জীববিজ্ঞানের ওপর তেমন কোনো বই বাংলা ভাষায় সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু যখনি এমন কোনো বইয়ের আওয়াজ পাই, তখনি ঐ বই সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। সেই প্রবণতার কারণেই সৌমিত্র চক্রবর্তী স্যারের “জীবনের গল্পঃ দ্বিতীয় খণ্ড” বইটা সংগ্রহ করি। আগে প্রথম খণ্ডটা পড়েছিলাম বলে এবার এটা পড়ার সিন্ধান্ত নিলাম।
বইয়ের ব্যবচ্ছেদ
“জীবনের গল্পঃ দ্বিতীয় খণ্ড” মূলত একটি সংকলনমূলক বই, যেখানে ১৬টি প্রবন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি সৌমিত্র স্যারের নিজের এবং বাকি ১০ টি কিছু বাঘা বাঘা লেখকদের লেখনী।
প্রথমে সৌমিত্র স্যারের ৬ টা প্রবন্ধ নিয়েই কথা বলি।বইয়ের শুরুতেই রয়েছে ডেভিড ওয়েসনারের লেখা The Origins Of Viruses প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ। ভাইরাস জীব নাকি জড়, ভাইরাস কীভাবে সৃষ্টি হলো ইত্যাদি বিষয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরপরের প্রবন্ধটি ছিল M.W. Strickberger এর লেখা Evolution বইয়ের কিছু অংশের অনুবাদ ,যার নামকরণ করা হয়েছে “সম্ভাব্যতার কাঠগড়ায় প্রাকৃতিক নির্বাচন।” খুবই সহজ ভাষার এই প্রবন্ধে প্রাকৃতিক নির্বাচনের গাণিতিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
পরবর্তী প্রবন্ধটি সায়ামিজ টুইন নিয়ে। বাংলাদেশের একডিম্বক যমজ কৃষ্ণা-তৃষ্ণার মাথা পৃথক করার গল্প নিয়েই এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এরপরের প্রবন্ধটা আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। হোমিওপ্যাথির ধাপ্পাবাজি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সৌমিত্র স্যার খুবই চমৎকার ভাষায় মজার গল্প করেছেন। সচেতন নাগরিক হিসেবে সকলের ঐ ব্যাপারগুলো জানা উচিৎ। এরপরে পেয়েছিলাম কৃত্রিম প্রাণের গল্প। বিজ্ঞানীরা Mycoplasma mycoides এর সম্পূর্ণ ডিএনএ ক্রস বের করলেন। এরপর সেগুলোর কৃত্রিম কপি তৈরি করে সেগুলোকে ইস্টের কোষে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর ইস্ট অনেকগুলো টুকরোকে বেঁধে একটা লম্বা ডিএনএ বানিয়ে দিল। এরপর সেটাকে নানা পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে ব্যাকটেরিয়ার দেহে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো এবং ঐসব ব্যাকটেরিয়াকে বাধাহীন ভাবে বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ প্রদান করা হলো। এই ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমেই সৃষ্টি হলো নতুন প্রাণ। পুরোটাই অসাধারণ ছিল!
বইটিতে সৌমিত্র স্যারের লেখা আরেকটি প্রবন্ধ ছিল। সেটা হলো মৃত্যুর উৎপত্তি, যা মূলত জর্জ ওয়াল্ডের লেখা একটি প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ। এখানে বিভিন্ন ধরণের জীবদের প্রজননের কথা বলা হয়েছে। এর সাথে আরও বলা হয়েছে কীভাবে প্রজনন মৃত্যুকে ডেকে আনে। মূলত সৌমিত্র স্যারের নিজের লেখা এই ৬টি প্রবন্ধই বইটায় স্থান পেয়েছে।
এছাড়াও বইটিতে আরও দশটি প্রবন্ধ ছিল। প্রবন্ধগুলো রক্ত সঞ্চালন, ন্যানোচিকিৎসা, উদ্ভিদবিদ্যা, বিজ্ঞান-বিজ্ঞানী, কোষ-টিস্যু, ভাষাবিজ্ঞান ও রিফ্লেক্স, স্মৃতি এবং পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে ছিল। প্রবন্ধগুলোর লেখক ছিলেন ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, জগদীশচন্দ্র বসু, আবদুল্লাহ আল মুতী, দ্বিজেন শর্মা এবং ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মতো ওস্তাদেরা।
জানতে পারলাম
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার দুনিয়ায় যারা আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, তাদের কয়েক জনের প্রবন্ধ এই বইটিতে স্থান পেয়েছে। যে কেউই এই বইটা পড়ে কিছু না কিছু শিখবে। আমার শেখা কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করছি।
১. হোমিওপ্যাথির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই কেন?
২. ন্যানোচিকিৎসা যেভাবে বিজ্ঞনের দুনিয়াকে বদলে দিতে পারে।
৩. গেম থিওরি কীভাবে বিবর্তনকে প্রভাবিত করে?
৪. আমাদের মুখ নিঃসৃত ভাষা যেভাবে গঠিত হয়।
৫. স্মৃতি কীভাবে গড়ে ওঠে?
৬. স্মৃতি সংরক্ষণে আরএনএ এর ভূমিকা
৭. কিছু কিছু প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রজননই তাদের জীবনের অন্তিম কাজ কেন?
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, এই বইটা আমাকে অনেক অজানা জিনিস জানিয়েছে, বুঝিয়েছে।
মতামত ও সমালোচনা
ইতিমধ্যেই বলেছি যে বইটা অসাধারণ। শিক্ষার্থীদের জন্য তো বটেই, লেখকদের জন্যও বইটা বেশ সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। কোনো বিজ্ঞানপ্রেমী পাঠক যদি এই বইটা মনোযোগ সহকারে জানার আকাঙ্খা নিয়ে পড়েন, তবে নিঃসন্দেহে তার চিন্তার পরিধি বৃদ্ধি পাবে।
আমি বুক রিভিউতে প্রায়ই সমালোচনা করে থাকি। সেই ধারায় এই বইটা সম্পর্কেও কিছু কথা বলতে হয়। কথায় আছে, “আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী”। একারেণে বইটার প্রচ্ছদটা আরও সুন্দর করা উচিৎছিল। হয়ত বা অন্যদের কাছে ভালো লেগেছে, আমার চোখেই অন্যরকম লাগছে! দ্বিতীয়ত বইটার মূল লেখক যেহেতু ওস্তাদ মানুষ, তাই বইটার সবগুলো প্রবন্ধই যদি ওনার হতো, তাহলে বোধ হয় বইয়ের গাম্ভীর্য ও মাধুর্য দুটোই বৃদ্ধি পেতো, হয়ত!
বইয়ের বিষয়বস্তুগুলো কিন্তু ভালোই ছিল। তো, দেরি কীসের? বইটি সংগ্রহ করে পড়া শুরু করুন। একজন পাঠক হিসেবে আমার মতো আপনিও বইটি পড়ে উপকৃ্ত হবেন! Happy Reading!
Leave a Reply