ড্রেক সমীকরণ হলো বিজ্ঞানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম। E=mc2 যেমন বিখ্যাত ড্রেক সমীকরণও তেমন বিখ্যাত সমীকরণ। প্রায় সব জ্যোতির্বিজ্ঞান বইয়েই মহাকাশে কোনো অন্যগ্রহের প্রাণী নিয়ে কথা হলেই ড্রেক সমীকরণ আসতে বাধ্য। সেই বিখ্যাত ড্রেক সমীকেরণের জনক ফ্রাঙ্ক ডেক গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ।
ফ্রাঙ্ক ড্রেক আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৯৩০ সালের ২৮শে মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার আর মা ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে কঠোর শাসনে মানুষ হন ড্রেক, কারণ তার পিতা মাতা ছিলেন ব্যাপিস্ট খ্রিস্টান। মহাবিশ্বে অন্যগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব বিষয়ে প্রশ্ন তার মাঝে প্রথম জন্ম নেয় যখন তার বাবা তাকে প্রথম বলে আমাদের গ্রহই মহাবিশ্বে একমাত্র গ্রহ না। তার এই চিন্তাটায় আরো আগুন জ্বলে উঠে যখন তিনি প্রথম তার চার্চের পাশে অবস্থিত বিজ্ঞান ও শিল্প জাদুঘর দেখতে যান।
ড্রেক কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে প্রকৌশল পদার্থবিজ্ঞানের উপর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তারপ্র তিনি আমেরিকান নৌবাহিনীর ROTC প্রোগ্রামের অধীনে নৌবাহিনীর ক্রুজার ইউ এস এস অ্যালবানিতে ইলেক্ট্রনিক্স অফিসার হিসেবে তিন বছর কাজ করেন। তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিলিয়া পেইন গ্যাপিস্কানের (Cecilia Payne-Gaposchkin) অধীনে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। জ্যোতির্পদার্থবিদ সিসিলিয়া পেইন গ্যাপিস্কান বিখ্যাত কারণ তিনিই প্রথম যিনি প্রথম সঠিকভাবে প্রস্তাব করেন সব নক্ষত্রই আসলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামে তৈরী। পিএইচডি সম্পন্ন করার পর তিনি গ্রিন ব্যাংকের ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনোমি অবজারভেটরিতে স্টাফ জ্যোতির্বিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন যেখানে সত্যি সত্যি তার কাজের শুরু হয়।
ড্রেকের আন্তনাক্ষত্রিক সভ্যতার খোঁজ তাকে বিখ্যাত বানালেও এটা তার মাত্র একধরনের কাজ। ড্রেকই প্রথম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের রেডিও ম্যাপ তৈরী করেন। যারা প্রথম শুক্র গ্রহের আবহাওয়ার ঘনত্ব ও তাপমাত্রা মাপেন ড্রেক তাদের মধ্যে অন্যতম।
ড্রেকের মোট তিনটি কাজ তাকে সারাজীবন পৃথিবীবাসির কাছে স্মরণীয় করে রাখবে। সেগুলো হলো তার প্রজেক্ট OZMA, অ্যারিসিবো ম্যাসেজ ও তার তৈরী করা বিখ্যাত SETI ইন্সস্টিটিউট আর SETI প্রজেক্ট।
তিনি প্রথম তার ভিনগ্রহের সভ্যতার খোঁজ চালান ১৯৬০ সালে এবং তিনি এর নাম দেন প্রজেক্ট OZMA। তিনি গ্রিন ব্যাংকে অবস্থিত ৮৫ ফুট প্রসস্থ ডিশ দিয়ে আমাদের মোটামুটি কাছের ও প্রায় সূর্যের মতো দুটি নক্ষত্র টাও সেটি (Tau Ceti) ও এপসাইলন ইরিদানি (Epsilon Eridani) থেকে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর রেডিও সিগনাল পাওয়া যায় কিনা তা শনাক্তের চেষ্টা করেন। এর আগে মার্কনি ও নিকোলা টেসলা এমন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিলো শুধু মঙ্গলে কোনো প্রাণী থাকলে তার সিগনাল শনাক্ত করা। কিন্তু ড্রেকই প্রথম যিনি আন্তনাক্ষত্রিক কোনো প্রাণীর রেডিও সিগ্নাল ধরার চেষ্টা করেন। প্রজেক্ট OZMA তে হয়তো কোনো কিছু শনাক্ত হয়নি কিন্তু তিনি এটার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন ধারার জন্ম দেন।
তার অন্য আরেকটি অবদান আসে যখন তিনি ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনোমি ও লোনোস্ফেয়ারের ডিরেক্টর হন। এই সেন্টারটির অধীনেই আবার অ্যারেসিবো অবজারভেটরির পরিচালনার দায়িত্ব ছিলো। অ্যারেসিবো অবজারভেটরি কোনটা যদি ধরতে না পারেন তাহলে বলি এটি হলো কিছুদিন আগে যে বিশাল রেডিও টেলিস্কোপ ভেঙে পরলো সেই অবজাভেটরি। ড্রেক এটার সেন্সিটিভিটি আরো বাড়িয়ে দেন এবং এটাকে তার সময়ের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপে পরিণত করেন।
ড্রেক তার দায়িত্বে থাকা সবচেয়ে বড় এই টেলিস্কোপের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে এই টেলিস্কোপ হতে একটি এনকোডেড সংকেত আমাদের থেকে ২২০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত M31 নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে ছুড়ে দেন। ম্যাসেজটির ট্রান্সমিশন ছিলো মাত্র তিন মিনিটের আর এটি ছিলো ১৬৭৯ হার্জের মেসেজ। মেসেজটিতে ছিলো ডিএনএ এর ডাবল হেলিক্স , মানুষের আকৃতি আর সৌরজগতে মানুষের অবস্থান। এই মেসেজটিকে বলা হয় অ্যারিসিবো মেসেজ। তার উদ্দেশ্য ছিলো হয়তো কোনোভাবে, কোথাও কেউ না কেউ মেসেজটি শনাক্ত করবে। অবজারভেটরিটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এটি থেকে ছোড়া মেসেজটি আজও হয়তো মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই ধরনের মেসেজ এটাই একমাত্র ছিলো না। তার জন্য এর আগে ১৯৭২ সালে ড্রেক কার্ল সাগান ও তার তৎকালীণ স্ত্রি লিন্ডা সেলজম্যানের সাথে পাইওনিয়ার প্লেক ডিজাইন করেন। পাইওনিয়ার প্লেক ছিলো নাসার আন্তনাক্ষত্রিক মহাকাশযান পাইওনিয়ার ১০ ও ১১ থাকা প্লেট যাতে পুরুষ ও নারীর নগ্ন চিত্র ও পৃথিবীর অবস্থানের একটি কসমিক মানচিত্র। এটাই ছিলো প্রথম মহাকাশে পাঠানো কোনো ফিজিক্যাল মেসেজ। এছাড়া তিনি ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড প্রজেক্টের সাথেও যুক্ত ছিলেন। ভয়েজার রেকর্ডের সাথে যুক্ত অ্যান ড্রুয়ানে মতে, যদি ফ্রাঙ্ক না হতো তাহলে কোনো গোল্ডেন রেকর্ডই হতো না। কারণ এটি তারই আইডিয়া ছিলো যে ম্যাসেজকে ফোনোগ্রাফিক রেকর্ডে করে পাঠানো।
ড্রেকের সবচেয়ে বড় অবদান হলো তার SETI প্রজেক্ট ও তার ড্রেক সমীকরণ। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে একটি কনফারেন্সে ড্রেক তার এই SETI প্রজেক্টের ঘোষণা দেন। তার সেই কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন কার্ল সাগানের মতো বিজ্ঞানী। SETI এর পূর্ণরূপ হলো Search for Extraterrestrial Intelligence।এখানে ড্রেক আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে থাকা বুদ্ধিমান প্রানী শনাক্তের সংখ্যা নির্ণয়ের একটি সূত্র দেন। এটি আসলে কোনো সূত্র নয় এটি আসলে ছিলো একটি দিকনির্দেশনা যা নির্দেশ করে ভীণগ্রহের প্রানী শনাক্তে আমাদের কি কি জিনিস জানতে হবে। কারণ ড্রেকই প্রথম যিনি এটা এই বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেন। SETI ইনস্টিটিউট আজও তার সূত্রের চলকগুলোর মান বের করার চেষ্টা করছে। তার সমীকরণটি হলো,
N = R* × fp ×ne × fe ×fi × fc × L
এখানে, N = প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সভ্যতার সংখ্যা
R* = একটি ছায়াপথে বা গ্যালাক্সিতে তারার জন্মহার
fp = তারাগুলোর মধ্যে যাদের গ্রহ আছে তার শতকরা হার
ne = ঐ সকল গ্রহগুলোর মধ্যে যে সকল গ্রহ প্রাণবসবাসযোগ্য অবস্থানে আছে তার শতকরা হার
fe = প্রাণবসবাসযোগ্য অবস্থানে থাক গ্রহগুলোর মধ্যে যাদের সত্যি প্রাণের অস্তিত্ব আছে তাদের শতকরা হার
fi = প্রাণের অস্তিত্ব থাকা গ্রহগুলোর মধ্যে যে সকল গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে তাদের শতকরা হার
fc = বুদ্ধিমান প্রাণীগুলোর মধ্যে যারা তাদের অস্তিত্ব জানানোর জন্য রেডিও তরঙ্গ মহাকাশে ছেড়েছে তাদের হার
L = যে সকল বুদ্ধিমান প্রাণী মহাকাশে বেতার তরঙ্গ প্রেরণ করেছে সেই সভ্যতার আয়ুষ্কাল
সমীকরণটিতে ৭ টি চলক (variables) বিদ্যমান । ড্রেকের সমীকরণ হতে আমরা কোনো গ্যালাক্সীতে কতগুলো বুদ্ধিমান সভ্যতা রয়েছে তার একটা সম্ভাব্য মান জানতে পারি।
SETI ইনস্টিটিউটের সিনিয়র জ্যোতির্বিদ সিথ সোস্টাক ড্রেক সমীকরণ সম্পর্কে বলেন, এই সমীকরণের অধীকাংশ চলকই আমাদের অজানা। আপনি বলতে পারেন এটা অপ্রয়োজনীয় কিন্তু তা ঠিক নয় কারন এটা খুবই ভালো পন্থা অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে বাদ দেয়ার।
তিনি মহাকাশে ভিনগ্রহের প্রানী খোঁজার একটি বিশাল ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়ে গেছেন। তাকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো আমরা কি কখনো অন্য গ্রহে বা গ্যালাক্সিতে বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজ পাবো?
এই প্রশ্নে তার উত্তর ছিলো, এটা কেবল শুরু। মানুষের ধারনা আমরা পুরো আকাশকে সবসময় সব ফ্রিকোয়েন্সিতে পর্যবেক্ষণ করি কিন্তু আমরা এখনো এর চেয়ে অনেক পিছিয়ে। যদি আমরা সঠিক দিকে সঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতেও শোনার চেষ্টা করি তাও আমরা যা খুজছি তা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। আমরা আসলে কিছু টিকিট হাতে নিয়ে অনেক বড় লটারী খেলতে বসেছি।
এক বিরাট ও সফল জীবন অতিবাহিত করেছেন ফ্রাঙ্ক ড্রেক আর দিয়েছেন দিকনির্দেশনা মানবজাতিকে যা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভিনগ্রহে প্রাণ সন্ধানের রাস্তা খুঁজে পায়।
তথ্যসূত্রঃ Scientific American, SETI
Leave a Reply