিটিও লক্ষ্য করা যায়নি।
কিভাবে হর্সহেড নেবুলা আবিষ্কৃত হয়েছিল
হর্সহেড নীহারিকা আবিষ্কারের গল্পটি আশ্চর্যজনকভাবে ঘোলাটে। বিশেষ করে এমন একটি বস্তুর জন্য যা আজ এত বিখ্যাত। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী বছরের পর বছর ধরে এটিতে হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু তাদের সীমিত যন্ত্রের কারণে বিস্তারিত গবেষণা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল (ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কারক) টেলিস্কোপের মাধ্যমে হর্সহেড নেবুলা প্রথম দেখেছিলেন। হার্শেল একজন দক্ষ পর্যবেক্ষক ছিলেন এবং ১৮১১ সালে, তিনি একটি জার্নালে “দ্য কনস্ট্রাকশন অফ দ্য হেভেনস” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র জমা দেন।
এই লেখার একটি অংশে তিনি ৫২টি বিভিন্ন আবছায়া বস্তু শনাক্ত করেছিলেন। যেগুলি তিনি তার সারাজীবনে রাতের আকাশে দেখেছেন। তিনি উল্লেখ করেন: “এগুলি কেবল তখনই দেখা যায় যখন অন্ধকার এবং পুরোপুরি পরিষ্কার থাকে।”
সেই সময়েই ওয়েলশের অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী আইজ্যাক রবার্টস হার্শেলের উল্লেখ করা ৫২টি বস্তুর ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নেন। কাজটি সম্পূর্ণ করতে তার ছয় বছর সময় লেগেছিল এবং ১৯০২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে রবার্টস হার্শেলের উল্লেখিত বস্তুগুলির অস্তিত্বের উপর একটি দীর্ঘ সমালোচনা উপস্থাপন করেছিলেন।
যদিও কয়েকটি বস্তু ছিল যা স্পষ্টভাবে উপস্থিত ছিলো। এর মধ্যে একটি ছিল হর্সহেড নেবুলা যা রবার্টস একটি ফটোগ্রাফে ক্যাপচার করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তিনি এটিকে নিছক “নিবুলোসিটির একটি প্রবাহ” হিসাবে খারিজ করে দিয়েছিলেন।
এদিকে অন্য একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই তার ক্রমবর্ধমান ক্যাটালগে বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন। উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং এখন থেকে এক শতাব্দীরও বেশি আগে হার্ভার্ড কলেজ অবজারভেটরির একজন কর্মী ছিলেন। স্কটিশ জ্যোতির্বিদ অবজারভেটরির পরিচালক এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিং-এর বাড়িতে দাসী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন।।
কিন্তু তাকে শীঘ্রই নক্ষত্রের রাসায়নিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট – তারার বর্ণালী বিশ্লেষণ করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। ফ্লেমিং-এর নক্ষত্রের শ্রেণিবিন্যাসের পদ্ধতি এতটাই জনপ্রিয় যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আজও ব্যবহার করছেন। তার পুরো কর্মজীবন জুড়ে ফ্লেমিং হাজার হাজার বস্তু তালিকাভুক্ত করেছেন। তার মধ্যে একটি ছিল হর্সহেড নেবুলা। ১৮৮৮ সালে তিনি পিকারিংয়ের ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলির একটি পর্যালোচনা করছিলেন। তখন তিনি বস্তুটি দেখতে পান। ফ্লেমিং এখন হর্সহেড নেবুলার প্রথম নিশ্চিত আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব পান।
কিন্তু এটি আরেকটি প্রশ্ন রেখে যায়: কে হর্সহেড নেবুলা নাম দিয়েছে?
এই বিষয়ে ঐতিহাসিক রেকর্ড অস্পষ্ট। এটা হার্শেল বা ফ্লেমিং ছিল না। রবার্টস তার ১৯০২ সালে ফলো-আপ গবেষণায় এই শব্দটি ব্যবহার করেন নি। এবং বার্নার্ড তার কাগজপত্রেও এর সমতুল্যতা লক্ষ্য করেননি বলে মনে হয়।
এমনকি প্রারম্ভিক জনপ্রিয় রেফারেন্সগুলি এটিকে কী বলা উচিত তা নিয়ে একমত বলে মনে হয় না। ১৯২২ সালে, তরুণদের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা নামে একটি বই এটিকে “ডার্ক হর্স নেবুলা” হিসাবে উল্লেখ করেছে।
কিন্তু আরও পরিচিত “হর্সহেড নেবুলা” ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে প্রচলিত ভাষা ছিল। যাইহোক, পরবর্তীতে শব্দটি আধিপত্য বিস্তার করে। কারণ আরও বেশি সংখ্যক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর বিস্তারিত ফটোগ্রাফ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই অন্ধকার নীহারিকাগুলো নক্ষত্রের অভাবের জন্য হয় না বরং অধিকতর অগ্রবর্তী নক্ষত্রের অন্ধকারময় বস্তুপুঞ্জের ফল এই নীহারিকা (মহাকাশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বিশাল হাইড্রোজেন গ্যাস ও ধূলিকণার স্তর)। এই নিহারীকা গুলো সব সময় একই রকম অন্ধকার থাকে না। মাঝে মাঝে এদের কমবেশী অন্ধকার দেখায়। অন্ধকার নীহারিকা গ্যাস ও ধূলিকণা দিয়ে পরিপূর্ন এলাকা; এই গ্যাস ও ধূলিকণা পরস্পর উচ্চ ঘনত্বে সম্পর্কযূক্ত।
আমাদের ছায়াপথের বেশীর ভাগ জায়গা জুড়ে এই ধূলিকনা ছড়িয়ে আছে। এই ধূলিকনা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণে বাধার সৃষ্টি করে। এই ধূলিকনা দুরবর্তী নক্ষত্র থেকে আগত আলোর অনেকটা শোষণ করে নেয় যার ফলে নক্ষত্রদের অনুজ্জল ও নিস্তেজ লাগে। আমাদের ছায়াপথের উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় সর্বত্র এই এই অন্ধকার নীহারিকা দেখা যায়।
তথ্যসুত্রঃ
Leave a Reply